গতকাল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন ২০২৬-এ আবার হাওয়াই চটিই উঠবে নবান্নের চোদ্দ তলায়। সেটাকে সংখ্যাতেই জানিয়ে দিয়েছেন সেকেন্ড-ইন-কমান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন বিজেপি ৫০-এর নীচে পাবে। এবং খেয়াল করে দেখুন এই কথাটা আমরা আমাদের এই অনুষ্ঠানেই বেশ কয়েকবার বলেছি। হ্যাঁ, বিজেপি ৫০ কেন তার অনেকটা তলাতেই থেকে যেতে পারে, এবং সেই তথ্য, সেই খবর বিজেপির উপর মহলের কাছেও আছে। আছে বলেই তাঁরাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন, মানে মাধুকরির আগে, রোজকার ভিক্ষেতে বেরোনোর আগে বৈষ্ণবরা যেমন কপালে তিলক কেটে, একটা সৌম্য ভদ্র-সভ্য চেহারা নিয়ে বেরোয়, সেইরকমই বিজেপিও খানিক বদলানোর চেষ্টা করছে। অন্য সুর শোনা যাচ্ছে বিজেপির গলায়, ২০২৪-এর পরে বেশ কিছুদিন কাঁথির খোকাবাবু চাই না আমাদের ৩৩ শতাংশ মুসলমানের ভোট, ওসব থাকুক মমতা বেগমের জন্য, আমরা সনাতনীদের ভোট চাই। যেমন নিরেট প্রধানমন্ত্রী, তেমনিই নিরেট এই ‘টাচ মি নট’ খোকাবাবু। এই সনাতনীদের বিরুদ্ধেই এই বাংলার দলিত মানুষের লড়াই, যে লড়াই থেকে জন্ম নিয়েছে বৈষ্ণব ধর্ম, চৈতন্যদেব, যে লড়াই থেকে জন্ম নিয়েছে মতুয়ারা, গুরুচাঁদ হরিচাঁদ ঠাকুর, সেই সনাতন ব্রাহ্মণ্যবাদের কাঁধে ভর করে নাকি উনি বাংলার গদিতে বসবেন। কিন্তু খেয়াল করেছেন, ইদানিং সেসব কথা বলা বন্ধ, নির্দেশ দিল্লির। এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায় পড়া রাজ্য সভাপতি একই বৃন্তে দুটি কুসুমের কথাও বলছেন। এই পরিবর্তনের তো দরকার ছিল না যদি বিজেপির উপর মহল বুঝতে পারত যে, এই মেরুকরণেই, এই তীব্র মুসলমান ঘৃণা ছড়িয়েই মসনদ দখল করা যাবে। পরিবর্তন হয়েছে কি যোগিজির কথায়? না, তিনি এখনও সেই বিষ ঢেলেই চলেছেন, বরং আরও বেশি করেই ঢালছেন। কারণ সেখানে সেই বিষ কাজ করছে। এখানে সেই বিষ কাজ করছে না বলেই বাংলা বিজেপিতে কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ‘জয় শ্রী রাম’, ‘জয় জয় শ্রী রাম’-এর বদলে ঝুপ করে ‘জয় মা কালী’, ‘জয় মা দুর্গা’-তে নেমে এসেছে, কদিন পরে ‘জয় বাংলা’ও বলতে পারে। কিন্তু তাতেও কি কাজ দেবে? না, কাজ দেবে না। ৫০-এর নীচে নামবেই বিজেপি। সেটাই বিষয় আজকে। হ্যাঁ, ২০২৬-এ বিজেপি ৫০টার কম আসন পাবে। কিন্তু কেন?
বিজেপি ৫০টার কম আসন পাবে তার প্রথম কারণ হল – টিনা। না, আমি কোনও নতুন কেচ্ছা কেলেঙ্কারির কথা বলছি না। টিনা হল – টিআইএনএ, দেয়ার ইজ নো অলটারনেটিভ। হ্যাঁ কোনও বিকল্পই নেই। কার? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। একটা বিকল্প মুখ থাকাটা কি খুব জরুরি? না এক্কেবারেই নয়। অনেক সময়েই বিকল্প মুখ ছাড়াও ধসে পড়েছে সাম্রাজ্য। কিন্তু উঠতে-বসতে, খেতে-শুতে, ঘুমে-জাগরণে যদি আপনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই আক্রমণ করতে থাকেন তাহলে এই প্রশ্ন তো আসবেই যে বেশ তো, ওনার জায়গাতে কে ভাই? শুভেন্দু অধিকারী? যাঁর রাশি রাশি ভুরি ভুরি কথা ছড়িয়ে আছে অন্তর্জালে, ইন্টারনেটে, গুগলে ইউটিউবে, সমাজ মাধ্যমে। যেখানে তিনি মমতার এই কাজগুলোকেই সমর্থন করছেন, প্রশংসায় ভরিয়ে দিচ্ছেন। ছড়িয়ে আছে অসংখ্য তেমন কথাবার্তা, যা শুনলে এবং কেউ অনুবাদ করে দিলে এখনও মোদিজি শান্তিকুঞ্জে ইডি সিবিআই পাঠাবেন। না, তিনি কোনওদিনও বিকল্প মুখ হয়ে উঠতে পারবেন না তাঁর শেকড়ের জন্য। সেই মুনির বরে বাঘ হওয়া ইঁদুরের মতই তিনি তাঁর জন্মদাগ মুছে ফেলতে পারছেন না। এরপরের নামগুলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কড়ে আঙুলের সমান। তাহলে হবে কী? ঐ যে ৫০-এর নীচে।
আরও পড়ুন: Aajke | ভোট আসছে, ভূতের মুখে রাম নাম শুনছি, বিজেপির মুখে গণতন্ত্রের কথা
দ্বিতীয় কারণ হল, সেই পুরনো কথাটা, ‘রেখেছো বিজেপি করেই মাগো, বাঙালি করোনি’। রুটি দিয়ে যারা আলুপোস্ত খায়, যাদের ক্যাডারদের ‘কারিয়াকর্তা’ বলা হয়, প্রবীণকে বরিষ্ঠ, জেলাকে মন্ডল, আর মোদিজির প্রতিশ্রুতি না বলে যারা ঘোষ্ণাপত্র বলে, তারা এই বাংলাতে কী করে রাজনীতি করবে? তাদের চোলায়-চোলায় চোলাই থাকতেই পারে, জয়ের ভেরী বাজবে কী করে? যারা সনাতনের কথা বলে তারা এই বাংলার দলিতদের সমর্থন কী করে পাবে? তিন নম্বর কারণ হল, বঙ্গ বিজেপি এই মূহুর্তে নব্য ও আদি বিজেপি শিবিরে এমনভাবে ভাগ হয়ে গিয়েছে, যা সারিয়ে দুই শিবিরকে এক মাঠে নামানো অসম্ভব। একদল অন্যদলের যাবতীয় তথ্য দিচ্ছে তৃণমূলের বিভিন্ন নেতাকে। চার নম্বর কারণ হল, মমতার মহিলা ভোট, যা ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ থেকে আসে, যা ‘কন্যাশ্রী’ থেকে আসে, যা ‘স্বাস্থ্যসাথী’ থেকে আসে। সেই রামবাণ সামলানোর দাওয়াই নেই বিজেপির কাছে, কারণ বিভিন্ন রাজ্যে তাঁরাই মমতা সরকারের এই প্রকল্পগুলোকে টুকেছেন। পাঁচ নম্বর কারণ হল, এখনও সিপিএম বা কংগ্রেসের কিছু ভোট থেকে যাওয়া। সেই ৭ থেকে ৮ থেকে ১০ শতাংশ ভোটও যদি মেল্ট ডাউন করত, চলে যেত মমতা বিরোধী বিজেপির বাক্সে, তাহলে এক সেকেন্ডে ছবি বদলে যেত। কিন্তু তা হচ্ছে না। আর সেটা যেন না হয়, তার জন্য তৃণমূল নেত্রীর একটা চোখ সদা সতর্ক থাকে। কিছুদিন পর পর অন্তত সমাজ মাধ্যমে, অন্তত ঐ ৫ থেকে ৭ থেকে ৮ শতাংশ ভোটারদের কাছে সিপিএমকে রেলেভেন্ট করে রাখা হয়। ওনারা নবান্ন অভিযান করেন, মীনাক্ষী-সৃজনরা রাস্তায় নামেন। কমেছে, ওনাদের ভোটই গেছে বিজেপির বাক্সে, সম্ভবত ২০২৬ এর পরে সেই ভোট আবার ঘরমুখো হবে। কিন্তু যা আছে, তা অন্যদিকে যাবে না। এবং আছেন বিজেপি বিরোধী, সিপিএম নয়, কংগ্রেস নয় এমন এক বিরাট বাম উদার গণতান্ত্রিক সমাজ, যাঁরা লেসার এভিলকে জেনেবুঝেই ভোট দেবেন। আর শেষ অংকটা হল পারসেপশন, ধারণা। হেরো পার্টি হারে, জিতবে বা জিততে পারে যে দল সেই দল আশার বাইরেও দু’চারটে আসন বেশি পায়, খানিকটা ‘জো জিতা ওহি সিকন্দর’ গোছের ব্যাপার। তো জিতবেই তৃণমূল, খামোখা উল্টোদিকে নাও বেয়ে লাভ কী? এই যুক্তি বহু লোকের মাথায় কাজ করে, যে যুক্তি ভেঙেছিল ২০১৯-এ। জিতবেই বিজেপি – এই ধারণাই সেবার ১৮টা আসন এনে দিয়েছিল। ২০২১ ছিল কী জানি কী হয়। কিন্তু ২০২৪ থেকে আবার ধারণাটা হল, তৃণমূল তো জিতবেই। হ্যাঁ, এই ধারণাই তৃণমূলকে দেড় থেকে দু’শতাংশ বেশি ভোট এনে দেয়। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে অভিষেক বলেছেন, আমরাও আগে বলেছি যে বিজেপি ৫০টার বেশি আসন পাবে না, আপনারাও অনেকেই এমনটা মনে করেন। কিন্তু আমরা জানতে চাইছি, বিজেপি কেন ২০২৬ এর নির্বাচনেও গোহারান হারবে বলে মনে করেন?
হ্যাঁ, শক্তি চাটুজ্যের সাড়ে তিনখানা কবিতা মুখস্ত থাকা রাজ্য সভাপতিকে আনা হয়েছে, ‘জয় শ্রী রাম’ থেকে ‘জয় মা কালী’, ‘জয় মা দুর্গা’তে নেমেছেন বিজেপি নেতারা। দিল্লি, কলকাতা, জেলাতে দুর্গাপুজোর আয়োজন করছেন তাঁরা। কিন্তু সমস্যা হল, তাঁদের এই চেষ্টাগুলো বড্ড মেকি, বড্ড চোখে পড়ছে। এবং ক’দিন আগেই মমতা কলকাতায় বাংলাতে পুজো করতে দেয় না বলার পরে নিজেরা ধুমধাম করে পুজো আয়োজন করার পরে কেন মুখে পুজো কার্নিভালের বিরোধিতা করবেন? যদিও সেই কার্নিভালের সামনে পুরো আলোটা শুষে নেবেন তৃণমূল নেত্রী। এর মধ্যেই দুর্গা অঙ্গন, এর মধ্যেই দীঘার জগন্নাথ ধাম, এর মধ্যেই ইফতার বা বড়দিনের ক্যারলে গিয়ে মমতা যে সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের ছবি তৈরি করছেন, বঙ্গ বিজেপিতে তাকে পাল্লা দেওয়ার মতো না আছে নেতা, না আছে কোনও প্রোগ্রাম। কাজেই, লিখে নিন, হ্যাঁ, ২৬-এর নির্বাচনে ৫০-এর তলাতেই থাকবে বিজেপি।