Wednesday, November 5, 2025
HomeScrollFourth Pillar | বিহারের নির্বাচনে কী হতে চলেছে? পার্ট টু
Fourth Pillar

Fourth Pillar | বিহারের নির্বাচনে কী হতে চলেছে? পার্ট টু

বিহারের নির্বাচনে ফলাফল বুঝতে চান?

জাতপাতের লড়াই ঠিক করে দেবে বিহারের নির্বাচনের (Bihar Assembly Alection 2025) ফলাফল? হ্যাঁ জাতপাতের রাজনীতি এবং অতি দলিত, যাকে ওখানে বলা হয় অতি পিছড়ে বর্গ বা ই বিসি তাদের ভোটের গুরুত্ব এবারে বিরাট। বিহারের রাজনীতিতে জাতপাত এর সমীকরণ অপরিবর্তনীয় সত্য। এবারের বিধানসভা নির্বাচন যত এগোচ্ছে তত বোঝা যাচ্ছে উন্নয়ন, শিক্ষা বা সুশাসনের এজেন্ডা আবার পিছিয়ে গিয়েছে । এখন দুই প্রধান জোট একমাত্র জাতিভিত্তিক সমীকরণ নিয়ে ব্যস্ত। এই মেরুকরণের খেলায় নির্বাচনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভোটব্যাঙ্ক। এই ভোটব্যাঙ্কটা হলো অতি দলিত বা এক্সট্রিমলি ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস। এই ইবিসি ভোটব্যাঙ্ক ২০২০ সাল পর্যন্ত মূলত মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের (Nitish Kumar) দিকেই ছিল । কিন্তু এখন মহাগটবন্ধন এই ভোটে বড়সড় আঘাত হানতে চাইছে। তারা ক্ষমতায় আসলে মাল্লা সম্প্রদায়ের নেতা মুকেশ সাহনিকে উপ-মুখ্যমন্ত্রী করবে বলে ঘোষণা করেছে। এটা একটা মাস্টার স্ট্রোক। অন্যদিকে, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স তাদের পুরোনো কৌশল ধরে রাখতে চায়। তারা নীতীশ কুমারের জন্য ইবিসিদের, অতি দলিতদের আনুগত্যের ওপরেই ভরসা রাখছে, এমনি এমনিই বিজেপি নিতীশকে সঙ্গে রাখেনি। তারা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তাকেও হাতিয়ার করেছে, কিন্তু একটা চোখ এই ভোট ব্যাঙ্কের দিকেই। আর এই পরিস্থিতিতে প্রশান্ত কিশোরের উন্নয়ন ও সুশাসনের এজেন্ডা ক্রমশ গুরুত্ব হারাচ্ছে। দুই বড় জোটের এই তীব্র জাতিভিত্তিক খেলার মধ্যে পিকে-র জন সুরাজ এখন প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে, এই বাংলাতে দুই প্রতিদ্বন্দীর মাঝখানে বামেদের যে অবস্থা, পিকে খানিক সেই যাঁতাকলে পড়েছেন।

বিহারের নির্বাচনে ফলাফল বুঝতে চান? আগে অতি দলিতদের গুরুত্ব বোঝাটা জরুরি। বিহার সরকারেরই করা জাতি গণনা অনুসারে, এই গোষ্ঠী রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ । হ্যাঁ ৩৬%, যারা ভোটের ফলাফল একদিক থেকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে। এই বিশাল সংখ্যাটা বের হওয়ার পর থেকেই রাজনীতির চেহারাটা পাল্টে গেছে । ইবিসিদেরকে বিহারে ‘অ্যানেক্সার-১’ তালিকার মধ্যে রাখা হয়েছে। মানে, তারা সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে পড়ে । এই তালিকাতে ১১২টা আলাদা আলাদা জাতি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মাল্লা, ধানুক, হাজাম এবং কাহার-এর মতো সম্প্রদায় । মুসলিমদের মধ্যে মোমিন ও রায়েন-এর মতো পসমন্দা মুসলিমরাও এই গোষ্ঠীর অংশ । ইবিসি এবং আদার ব্যাকওয়ার্ড কাস্টস (OBC)-দের যোগ করলে তারা রাজ্যের জনসংখ্যার মোট ৬৩ শতাংশ তৈরি করে । এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও অতি দলিতেরা দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক ছিল। বিধানসভায় তাদের প্রতিনিধিত্ব কখনোই ১০ শতাংশের উপরে ওঠেনি । কিন্তু ২০২৩ সালের জাতি গণনা তাদের জনসংখ্যাকে সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এখন এই গোষ্ঠী স্বাভাবিকভাবেই তাদের জনসংখ্যার অনুপাতে অধিকার চাইছে। তাদের স্লোগান হলো ‘জিতনি আবাদি, উতনা হক’ । আর সেই আকাঙ্ক্ষাকে কাজে লাগাতে দুটো জোটই মরিয়া। মুকেশ সাহনিকে সামনে আনা, মুকেশ সাহনিকে উপ-মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করা মহাগটবন্ধনের এক অত্যন্ত আগ্রাসী কৌশল । সাহনি হলেন বিকাশশীল ইনসান পার্টি (VIP)-র চিফ। তিনি ‘মাল্লার ছেলে’ বা ‘Son of Mallah’ বনে নিজেকে তুলে ধরেন, মাল্লাদের এক বড় অংশ সেকথা বলে । সাহনি নিশাদ মানেমাঝিদের একজন প্রভাবশালী নেতা। এই নিশাদরা ইবিসি গোষ্ঠীর মধ্যেই পড়ে । এই সম্প্রদায় বিহারের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯ শতাংশ । যদিও সাহনি দাবি করেন যে তার সম্প্রদায়ের ২২টা উপ-জাতি মিলিয়ে তারা জনসংখ্যার ১১ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করেন । এই ৯ বা ওনার দাবি মত ১১ শতাংশ ভোট যদি মহাগটবন্ধনের দিকে যায়, তবে তা নির্বাচনের কায়াপলট করে দিতে পারে, পুরো ফলাফলই বদলে যাবে ।

মুকেশ সাহনিকে এত বড় পদ দিয়ে মহাগটবন্ধন ইবিসিদের মধ্যে এক স্পষ্ট বার্তা দেবার চেষ্টা করেছে যে তারা শুধুমাত্র যাদব বা মুসলিমদের দল নয়। তারা ইবিসিদের রাজনৈতিক অংশীদারিত্ব দিতে প্রস্তুত। আসলে এই ঘোষণা ইবিসিদের মধ্যে ক্ষমতার ভাগীদার হওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। আর সেসব আবেগকে আরও খানিক চাগিয়ে দিতেই নির্বাচনের ঠিক আগে রাহুল গান্ধী বেগুসরাইয়ে একতা পুকুরেই নেমে পড়লেন। এক অপটিক্স এর খেলা, তিনি মৎস্যজীবীদের সঙ্গে সরাসরি কথাও বললেন, সঙ্গে ছিলেন মুকেশ সাহনি, কানাহাইয়া কুমার। ার ঝোপ বুঝে কোপ। মহাগটবন্ধন মৎস্যজীবীদের জন্য বিশেষ সুবিধে দেবে বলেও জানালো, মানে প্রতিশ্রুতি দিলো, ঐখানেই দাঁড়িয়ে তারা মাছ চাষের জন্য বীমা এবং মাছ ধরার নিষিদ্ধ সময়ে আর্থিক সহায়তা দেওয়ারও কথা বলেছে । রাহুল গান্ধীর যা করলেন তা সাফ বলে দেয় জাতীয় স্তরের নেতারাও বিহারের আঞ্চলিক জাতিভিত্তিক রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছেন, করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই প্রতীকী সংহতি মহাগটবন্ধনের ইবিসি কৌশলকে আরও মজবুত করেছে বৈকি। রাহুল গান্ধী স্পষ্ট করে দিলেন, এবারের বিহার নির্বাচনে জাতিগত সমীকরণকে আর উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। কাজেই ওধারে এনডিএ ও থেমে নেই মহাগটবন্ধনের ইবিসি ভোট ভাগ করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে এনডিএ দুটো মোদ্দা কৌশল নিয়েছে।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | প্রথম দফার ভোট ৬ নভেম্বর, কী হতে চলেছে বিহারে?

প্রথমত, নীতীশ কুমারকে সামনে রেখে তার পুরোনো ইবিসি আনুগত্য ধরে রাখা। নীতীশ প্রায় দুই দশক ধরে বিহারের ক্ষমতায় আছেন । তিনি বহু বছর ধরে ইবিসিদের জন্য অনেক প্রকল্প চালু করে তাদের সমর্থন পেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষাবৃত্তি, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক এবং যুবকদের জন্য আর্থিক সাহায্য । তার লব-কুশ (কুর্মি-কোয়ারি) ভোট এবং অ-মুসলিম ইবিসিদের সমর্থন মিলিয়ে প্রায় ৩৩ শতাংশের একটি মজবুত ভিত্তি ছিল । দ্বিতীয়ত, বিজেপি ইবিসি নেতা কার্পুরি ঠাকুরের উত্তরাধিকারকে ব্যবহার করছে। কার্পুরি ঠাকুর ইবিসিদের মধ্যে একজন সর্বজনীন আইকন । এসব হিসেব নিকেশ করেই ২০২৪ সালে মোদি সরকার তাকে মরণোত্তর ‘ভারতরত্ন’ প্রদান করেছে ।এটাও এক বিরাট ব্যাপার, একজন ইবিসিকে ভারত রত্ন দেওয়া, যা আগে কংগ্রেস সরকার করেনি, বা জনতা সরকারও করেনি। এছাড়া, নীতীশ সরকার জাতি গণনার ভিত্তিতে সংরক্ষণ বাড়িয়ে ৬৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নিয়েছিল । যদিও পরে সেই সিদ্ধান্ত আদালতে বাতিল হয়েছে । কিন্তু এই পদক্ষেপগুলো ইবিসিদের কাছে এক স্পষ্ট বার্তা দেয় যে এনডিএ তাদের সাংবিধানিক অধিকারের পক্ষে আছে। এনডিএ আরজেডি-কে ‘জঙ্গল রাজ’-এর ভয় দেখিয়ে পুরোনো ইবিসি আনুগত্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে, জঙ্গলরাজ মানে আসলে যাদব দের রাজত্ব, ইবিসিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এক সময়ে আদায় কাঁচকলায় ছিল । আর এই তীব্র জাতিভিত্তিক মেরুকরণের মাঝে উন্নয়ন, শিক্ষা সংস্কার এবং দুর্নীতিমুক্ত সুশাসনের এজেন্ডা নিয়ে আসা প্রশান্ত কিশোর প্রায় বিলীন হয়ে গেছেন, হ্যাঁ সমীক্ষা বলছে তিনি ১/২ খানা আসন পেলেও পেতে পারেন, দুই প্রবল শক্তির এই জাতপাতের লড়াই এর মধ্যে স্যান্ডুইচ হয়ে যাওয়া পিকে যদি শূন্য পায়, তাহলে আমি তো অবাক হবো না। তিনি ‘জন সুরাজ’ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে জাতিপাতের ঊর্ধ্বে উঠে রাজনীতি করার কথা বলছিলেন । কিন্তু সে এজেন্ডা গুরুত্ব হারিয়েছে। তিনি নিজেও এই নির্বাচনে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না বলে ঘোষণা করেছেন ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটা একটা কৌশলগত সিদ্ধান্ত । পিকে বুঝতে পেরেছেন যে যখন দুটো প্রধান জোট ক্ষমতার ভাগ এবং জাতিগত সম্মান নিয়ে সরাসরি দ্বন্দ্বে নেমেছে, তখন তার এজেন্ডা সফল হবে না, তার চেয়ে এন ডি এ হারলে সারা দেশে নতুন ইকুয়েশনে আবার তিনি তাঁর এজেন্ডানিয়ে মাঠে নামতে পারবেন, মানে শত্রু হিসেবে সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী বিজেপির থেকে আরজেডি বাম কংগ্রেসের মুখোমুখি হওয়াটা সহজ বলে তিনি মনে করছেন। পিকে-র দল আগে উপ-নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল কিন্তু কোনও আসনে জেতেনি, কিন্তু ১০% এর কাছাকাছি ভোট পেয়েছিল। সেটা এবারে সারা রাজ্যে বাড়বে বলেই শুরুর দিকে মনে হয়েছিল কিন্তু সেই শতাংশ গড়ে ৩/৪/৫% এর বেশি উঠবেনা বলেই এখন ধারণা। বিহারের ভোটাররা এখনও জাতপাতের ভিত্তিতেই নিজেদের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ করেন, করছেন, করতে চান। ধরুন বেকারত্ব যা এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা বা সুশাসনের মতো ইস্যুগুলো ইবিসিদের রাজনৈতিক অংশীদারিত্বের দাবির কাছে ম্লান হয়ে গেছে। পিকে-র সরে যাওয়া প্রমাণ করে যে বিহারের রাজনীতিতে উন্নয়ন এখনও জাতিসত্তার চেয়ে দুর্বল। এই নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত সেই জোটই জয়ী হবে, যারা জাতপাতের সঠিক বীজগণিতটি মেলাতে পারবে। এবারে সেই বীজগণিতের এক্স ফ্যাক্টর হল ঐ অতি পিছড়ে বর্গ এর ভোট, যাঁরা বিহারের ইতিহাস জানেন তাঁদের কাছ থেকে শুনেছি, বিহারে অতি পিছড়ে বর্গ এর এরকম অনেক গ্রাম ছিল যেখানে বিয়ে করে আনা নববধুকে আগে ভুমিহার রাজপ্পুত জমিদারের কাছারিবাড়িতে পাঠাতে হত, আজ সেই অতি পিছড়েরাই বিহারের নির্ণায়ক শক্তি, এটাও তো কম কথা নয়, বিবেকানন্দ কি এই শুদ্র জাগরণের কথাই বলেছিলেন? তারাই তো সবথেকে গরীব, সর্বহারা, মার্কস তো এঁদের উথ্বানের কথাই বলেছিলেন। যেভাবেই দেখুন না কেন, এবারের বিহারের ভোট এর ফলাফল কেবল ইবিসিদের নির্ণায়ক ভোটেই ঠিক হবে তাই নয়, আগামী দিনে এই শুদ্র জাগরণ এক অন্য ইতিহাসও লিখবে।

Read More

Latest News