যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন।
বিশ্ব এমন উন্মাদ দেখেছিল ১৯৩০ নাগাদ, হিটলার উঠে আসছেন, তখনও তিনি এক সৈনিক থেকে বনে যাওয়া রাজনীতিবিদ। হ্যাঁ, তিনি তীব্র ঘৃণা ছড়ানো শুরু করেছেন তার বছর পাঁচেক আগে থেকেই, ১৯২৫-এ তিনি লিখে ফেলেছেন মাইন ক্যাম্ফ, আমার লড়াই। তার ছত্রে ছত্রে ইহুদিদের জন্য ঘৃণা। কিন্তু তা তো তখন ইউরোপ জুড়েই। কিন্তু ১৯৩০-এর পর থেকে আমরা ক্রমশ এক উন্মাদকে দেখতে পেলাম, আজ তার অস্ট্রিয়া চাই, কাল চেকোস্লোভাকিয়া, তারপরের দিন পোল্যান্ড। তারপর আমরা জানি এক যুদ্ধ চেপে বসল পৃথিবীর ঘাড়ে, যার ফল ৮৫০ লক্ষ মৃত্যু। সেই শুরুতেই যদি সবাই মিলেই থামানো যেত ওই বজ্জাত উন্মাদকে, তাহলে এই মৃত্যুমিছিল দেখতে হত না। আজ আর এক উন্মাদকে আমরা দেখতে পাচ্ছি আবার। কেবল এক কেন, দুনিয়ার কোণে কোণে এই চরম দক্ষিণপন্থা গজিয়ে উঠছে আর তার এক নোংরা চেহারা দেখতে পাচ্ছি। সবে জার্মানিতে ভোট হল, সেখানে চরম দক্ষিণপন্থী দলের বিরাট অগ্রগতি, এএফডি ২০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে ১৫২টা আসন পেয়েছে, যারা নাৎসিদের বলে যাওয়া কথাগুলো অনায়াসে বলে, তারা দেশ থেকে অজার্মানদের তাড়ানোর কথা বলে। ইতালিতে চরম দক্ষিণপন্থী ব্রাদার্স অফ ইতালির নেত্রী জর্জিয়া মেলোনি এখন প্রধানমন্ত্রী, ফ্রান্সে দক্ষিণপন্থার উত্থান চমকে দিয়েছে সব্বাইকে, আর সামান্য জনসমর্থন বাড়াতে পারলে তারাই বসবে ক্ষমতায়। ব্রাজিলে বলসেনারো আবার ফিরে আসতে চায় ক্ষমতায়, আপাতত লুলা দা সিলভা, বামপন্থী নেতা ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট, কিন্তু তাকে ফেলার ষড়যন্ত্র জারি আছে। দুনিয়া জোড়া এক দক্ষিণপন্থার উত্থানের সঙ্গেই মিলিয়ে দেখা যাবে আমাদের দেশের আরএসএস–বিজেপির উত্থানকে। যারা দেশের মানুষের রোজগার নয়, দেশের মানুষের শিক্ষা নয়, মহাকুম্ভ নিয়ে বেশি ব্যস্ত। সেই আবহেই এক উন্মাদ আবার আমেরিকার রাষ্ট্রক্ষমতায়। কী অনায়াসে সেই পৃথিবীর সব দেশ নিয়ে কথা বলতে বলতে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ ওঠার পরেই সাফ জানিয়ে দেন যে আই লিভ দ্যাট টু প্রাইম মিনিস্টার মোদি। মানে বিশ্ব নিয়ে তো কথা বলার অধিকার এক আমারই আছে, বাংলাদেশ নিয়ে যা বলার ওনার নায়েব মোদিজিই বলবেন। উনিই বলছেন গালফ অফ মেক্সিকো হবে গালফ অফ আমেরিকা, পানামা খাল হবে আমেরিকার, কানাডার আলাদা থাকার দরকার কী? গ্রিনল্যান্ডটা ওনার চাই। এক উন্মাদের পাঠশালা খুলে বসেছেন ওই ট্রাম্প, সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি, জর্জিয়া মেলোনি, দুনিয়া জোড়া দক্ষিণপন্থী নেতারা যাঁরা মনে করেন উদার গণতন্ত্র হল আসলে মানব সভ্যতার অভিশাপ।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | ছবি কথা বলে, ছবিরও রাজনীতি আছে
আর ঠিক তার উল্টোদিকে ভিয়েতনাম তার অর্থনীতিকে প্রসারিত করছে, দুনিয়ার রফতানি বাণিজ্যে তারা বিরাটভাবে এগোচ্ছে, সারা দুনিয়ার চিকিৎসা গবেষণার হাল ধরেছে পুঁচকে দেশ কিউবা, ব্রাজিল জানিয়ে দিয়েছে অ্যামাজন অববাহিকায় আর কোনও ধ্বংসলীলা চলবে না।
বাম, গণতান্ত্রিক শক্তিরা মিলে ফ্রান্সে দক্ষিণপন্থাকে রুখে দিয়েছে, জার্মানিতে এতকিছুর পরেও চরম দক্ষিণপন্থাকে রুখে দিতেই সিডিইউ, সিএসইউ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী এসপিডির সঙ্গে জোট বাঁধছে, সিডিইউর নেতা ফ্রেডরিক মার্জ জানিয়ে দিয়েছেন আমরা রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধেই আছি, যে কোনও মূল্যে তা রুখব। আমেরিকা চীনের অগ্রগতি দেখেই তার বিরুদ্ধে এক জোট বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু তারাও ভালো করেই জানে যে চীন বা জাপান বা দুটো দেশ মিলে যদি আজ টাকা ফেরত চায়? যে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি আজ আমেরিকার ঘাড়ে চেপে বসে আছে, তাহলে ডলার হু হু করে পড়ে যাবে। নিজেদের দেশের অর্থনীতির এই হাল সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ট্রাম্প সাহেব তাই সেয়ানা পাগলের ভূমিকায় নেমেছেন। তিনি তাঁদের এক অবশ্যম্ভাবী অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে পেছনে রেখেই দুনিয়া জোড়া এক ভাগ বাঁটোয়ারার খেলায় মেতেছেন, মোদিজি বাংলাদেশ দেখবেন আর আমি গ্রিনল্যান্ড নেব হচ্ছে সেরকম এক সেয়ানা পাগলামি, যা বাংলাদেশের মানুষ জানে, জানে ভারতের মানুষ, বিশ্বের মানুষেরও তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। আর ঠিক সেই কারণেই ইতিমধ্যেই ইউরোপে ট্রাম্প বিরোধী জোট গড়ে উঠছে, আর খোদ আমেরিকার মধ্যেই ট্রাম্পের এই বিভিন্ন ডিক্রি জারির ফলে যে মানুষেরা চাকরি হারিয়েছেন, যাঁরা ভয় পাচ্ছেন তাঁদেরও চাকরি যাবে সেই মানুষেরা রাস্তায় নামছেন। এই দক্ষিণপন্থাই পৃথিবীর ইতিহাস লিখবে না, দেশে দেশে সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই তাঁদের হিসেব নিকেশ বুঝে নেবেন।