বিহারে আপাতত দুটো স্লোগান – (১) ভোট চোর গদ্দি ছোড় (২) ঘুসপেটিয়া। ‘ভোট চোর গদ্দি ছোড়’ স্লোগান নিয়ে মহাগঠবন্ধন গোটা বিহারে পদযাত্রা করেছে, রাহুল গান্ধী, তেজস্বী যাদব। বিহারের এবারের নির্বাচনে এই স্পেশ্যাল ইনটেন্সিভ রিভিশন বা এসআইআর কিন্তু একটা বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে। কাদের কাছে? মূলত সংখ্যালঘু মুসলমানদের কাছে, যারা বিহারের ২৪৩টা আসনের প্রায় ৩৮টাতে ডিসিসিভ বা নির্ণায়ক ভূমিকায় আছে। আর এই ইস্যুতে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে অতি পিছড়ে বর্গ বা দলিতরা। কিন্তু তাঁরা তাঁদের জাতের নেতাদের, মানে চিরাগ পাসোয়ান বা জিতন রাম মাঞ্ঝির বিরুদ্ধে গিয়ে কি ভোট করবেন? অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বা অমিত শাহ জনসভায় গিয়ে এই ‘ঘুসপেটিয়া’র কথা বলেছেন, ব্রাহ্মণ, রাজপুত কায়স্থদের উপরে তার তো প্রভাব পড়বেই। তবে সেই ঘুসপেটিয়ার প্রমাণ হিসেবে খুব শক্ত পোক্ত কোনও প্রমাণ এখনও সামনে নেই, কিন্তু ভোট চুরি, নাম কেটে দেওয়ার অসংখ্য ঘটনা সামনে এসেছে। কাজেই দুটো ইস্যুর লড়াই- একদিকে ভোট চুরি, ‘ভোট চোর গদ্দি ছোড়’ স্লোগানে কাঁপছে মাঠ ময়দান; অন্যদিকে ‘ঘুসপেটিয়া’। এই ‘ঘুসপেটিয়া’ স্লোগান সম্ভবত ব্যুমেরাং হতে চলেছে। দুটো কারণে। প্রথমত, এই স্লোগানের তীব্রতর হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান ভোটও এক জায়গাতেই পড়ার সম্ভাবনা বাড়বে, এক বিরাট ভোট বিভাজনের কোনও প্রশ্নই থাকবে না। দ্বিতীয়ত, এই স্লোগানে ভয় পেয়েছেন দলিতরাও, তাঁদেরও কোথাও মনে হয়েছে যে, এই ‘ঘুসপেটিয়া’ অভিযানের নামে তাঁদের নাম কাটা হচ্ছে, তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। এর পরেই আছে দুপক্ষের রেওড়ি বিতরণ। মহিলাদের টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। যে মোদিজি কদিন আগেই বিরোধী দলগুলো ‘রেওড়ি বাঁট রহা হ্যায়’ বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন, সেই মোদিজিই এখন মহিলাদের ১০ হাজার টাকা দেওয়া হবে বলে নিজেই জানাচ্ছেন। মজার কথা হল, অতি পিছড়ে জাতির মহিলাদের ২ লক্ষ করে টাকা দেওয়া হবে বলে নীতীশ কুমার জানিয়েছিলেন তাও আবার বিধানসভাতেই। সেই টাকা কিন্তু পৌঁছয়নি, আবার নতুন প্রতিশ্রুতি এসেছে, কাজেই টাকা দেওয়ার কথা তো বলছেন। দেবেন তো? পাবো তো? এই প্রশ্নও উঠছে। দিল্লির প্রতিশ্রুতি কিন্তু এখনও পালন করা হয়নি, বিরোধীরা সেই কথাও বলছেন। আবার সেই বাজারে মারকাটারি অফার নিয়ে হাজির তেজস্বী যাদব। বেকারত্বের হিসেবে সবথেকে উপরে থাকা বিহারে তিনি ঘোষণা করেছেন, মহাগঠবন্ধন ক্ষমতায় এলে প্রতিটা পরিবারে একজন করে চাকরি পাবে। এখন দেখার কার রেওড়ি মানুষ বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করেন।
তবে এটাও ঘটনা যে, কতটা নির্লজ্জ এই নির্বাচন কমিশন, তা আজ সবার সামনে। মাত্র এক বছর আগে ২০২৪-এর বিহারের লোকসভা নির্বাচন হয়েছিল সাত দফায়। সবকটা দফার প্রচারে আমাদের ফেকুজি হাজির থাকতে পারেন, কেবল সেই জন্যই। এবারে বিধানসভা নির্বাচন, আরও অনেক বেশি আসন, জটিলতাও কম নয়, কিন্তু দু’দফাতেই শেষ হবে নির্বাচন। তার কারণ কী? কারণ হল, প্রচারের মুখ। এনডিএ জোটকে জেতানোর দায় কিন্তু মোদিজির, ওদিকে মুখ্যমন্ত্রী পদে আছেন নীতীশ কুমার, বিজেপিতে দলের মধ্যেই এ নিয়ে যথেষ্ট অসন্তোষ আছে। আবার বিহারে মোদিজির মুখ কাজ করেছে প্রতিবার লোকসভার ভোটে, বিধানসভার ভোটে মোদিজি প্রতিবার ব্যর্থ। এদিকে নীতীশ কুমারের শরীর দিচ্ছে না, তিনি ২৪৩ তো ছেড়েই দিন গোটা ৪০ বিধানসভাতেও যেতে পারবেন কি? ওদিকে বিহার বিজেপির সম্রাট চৌধুরী বা দিলীপ জয়সওয়ালকে সারা বিহারের লোকজন জানেই না। অন্যদিকে নিজেদের বেল্ট এ দিপঙ্কর ভট্টাচার্যের প্রভাব আছে, রাহুল প্রিয়ঙ্কার প্রভাব আছে, তেজস্বীর বিরাট জনপ্রিয়তা। সব মিলিয়ে মহাগঠবন্ধনে প্রচারের মুখ অনেকে আবার মুখ্যমন্ত্রী মুখ নিয়েও কোনও ঝামেলা নেই। কাজেই বিরোধীদের হইহই করে প্রচারে নামার দিনগুলো কমানোর জন্যই এবারে দুদফায় বিহারের ভোট হবে। কিন্তু এখনই বলে দিচ্ছি মিলিয়ে নেবেন, এর পরেই এই বাংলার নির্বাচন, তখন আবার সেই সাত দফাতেই হবে। কারণ প্রতিটা দফায় মোদিজিকে এসে ভোট বাড়ানোর ডাক দিতে হবে।
তো যাই হোক আপাতত দিন ঘোষণা হয়ে গিয়েছে, ৬ আর ১১ নভেম্বর নির্বাচন আর ১৪ তারিখে রেজাল্ট আউট। গতবারের অবস্থাটা একটু মনে করিয়ে দিই। বিজেপি এ যাবত সময়ের মধ্যে সবথেকে বেশি ভোট পেয়েছিল, ১৯.৪৬ শতাংশ, ৭৪টা আসন। হ্যাঁ, সারা উত্তর ভারতে এক বিরাট শক্তি হলেও বিজেপি বিহারে খুব বড় শক্তি এখনও নয়। লালু প্রসাদের আরজেডি পেয়েছিল ২৩.১১ শতাংশ, ৭৫টা আসন। নীতীশ কুমারের দল ১৫.৩৯ শতাংশ ভোট আর ৪৩ টা আসন পেয়েছিল, কংগ্রেস অনেকদিন পরে খানিক ভোট বাড়ালেও ৯.৪৮ শতাংশ ভোট আর মাত্র ১৯টা আসন পেয়েছিল। বামেরা ৪.৬৪ শতাংশ ভোট আর ১৬টা আসন পেয়েছিল, যার মধ্যে সিংহভাগ ছিল সিপিআইএমএল লিবারেশনের। এনডিএ-র বিকাশশীল পার্টি আর হিন্দুস্থানী আওয়াম মোর্চা ৪টে করে আসন পেয়েছিল বলেই কোনও রকমে নীতীশ-বিজেপির মন্ত্রীসভা হয়েছিল, তারপর পালটি, আবার পালটি। এবং এবারে ভোট। এবারেও মহাগঠবন্ধন আছে, যদিও আসন নিয়ে খানিক আকচা-আকচি চলছে, তবুও নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, আরজেডি, কংগ্রেস আর বামেদের ঐক্য ভাঙবে না। দু’একটা আসনে অন্য ছবি দেখা গেলেও আবার অন্য ধারে এবারে এনডিএ-র শরিক হিসেবে রামবিলাশ পাসোয়ানের ছেলে চিরাগ পাসোয়ান বাবার দল লোকজনশক্তি পার্টি নিয়ে বড় করে নামতে চাইছেন। বিহারের দিকে তাঁর আলাদা নজর আছে। বাবা ছিলেন হাওয়া মোরগ কিন্তু পাক্কা বিহারী, ইনি কিন্তু অনেক পলিশড, অনেক বেশি দুরদর্শী। তো এবারে উনি জানিয়েছেন কম করেও ৪০টা আসন চাই। আসবে কোত্থেকে? ২০টাই বা আসবে কোত্থেকে? চিরাগ পাসোয়ানের একতা হাত কিন্তু বাড়ানো আছে প্রশান্ত কিশোরের জন সুরাজের দিকে। কিন্তু এনডিএ-র মাথা বা বিজেপির নেতারা জানেন যে, চিরাগ পাসোয়ান সরে যাওয়া মানে নিশ্চিত হার, ভোটের আগেই খেলা শেষ। কাজেই ওনারাও সমাধান সূত্র বার করার চেষ্টায় আছেন। বিহারে বিধান পরিষদ আছে, সেখানে গ্যারান্টেড আসন দেওয়ার কথা বলে ম্যানেজ করার চেষ্টা চলছে বলে খবর পেলাম। আসাউদ্দিন ওয়েইসি সেই অপারেশন সিঁদুরের পর থেকেই ইন্ডিয়া জোটে ঢোকার কথা ভাবছিলেন, যদিও কংগ্রেস তাতে রাজি নয়। এবারে বিহারের মহাগঠবন্ধনেও যোগ দেওয়ার প্রোপজাল উনি নিজেই দিয়েছেন যা ফিরিয়ে দিয়েছেন এমনকি তেজস্বী যাদব, আসাউদ্দিন ওয়েইসি বলেছেন এর মূল্য চোকাতে হবে আরজেডি-কে। মানে উনি নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করতে চান। গতবারও খুব সুবিধে হয়নি, এবারেও হবে না। কিন্তু খেলা জমেছে প্রশান্ত কিশোরের জন সুরাজের জন্য। তিনিই প্রথম খিলাড়ি, যাঁর দল প্রথম দফায় ৫৭ জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে দিয়েছে। বছর তিন আগে ২০২২-এ যখন উনি মাঠে নামেন, তখন মনে হয়েছিল এক হুজুগ তৈরির চেষ্টা, কিছুদিন পরে মনে হয়েছিল একজন গান্ধিবাদী আইডিয়ালিস্টের ব্যর্থ চেষ্টা। তারও কিছুদিন পরে ২০২৪-এর ২ অক্টোবর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবেই দল তৈরি করলেন, ঘোষণা করলেন বিধানসভাতে নামবেন, তখন অনেকেরই মনে হয়েছিল তিনি বিজেপিকে সুবিধে করে দিতেই মাঠে নামছেন, বিজেপি বিরোধী ভোট ২ শতাংশ কেটে নিলেও মুখ থুবড়ে পড়বে মহাগঠবন্ধন। এবং মাস ছয়েক আগে এমনকি মহাগটবন্ধনেও আলোচনা শুরু হয়েছিল, পিকের কাছে কিছু প্রস্তাবও গিয়েছিল, মনেই হচ্ছিল যে, জন সুরাজ দল এক স্পয়লারের কাজ করবে, এসট্যাবলিশমেন্ট বিরোধী ভোটের এক বড় অংশ কেটে নিয়ে বিজেপিকে বা এনডিএ-কে ড্যাং-ড্যাং করে জিতিয়েই দেবে। কিন্তু মাস চারেক পরে দেশের রাজনৈতিক পন্ডিতরা বলতে শুরু করলেন, না, জন সুরাজ দুই জোটেরই ভোট কাটছে, ভালো রকম কাটছে। এবং মাত্র সপ্তাহ খানেক আগের সমস্ত প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত সমীক্ষা বলছে, জন সুরাজ কিন্তু মূলত নীতীশের ভোট কাটছে, কিছুটা বিজেপির ভোটও কাটছে, মানে আপাতত যা মনে হচ্ছে তাতে জন সুরাজ এনডিএ জোটের বেশ কিছুটা ভোট কাটবে, সেটা ৪ থেকে ৫ শতাংশও হতে পারে। অন্যদিকে নীতীশ কুমারের দল জেডিইউ-র কর্মীদের মাঠে ঘাটে দেখাই যাচ্ছে না। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এমনও নয় যে, জন সুরাজের ভোট কাটার ফ্লেই মহাগঠবন্ধন নিশ্চিত জিতে যাবে, এমন কোনও সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে। কিন্তু এই জন সুরাজের মাঠে নামার ফলে নির্বাচন জমে ক্ষীর।
মাথায় রাখুন দেশের রাজনীতিতে বিহারের ২০২৬-এর নির্বাচন এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এই নির্বাচন আগামী দিনের ভারতের রাজনীতিকে যেকোনও দিকে নিয়ে যেতে পারে। ধরুন গতবারের কাছাকাছি একটা ফলাফল হল, পিকের জন সুরাজ ১ থেকে ২ আসন, মহাগঠবন্ধন হাফ মার্কের সামান্য আগেই আটকে গেল, এনডিএ জোড়াতালি দিয়ে সরকার তৈরি করল – সেক্ষেত্রে ঐ জন সুরাজ বা অন্যান্য ছোট দলের এমএলএ-রা ঝাঁপাবেন বিজেপির দিকে, পিকে হতাশ হবেন দলের অবস্থা দেখে। বিজেপি নতুন উদ্যমে নামবে বাংলা, তামিলনাড়ু আর কেরালার নির্বাচন নিয়ে। কিন্তু যদি বিহারে এনডিএ জোট হারে, তাহলে ঐ নীতীশ কুমারের বাকি কমান্ডারেরা কেউ আরজেডি, কেউ বিজেপিতে যাবে, কংগ্রেস উজ্জিবিত হবে, বিজেপি পরের নির্বাচনগুলোতে নামার আগেই পিছিয়ে পড়বে। হ্যাঁ, বিহারের নির্বাচনের জয় পরাজয় পরের তিনটে রাজ্যের নির্বাচনকে সরাসরি কোনও না কোনওভাবে প্রভাবিত করবেই। আর পরপর এই চারটে নির্বাচনে বিজেপি হেরে গেলে তার প্রভাব আগামী সবকটা নির্বাচনেই দেখতে পাব, সংসদে দেখতে পাব, রাস্তায় দেখতে পাব।
কিন্তু আলোচনা শেষ করব ‘এক্স ফ্যাক্টর’ পিকে-কে নিয়ে। বিহারের রাজনীতিতে প্রশান্ত কিশোর কিন্তু বড় রকমের এক পরিবর্তন আনতে চলেছেন। জানি না এবারেই সেই চমক দেখা যাবে কী না। না দেখা গেলেও প্রশান্ত কিশোর যদি ১০ থেকে ১২ শতাংশ ভোট পেয়ে যান, যদি ১৬ থেকে ১৮ থেকে ২০টা আসন পেয়ে যান, তাহলে তিনিই হবেন ‘কিং মেকার’। হ্যাঁ, অনেক কিছুই হতে পারে। আগে প্রশান্ত কিশোর কোনও ফ্যাক্টরই ছিল না, কিন্তু আজ এই মুহুর্তে তাঁকে বাদ দিয়ে বিহারের রাজনীতি চলবে না। সব মিলিয়ে পিকে-র জন সুরাজ না থাকলে বলেই দিতে পারতাম যে, মহাগঠবন্ধন জিতে নেবে বিহার। কিন্তু ঐ ‘পিকে ফ্যাক্টর’ এসে খেলাটাকে কোন পথে আসলে নিয়ে যাবে, ভোটের পর তাঁদের স্ট্রাটেজি কী হবে সেটা এখনই বলা মুশকিল। কিন্তু এটা তো অনায়াসেই বলা যায়, ১৪ নভেম্বর রেজাল্ট বেরোলেই জয় পরাজয়ের হিসেব হয়তো হবে না, ফলাফলের পরের হিসেব নিকেশে তৈরি হবে বিহারের আগামী সরকার আর পিকে-র কথা মেনেই। বলছি, সেই সরকারের মাথায় যেই বসুক, নীতীশ কুমার কিন্তু বসছেন না। হ্যাঁ, বিহার বিধানসভা নির্বাচনের পরে কমবেশি একটানা বিভিন্ন দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ২০ বছরের মুখ্যমন্ত্রী এবারে আর ফিরে আসবেন না।