আজকের গল্প চাঙ্গায়নী সুধা নিয়ে। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে পরশুরাম ছদ্মনামে রাজশেখর বসুর সেই অনবদ্য গল্প, যেখানে এই সুধার কথা বলা হয়েছিল। নামেই বোঝা যাচ্ছে এই সুধা ভেঙে পড়া মানুষকেও চাঙ্গা করে দিতে পারে। কী দিয়ে তৈরি হয় এই চাঙ্গায়নী সুধা? রাজশেখর বসু জানিয়েছিলেন, বিভিন্ন রকমের জড়িবুটি গাছগাছড়া আর তার সঙ্গে কয়েক ডোজ ইলেকট্রিসিটি। কী ভাবছেন? ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি? মোটেই না। কথাতেই তো আছে পুরোনো মদ নতুন বোতলে ফিরে আসে বারবার। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। চাঙ্গায়নী সুধা বাজারে ফিরে এসেছে আবার। কিন্তু নতুন প্যাকেজিংয়ে তার নাম হল SIR বা ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন।
কিন্তু কেন? কাদের চাঙ্গা করছে এই SIR? দেশের মানুষকে যে নয় সেতো বোঝাই যাচ্ছে। মনে করুন বিহারের কথা। বিহারে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন নিয়ে কী পরিমাণ গোলমাল হয়েছে আর হয়ে চলেছে সে তো আমরা জানি। শেষ পাওয়া তথ্য বলছে, SIR-এর পর এখনও পর্যন্ত ৪৭ লক্ষ নাগরিকের নাম বাদ গিয়েছে ভোটার তালিকা থেকে। যদিও রাজনৈতিক কর্মী যোগেন্দ্র যাদবের অভিষোগ অনুষায়ী বিহারে বাদ গিয়েছেন ৬৫ লক্ষ মানুষ। কিন্তু শুধু এইটুকুই নয়। যোগেন্দ্র যাদব এবং একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আরও অভিযোগ জানিয়েছে যে, বিহারে খসড়া ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাওয়া ৬৫ লক্ষের মধ্যে ২৫ শতাংশই মুসলিম। যোগেন্দ্র সরাসরি বলেছেন, সফটওয়্যারের মাধ্যমে বেছে বেছে মুসলিম নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন যদিও এইসব অভিযোগকে মিথ্যাচার বলে হাত ঝেড়ে ফেলতে চাইছে, কিন্তু প্রশ্ন এই, বিহারে এই যে লাখ লাখ মানুষ ভোটার তালিকা থেকে বাদ গেলেন, তার ফলে চাঙ্গা হলেন কারা?
বিহার আপাতত থাক, আসুন পশ্চিমবঙ্গের কথায় আসি। পশ্চিমবঙ্গে এখনও SIR-এর কাজ শুরু হয়নি। উৎসবের মরসুম চলছে বাংলায়। তার পরপরই নভেম্বর মাস নাগাদ এখানে শুরু হতে পারে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন। যদিও গোলমাল কিন্তু শুরু হয়ে গেছে ভালোভাবেই।
আপনারা জানেন, নির্বাচন কমিশন আধার কার্ড বা ভোটার কার্ডের মতো পরিচয়পত্রগুলোকে মান্যতা দিতে একেবারেই রাজি ছিল না। সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, বিহারে আধার কার্ডকে অ্যাড্রেস প্রুফ হিসেবে মানতে হবে। কিন্তু এই নিয়ম শুধু বিহারেরই জন্য, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে কী হবে? সে নিয়ে কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও স্পষ্ট নির্দেশিকা নেই। অথচ, পশ্চিমবঙ্গ হচ্ছে সেই রাজ্য যেখানে বাংলা ভাগের পর এবং ৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ববঙ্গের লাখ লাখ উদ্বাস্তু এসে ঠাই নিয়েছেন। এইসব উদ্বাস্তু পরিবারে বাবা মায়ের জন্মের তারিখ প্রায় কারওরই সঠিক ভাবে জানা নেই। অথচ, সেই জন্মতারিখকেই নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে গুরুত্ব দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। যে কারণে পাল্টা দাবি উঠছে আধার কার্ড এবং সেল্ফ ডিক্লেয়ারেশনকে মান্যতা দিক কমিশন।
মুশকিলটা হচ্ছে, ফাঁপড়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ। কিন্তু সেই ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে বঙ্গ বিজেপি। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী দাবি করেছেন, রাজ্যের ভোটার লিস্টে প্রায় ১৭ লক্ষ রোহিঙ্গ্যা রয়েছে। কিন্তু কীসের ভিত্তিতে এই দাবি করছেন শুভেন্দু, পাল্টা জানতে চেয়েছে কংগ্রেস।
আরও পড়ুন: Aajke | আমরা দুটি ভাই, ইডি আর সিবিআই, ভোটের গাজন গাই
বাংলায় মমতা ম্যাজিকে বিজেপির এই মুহূর্তে নাজেহাল অবস্থা। দলে দলে বিজেপি কর্মী পরিবার সমেত হাতে তুলে নিচ্ছে ঘাসফুলের পতাকা। কিন্তু নিরাশার এই অন্ধকারের ভিতর হঠাত করে SIR নিয়ে কি একটু চাঙ্গা হয়ে উঠল বিজেপি নেতৃত্ব? হতেই পারে, কেন না শুভেন্দু অধিকারী নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ দায়ের করেছেন, তার বক্তব্য ২২৬ জন ইলেকটোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসারের নিয়োগ কমিশনের নিয়ম মেনে হয়নি। তাকে তিনি নির্লজ্জ রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব বলতেও পিছপা হননি। প্রশ্ন এই, হঠাৎ করে শুভেন্দু এত এনার্জি পাচ্ছেন কোথা থেকে? আসব সে কথায়, তার আগে বরং গোটা খবরটা একবার ভালো করে দেখে নেওয়া যাক।
তাহলে কি ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে, SIR-কে সামনে রেখে দেশে গৃহযুদ্ধ বাঁধাতে চাইছে বিজেপি? এই বক্তব্য আমাদের নয় কংগ্রেসের। রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য বিজেপির সিংহাসন টলমল করছে। সেক্ষেত্রে দেশে যদি গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে বিজেপির টিকে থাকার রাস্তা আরও কিছুটা পরিস্কার হতে পারে। কারণ, লক্ষ লক্ষ মানুয যদি ভোটার তালিকা থেকে বাদ যেতে থাকেন, হারাতে থাকেন নাগরিকত্ব, তাহলে তো তারা রাস্তায় নামবেনই। কিন্তু এসবের আগে অন্য একটা প্রশ্ন আছে। সেটা হল এই, যেসব রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় নেই এবং বিরোধী দল হিসেবেও তাদের ল্যাজে গোবরে অবস্থা, সেই সব রাজ্যে SIR লাগু করে কী নেতিয়ে পড়া বিরোধী বিজেপিকে চাঙ্গায়নী সুধা খাওয়ানো হচ্ছে? SIR তাহলে হেরো বিজেপির এনার্জি বুস্টার? দেশের নিরাপত্তার নামে এই কোটি কোটি টাকা খরচা করা হচ্ছে, যাতে বিজেপির নেতিয়ে পড়া নেতারা একটু গা-ঝাড়া দিতে পারে? আসুন শুনে নিই, মানুষ কী বলছে।
নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য, SIR-এর কাজ দেশ জুড়েই চলছে। অন্যান্য রাজ্যও কাজ শেষ করেছে বা শেষের পথে। সেক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে পড়লে জাতীয় পর্যায়ে জটিলতা তৈরি হবে। তাই কমিশন চাইছে সম্পূর্ণ স্বচ্ছভাবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাংলায় SIR-এর কাজ শেষ করতে। কিন্তু কমিশন চাইলেই তো হবে না, এর মাঝখানে শুভেন্দু অধিকারী বলে একজন আছেন। শুভেন্দুর আরও এক গুরুতর অভিযোগ হল, খড়গপুর সদর বিধানসভা কেন্দ্রে বিএলওরা প্রকাশ্যে তৃণমূলের সভায় অংশগ্রহণ করছে। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ পেশ করেছেন শুভেন্দু। অভিযোগের ভিত্তিতে রিপোর্টও তলব করেছে কমিশন।
কিন্তু এত খেলাধুলোর কী আছে? কমিশন সূত্রের খবর, ২০০২ সালে রাজ্যে জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৮ কোটি। তার মধ্যে ভোটারের সংখ্যা ছিল ৪.৫৮ কোটি। এক থেকে ১৮ বছরের মধ্যে ভোটারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ কোটি ৫২ লক্ষ। তাদের মধ্যে অনেকেই এখন ১৮ পেরিয়েছে। শুধু তাই নয় ২০০২-এর পর ২০০৬ পর্যন্ত যাদের জন্ম হয়েছে তারাও পেরিয়ে গেছে ১৮-র গণ্ডি। স্বাভাবিকভাবেই এই সময়ের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে বেশ কিছু ভোটারের। এবার, মৃত্যুহারের থেকে জন্মের হার স্বাভাবিক ভাবেই বেশি। কাজেই সব মিলিয়ে ধরেই নেওয়া যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের ভোটারের সংখ্যা সাড়ে ৮ কোটির কাছাকাছি আর নির্বাচন কমিশন বলছে সংখ্যাটা হল ৭ কোটি ৬২ লক্ষ। অর্থাৎ গাদা গাদা সংখ্যালঘু বা অনুপ্রবেশকারী সেই তালিকায় অনুপস্থিত। এই ভোটাররাই তো তৃণমূলকে জিতিয়েছে, বোঝাই যাচ্ছে ভোটে জিততে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন করে অনুপ্রবেশকারী ঢোকানোর কোনও দরকারই নেই।
বাদ দিন তথ্যের কথা। হেরো বিজেপির এসব খেলা চলবে, চলতে থাকবে। কিন্তু আমাদের সোজা প্রশ্ন এই, কেন সাধারণ মানুষকে বারবার নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে? কার মর্জির উপরে নির্ভর করবে দেশের মানুষের ভোটাধিকার? আসল কথা এই, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় বিজেপি নেই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন। আর মমতা পরিষ্কার জানিয়েছেন, একজন প্রকৃত ভোটারকেও বাদ দেওয়া যাবে না। গোটা বিষয়টা কি তাহলে রাজনৈতিক লড়াইয়ের দিকে এগোচ্ছে? দু’দিন আগে হোক বা পরে বিজেপির সঙ্গে এ লড়াই তো হওয়ারই কথা, তাই না?







