এই জুলাই মাসে দুটো সাংঘাতিক বাধা মোদিজিকে পার করতে হবে, দুটোই তাঁর নিজের তৈরি সমস্যা, এবং দু’ জায়গাতেই তিনি ব্যাকফুটে। জি৭-এ ডাক পাচ্ছিলেন না, ভক্তকুলও লিখতে শুরু করেছিল, ভারত কোনও জি৭-এর মুখাপেক্ষী নয়, ভারত নিজের জোরে বিশ্বের পঞ্চম অর্থনীতি, কাজেই জি৭-এ যাওয়ার জন্য লালায়িত নয়। হ্যাঁ, ঠিক এই কথা বিজেপির মুখপাত্র সাংসদ সম্বিত পাত্র বলেছেন, আর তার ঠিক পরেই কানাডার ডাক এসেছে, ডাক আসার ৩৫ মিনিটের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নিজেই সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে ডাক এসেছে। মানে ডাক আসাটা যে খুব গুরুত্বপূর্ণই ছিল, সেটা এখন পরিষ্কার। হ্যাঁ, মোদিজি যেভাবে নিজেকে দেশের মধ্যে এক বিশ্বগুরুর মতো এক উচ্চতায় দাঁড় করিয়েছেন, তার খেসারত দিতে হবে বইকী। যুদ্ধ চলাকালীন, যুদ্ধের আগে বিরাট বিরাট কোটেশন দিয়েছেন, এমনকী অব গোলি খা জাতের ফিল্মি ডায়ালগও শোনা গেছে তাঁর মুখে। কাজেই দেশের মানুষদের মধ্যে এক্সপেকটেশনও বেড়েছিল, বিরাট সেই চাহিদা এক স্বপ্নের জন্ম দিয়েছিল, পাকিস্তান বলে আর কিছুই থাকবে না, মোদিজির বাচ্চা শুভেন্দু অধিকারী বা ওই গোত্রের অনেক নেতাই বলেছেন পাকিস্তান গাজা স্ট্রিপ হয়ে যাবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে গোটা সাতেক জায়গার ধ্বংস ছবি দেখানোর পরেই যুদ্ধ বন্ধ, তাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন মোদিজি? কারণ এই জুলাই মাসেই সংসদের বাদল অধিবেশন।
প্রশ্ন তো উঠবেই, ক’টা রাফাল ভেঙেছে, ক’জন পাইলট নিখোঁজ, এসবের উত্তর তো জানি না বললেই চলবে না, বিরোধীরা চেপে ধরবে আর শরিক দল, সমর্থন দেনেওয়ালা দল জেডিইউ আর তেলুগু দেশম চুপ করে বসে থাকবে। আর দলের হয়ে লড়তে হবে কিন্তু সেই মোদিজিকেই। হ্যাঁ, বহু অপ্রিয় প্রসঙ্গ সামনে এসে দাঁড়াবে। দু’ নম্বর বিপদ হল এই জুলাইতেই ব্রিক্স সম্মেলন। সে আর এক যন্ত্রণা। সেখানে পুতিন যাবেন, যিনি ট্রাম্পকে বলেই দিয়েছেন যুদ্ধ থামবে না, আমি শেষ দেখে ছাড়ব, যাবেন শি জিনপিং, যিনি ট্রাম্পের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়ছেন, থাকবেন আগের বন্ধু বলসেনারো নয়, ব্রাজিলের লুলা দা সিলভা। সব মিলিয়ে এক চরম আমেরিকা বিরোধী আবহে এই ব্রিক্স সম্মেলন বসতে যাচ্ছে। কী আলোচনা হবে? ১) কীভাবে আমেরিকান ট্যারিফ বাণিজ্যের মোকাবিলা করা যায়। ২) কীভাবে তৃতীয় বিশ্বে, মানে আমেরিকা আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পাল্টা আর এক অর্থনৈতিক গোষ্ঠী গড়ে তোলা যায়। ৩) ব্রিক্স-এর আলাদা মুদ্রা চালু করা যায় কি না। এর তিনটেই ট্রাম্পের কাছে আমেরিকার স্বার্থের পরিপন্থী। কাজেই ট্রাম্প সাহেব আগেও হুমকি দিয়েছেন, এই ব্রিকসকে তিনি শেষ করে দেবেন। এটা আর একটু বিশদে বোঝা যাক, ট্রাম্প টু, ট্রাম্প ওয়ান জমানার সঙ্গে বিরাট তফাৎ। ইনি ৫ বছর ধরে ফিরে আসার চেষ্টাই শুধু করেননি, বেশ কিছু বড় জিনিস মাথায় রেখেছিলেন, তারমধ্যে প্রথম হল ওসব দুনিয়াদারি গয়া ভাড় মে, আমার দেশের মানুষ ফার্স্ট প্রায়োরিটি, মার্কিনি বাণিজ্য ফার্স্ট প্রায়োরিটি। এগুলোকে সামনে রেখেই নতুন মার্কিনি ব্যবস্থা তৈরি হবে।
তো ট্রাম্প টু জমানা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা শুরু হয়ে গেছে। সেই পুরনো জমানা শেষ যেখানে দেশে দেশে বিভিন্ন সাহায্য আর সুযোগের বদলে কাঠপুতুল সরকার তৈরি করে এক ইউনি পোলার ওয়ার্ল্ড তৈরির চেষ্টা চলত। সাহায্য আর টাকা দিয়ে লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে পুতুল সরকার বসানোর দায়িত্ব আলাদা মন্ত্রক কাজ করত আমেরিকায়। ইউএস এইড দফতর ছিল তৃতীয় বিশ্বে নজরদারি রাখার জন্য, এখন ট্রাম্প জমানাতে সেসব উঠে যাচ্ছে। বলতেই পারেন তাহলে সে তো ভালোই, অন্য দেশে নাক না গলিয়ে নিজের দেশের বাণিজ্যের কথা ভাবা তো ভুল নয়। না, এখানে দুটো বিষয় আছে, ট্রাম্প সাহেবের মনে ধরেছে চীনা মডেল, চীন যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তাকে দ্বিতীয় চয়েজ, দু’ নম্বর অপশন হিসেবে রাখছে, প্রথম অপশন হল দেশে দেশে এমন এক বাণিজ্য শুরু করা যাতে সেই দেশের অর্থনীতি চীনের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, আপনার মাথায় ঝট করে আসবে নেপাল, পাকিস্তান, মালদ্বীপ বা শ্রীলঙ্কার কথা। অবশ্যই, কিন্তু মাথায় রাখুন এই মুহূর্তে চীনের কাছে গচ্ছিত আমেরিকান পেপার মানি, টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিপত্র যা পড়ে আছে তা চীন দাবি করলে এমনকী আমেরিকার ডলার ধসে পড়বে। ওদিকে নিজের দেশেও এক ধরনের মন্দার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে আমেরিকা। তাই পুরনো রাস্তা ছেড়ে ট্রাম্প সাহেব এবারে বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীকেই আদর্শ বলে মনে করে তাঁরা যাবতীয় পুরনো নীতি আদর্শ ইত্যাদি ফেলে এক নতুন আমেরিকা হয়ে উঠছে। যেখানে তার বাণিজ্যের প্রয়োজনে ফরেন করাপ্ট প্রাকটিসেস অ্যাক্টকে বাতিলের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আপাতত তা স্থগিত করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদিজির রাজত্বে গরিবরা হঠাৎ বড়লোক হয়ে যাচ্ছেন
মানবাধিকার সংস্থা থেকে আমেরিকা বেরিয়ে এসেছে, ওসব ফালতু ব্যাপারে খরচ করার প্রয়োজনীয়তা সে দেখছে না। সে ইউক্রেনকে অস্ত্র সাহায্য সব দিতে রাজি আছে যদি ইউক্রেন তাদের বিরাট বহুমূল্য খনিজ ভান্ডার আমেরিকার হাতে তুলে দেয়, একই সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গেও আমেরিকা সম্পর্ক ভালো রেখেই ফার ইস্টে ব্যবসার প্রসার ঘটাতে চায়, চীনের শি জিনপিং নাকি তাঁর পুরনো বন্ধু, চীনকে সামলাতে ভারতকে সাহায্যের বদলে চীনের সঙ্গেই বাণিজ্য সম্পর্ক ভালো করার দিকে এগোচ্ছে আমেরিকা। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন থেকে সরে আসছে আমেরিকা, ওসব চ্যারিটি করার দায় তারা আর নেবে না, তাছাড়া সেই সংস্থা নাকি চীনেরই স্বার্থ দেখে। এবং এসবের মাঝখানে এই যে ভারতকে চমকানো, হাতকড়া পরিয়ে অবৈধ নাগরিকদের যুদ্ধ বিমানে ফেরত পাঠানো, বাণিজ্য শুল্ক বাড়িয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে বিরাট ধাক্কা দেওয়া, সবটাই হল ব্রিক্স থেকে সরে আসুন, ব্রিক্স চলবে না, ডলারের ক্ষতি করতে পারে এমন কোনও সংগঠনকে ট্রাম্প টিকতে দেবে না। খেয়াল করে দেখুন ব্রাজিল বা ভারত, ব্রিক্স-এর অন্যতম দেশ, ব্রিক্স নিয়ে আর একটা কথাও বলছে না।
ঠিক এই প্রেক্ষিতে ওই ওভাল অফিসে জেলেনস্কি আর ট্রাম্প, জেডি ভান্স-এর আলোচনাকে আলোচনা করলে সবটা পরিষ্কার হবে। ইউক্রেনের রাশিয়া বিরোধিতা আজকের নয়, সে ন্যাটোভুক্ত দেশ হতে চায়, সেটাও নতুন কিছু নয় কিন্তু এই জেলেনস্কি এক যুদ্ধে প্রায় বিদ্ধস্ত দেশের নেতা হলেও শিরদাঁড়ার জোর আছে, জোর আছে বলেই তিনি একটা কথাই জোর দিয়ে বলতে চাইছেন, ইউক্রেন ন্যাটোতে যাবে কি না, সেটা অন্য কোনও দেশের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে না। দুই, রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির এক পাকাপোক্ত গ্যারান্টি দরকার কারণ রাশিয়া এর আগে চুক্তির পরেও একতরফা যুদ্ধ শুরু করেছে। ইউক্রেন তার খনিজ ভান্ডার মার্কিনিদের হাতে তুলে দিতে রাজি কিন্তু তার এই দুটো শর্ত সে সমানে বলে যাচ্ছে, বলে যাবে। সমস্যা হল ট্রাম্পও জানে পাকাপোক্তভাবে ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত দেশ হিসেবে দেখতে চায় না রাশিয়া, আর একবার সেই জায়গা ইউক্রেন পেলে এরপরে তার সঙ্গে যে কোনও সামরিক বা অসামরিক সংঘাতের ক্ষেত্রে ন্যাটো মাঝখানে এসে পড়বে। কাজেই তারা মুখে চুক্তি চাই বা শান্তি চাই বললেও আসলে চুক্তিও চায় না, শান্তিও চায় না। সেটাই দেখাতে বসেছিল সেই আলোচনার নৌটঙ্কি।
ট্রাম্প সাহেব যতই নিজেকে বাণিজ্যমুখী করে তুলুন না কেন, বিশ্বের ছোট বড় দেশ মিলে যে কোনও মুহূর্তে এক বিরাট জোটের সূচনা করতেই পারে যা আগামী দিনে আমেরিকার কাছে এক বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি করতে পারে, কাজেই সমস্ত ডিপ্লোম্যাটিক, কূটনৈতিক রাজনৈতিক জোট ছেড়ে কেবল বাণিজ্য নিয়ে এগোতে থাকা ট্রাম্প সাহেব ক’দিনের মধ্যেই বুঝতে পারবেন কত বড় গাড্ডায় তিনি পড়বেন। সবথেকে বড় কথা হল চীন কী চাইছে? একটা সময়ে বিশ্বের যাবতীয় দ্বন্দ্ব ছিল সমাজতান্ত্রিক শিবির আর তথাকথিত আমেরিকান ইউরোপিয়ান পুঁজিবাদী শিবিরের লড়াই। সোভিয়েত ভাঙার পরে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর পতনের পরে হঠাৎই বিশ্বের দ্বন্দ্ব মুসলিম মৌলবাদ আর বাকি দুনিয়ার মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল। আজ বিশ্বের দ্বন্দ্বে একধারে রয়েছে চীন, তার সহযোগী কিছু দেশ, সেই দ্বন্দ্বকে উপেক্ষা করে ট্রাম্প টু জমানাতে ট্রাম্প সাহেব এক পাড়ার মাস্তানের ভূমিকায় নেমেছেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হুমকি দিয়ে এক নতুন ওয়ার্ল্ড অর্ডার তৈরি করতে চাইছেন, কিন্তু তা এত সহজ হবে না। সেই ওয়ার্ল্ড অর্ডারের বিরুদ্ধেই নেমেছে চীন, রাশিয়া, লাতিন আমেরিকার দেশগুলো, ব্রাজিল বা কলম্বিয়া। কাজেই এবারের ব্রিক্স সম্মেলন হয়ে উঠবে ট্রাম্প সাহেবের এই সর্বগ্রাসী বাণিজ্য নীতির বিরুদ্ধে এক জোরালো প্ল্যাটফর্ম। আর সেটা হলে, সেই প্ল্যাটফর্মে বসে ল্যাজ নাড়ালে আমেরিকায় আদানির মামলা নতুন করে উঠবে না তো? সংসদে উনি চুপ করে থাকলে ওনার প্রেস্টিজ পাংচার, কথা বললে ট্রাম্প সাহেবে রেগে যাবেন। জুলাই মাসে রাস্তা বড্ড পিছল, পিছলে পড়লে মোদিজি উঠতে পারবেন না।