সুকুমার রায়ের ‘হযবরল’ দিয়ে শুরু করছি আজকে। হযবরল-র সেই ন্যাড়াকে নিশ্চয়ই মনে আছে আপনাদের। এই ন্যাড়ার সঙ্গে কিন্তু বঙ্গ বিজেপির নানা জায়গাতেই মিল আছে। যেমন ধরুন, ন্যাড়ার গান কেউ শুনতে চায় না, কিন্তু ন্যাড়া বলে, “আহা রাগ করলে ভাই, রাগ করার কী আছে, না হয় একটা গান শুনিয়েই দিচ্ছি।” ঠিক এভাবেই বঙ্গ বিজেপিকে বাংলার মানুষ ভোট দিতে চাইছে না, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে মানুষ। কিন্তু বিজেপি বলে যাচ্ছে, “আহা, জনগন নয় এসব তো করছে অনুপ্রবেশকারীরা। কী বলছো? ভোট দেবে না ভাই? আহা রাগ করে না। দিয়েই দাও ভোট। আমরা তো হাত পেতেই আছি।” ন্যাড়ার সঙ্গে বিজেপির দ্বিতীয় মিল – ন্যাড়াকে মামলার আসামী সাজানো হয়েছিল, ন্যাড়া ভেবেছিল আসামীও পয়সা পাবে, তাই চুপচাপ কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। বিজেপিও ভাবছে, সে ভোট পাবে আর তাই ভোটের বাজার গরম করে চলেছে।
কিন্তু, আসল গরম তো বঙ্গ বিজেপির অন্দরেই। এসআইআর আর সিএএ, বিজেপির দুই হাতিয়ার, ব্যুমেরাং হয়ে ঢুকে পড়েছে বিজেপির খাসমহলে। প্রথমে সিএএ-র গল্পটাই বলি। বিজেপি বুঝে গিয়েছে, নির্বাচন কমিশন যে তথ্য দিচ্ছে, তা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশকারী ভোটারের গল্পটা জমানো যাবে না। তাছাড়াও বাঙালিয়ানাকে তুলে ধরার লড়াইয়ে, বাঙালির পাশে থাকার সংগ্রামে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর তাই, এসআইআর-এর পাশাপাশি ফের বিজেপি সিএএ চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গে। বিশেষ করে মতুয়া ভোটের কথা মাথায় রেখেই কিন্তু এই দাবার চাল।
আরও পড়ুন: Aajke | SIR-এর পর CAA, ভোট হাতাতে জুজুর ভয় দেখাচ্ছে বিজেপি, হাসছে মানুষ?
এইবার আসল গল্পে আসি। রাজ্যের ১৭টি জেলায় বিধানসভাভিত্তিক সিএএ শিবির খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বঙ্গ বিজেপি। অগ্রাধিকার পেয়েছে মূলত সীমান্ত লাগোয়া জেলাগুলি। বোঝাই যাচ্ছে ভোটের মুখে বিজেপির কড়া নজরে রয়েছে মতুয়ারা। সেই সুবাদে নদিয়া ও বনগাঁয় একাধিক সহায়তা শিবির খুলেছে বাংলার গেরুয়া শিবির। গত ১৬ সেপ্টেম্বর নদিয়ার কল্যাণী সেন্ট্রাল পার্ক এলাকায় শ্যামাপ্রসাদ ভবনের পাশে একটি সহায়তা শিবির উদ্বোধন করেন বনগাঁর সাংসদ তথা জাহাজ প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর। এইবার কাহানি মে টুইস্ট। বুধবার রাতে বিজেপির সেই শিবিরেই, সেই ভোট হাতানোর হাতিয়ার সিএএ-র শিবিরে ভাঙচুর চালানো হল। কারা চালাল ভাঙচুর? না তৃণমূল নয়, বিজেপির শিবিরে তাণ্ডবে মাতল বিজেপিরই এক গোষ্ঠী। শান্তনু ঠাকুরের অনুগামীরা অভিযোগ তুলেছেন কল্যাণীর বিজেপি বিধায়ক অম্বিকা রায়ের বিরুদ্ধে। এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন শান্তনু ঠাকুর। শুধু তাই নয়, দলের কাছে এর বিহিত দাবি করেছে শান্তনু শিবিরের বিজেপিরা। এবার আসি কল্যাণীর বিজেপি বিধায়ক অম্বিকা রায়ের কথায়, কী বলছেন তিনি? যা বলছেন, তা বেশ গুরুতর অভিযোগ। অম্বিকার পাল্টা প্রশ্ন, গভীর রাতে সিএএ অফিস খুলে মদ-মাংসের মোচ্ছব চলছে, এটা আবার কেমন সহায়তা শিবির? বেশ ভালো মজা জমেছে তাই না? একদিকে মানুষের বিক্ষোভের মুখে শুভেন্দু, অন্যদিকে বিজেপিই মারছে বিজেপিকে। পাশাপাশি এসআইআর নিয়েও ঘরোয়া কোন্দল চরমে। আসুন দেখে নেওয়া যাক।
এসআইআর-এর গণ্ডগোলটা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে। হবে নাই বা কেন। শুভেন্দু অধিকারী বিরোধী দলনেতা, কিন্তু নিজের দলের সঙ্গেই তার বোধহয় কোনও কমিউনিকেশন নেই। কেন না, শুভেন্দু বারবার বলেছেন এসআইআর-এ বাদ যাওয়া ভোটারদের বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করে পুশব্যাক করা হবে। মতুয়া সম্প্রদায়ভুক্ত বিজেপি নেতারা কিন্তু শুভেন্দুর এই মন্তব্যকে খুব সিরিয়াসলি নিয়েছেন। তাঁরা কিন্তু এরকম পরিস্থিতিতে নিজের দলকেই ছেড়ে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। সমানে গাল পাড়ছেন শুভেন্দু অধিকারীকে। এরকমটা হবে নাই বা কেন? বিজেপির ধারণা মতুয়া-নম-শূদ্ররা এখন তাঁদের ভোটব্যাঙ্ক। সেখানে শুভেন্দুর এইসব উল্টো পাল্টা মন্তব্যে ঘুম উড়ে গিয়েছে মতুয়া সম্প্রদায়ের গেরুয়া নেতাদের। শান্তনু ঠাকুর, নিশীথ প্রামাণিক, অসীম সরকার সকলেই ভাবছেন এসআইআর-এ যদি মতুয়াদেরই নাম বাদ যায়, তাঁরা বাঁচবেন কী নিয়ে? এই তো হালত বঙ্গ বিজেপির। এই ছেঁড়াফাটা তালিতাপ্পা মারা দল নিয়ে তারা ভাবছে ক্ষমতা দখল করবে।
এত কিছুর ভিতরে যেটা বাকি ছিল, সে অভাবও মিটেছে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা পড়া বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য শেষমেষ হুঙ্কার ছেড়েছেন। শুভেন্দুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলছেন, ভোটার তালিকা থেকে এখন এক কোটি নাম বাদ যাবে। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন, শমীক-শুভেন্দু এই নির্দিষ্ট সংখ্যাটা জানছেন কীভাবে? এরা কেউ সরকারি লোক নন, ভোটার তালিকার কাজের সঙ্গে সরকারি ভাবে যুক্তও নন, তবে এসব কেন বলছেন? দেখে মনে হচ্ছে, বঙ্গ বিজেপির নেতাদের এসআইআর নিয়ে এত আনন্দ যে, তাঁরা ভুলেই গিয়েছেন বঙ্গ বিজেপির দলীয় সংগঠন, ভোট ম্যানেজার এসব কিছুই নেই। বুথে বুথে সৈন্য তৈরী বলে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে মিথ্যে তথ্য দিয়েছিল তো এই বঙ্গ বিজেপির নেতারাই। বুথ স্তরে নূন্যতম সংগঠন না থাকলে কী হয়, ২০২১-এর নির্বাচনী ফলাফল দেখেও সম্ভবত সেকথা বুঝতে পারেননি তাঁরা। ২০২৬-এ বুঝে যাবেন, আশা করি। শুভেচ্ছা রইল।







