লন্ডন : শরৎ মানেই বাঙালির হৃদয়ে অনন্য আবেগ। ধূপ ধোঁয়া, ঢাকের তাল আর কাশফুলের সাদা ঢেউ—সবকিছু মিলে শরৎ কলকাতার অলিগলি থেকে শুরু করে মফস্বলের বারোয়ারিতে উৎসবের ছটা বয়ে নিয়ে বেড়ায় বারংবার। সেই আবেগ বাংলা গন্ডি ছেড়ে গিয়েছে বিদেশে। হাজার মাইল দূরে, প্রতিবছর টেমসের তীরে, লন্ডনের বুকে একই উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠেন একদল মানুষ। আর তারই উজ্জ্বল প্রমাণ হলো Bengali Cultural & Social Club-এর দুর্গাপুজো—যা আজ লন্ডনের বাঙালি সমাজে এক ঐতিহ্যের ধারক।এবছর স্বামী নারায়ণ স্পোর্টস ওয়ার্ড এ আগামী ২৭ থেকে ২ রা অক্টবর পর্যন্ত পুজোর অনুষ্ঠান চলবে।
আরও পড়ুন:হ্যারোর ‘পঞ্চমুখী’র প্রাণকেন্দ্র নিঃসন্দেহে দুর্গোৎসব
শুরুটা ২০০০ সালে। আটজন সংস্কৃতিপ্রেমী ডাক্তার—ড. চিত্ত চৌধুরী, ড. অরুন সরকার, ড. ভির নেভরাজানি ও মিসেস জয়ন্তী নেভরাজানি, মি. নির্মল লালা, ড. দাস, গৌতম চৌধুরী, ড. সুনীল গাঙ্গুলি এবং ড. সুবোধ চ্যাটার্জি—একসাথে বসে ঠিক করেছিলেন, নিজেদের হাতে দুর্গাপুজো শুরু করবেন, মূলত ডক্টর দের পুজো বলেই পরিচিতি পায় এই পুজো। কলকাতার আলোর ঝলকানি, ধুনুচির ধোঁয়া, ভোগের সুগন্ধ আর একসাথে মিলেমিশে থাকার আনন্দ সবকিছুরই প্রাণ রয়েছে। তারা লন্ডনের মাটিতে পুনর্গঠন করতে চেয়েছিলেন।
সেদিনের সেই সিদ্ধান্তে জন্ম নিয়েছিল দুর্গাপুজো। আজ ২৬ শরৎ পেরিয়ে গেল নিমেষে। ফিরে তাকালে বোঝা যায়, কতখানি আন্তরিকতা আর ভালোবাসা নিয়ে শুরু করেছিলেন তারা।
শুরুতে সেক্রেটারির দায়িত্ব সামলেছিলেন ড. অরুন সরকার। চিকিৎসার ব্যস্ততা সামলে তিনি দিন-রাত কাজ করেছেন পূজোর প্রতিটি খুঁটিনাটি নিয়ে—মণ্ডপের সাজ, ভোগের আয়োজন, ঢাকের বন্দোবস্ত, অতিথি আপ্যায়ন। ধীরে ধীরে মানুষের ভালোবাসা ও অংশগ্রহণে বড় হতে থাকে Bengali Cultural & Social Club-এর পূজা যা, আজ এটি লন্ডনের অন্যতম জনপ্রিয় দুর্গাপুজো, যেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমায়। কলকাতার গলিপথে যেমন মানুষ ভিড় করে কুমোরটুলির প্রতিমা দেখতে, তেমনি এখানে ভিড় জমে প্রবাসী বাঙালির টানে।
বর্তমান সভাপতি চিত্ত চৌধুরী গর্বের সঙ্গে বলেন,“আমাদের পুজো শুধু দেবীর আরাধনা নয়, আমাদের একসাথে থাকার শক্তি। পেশায় আমরা সবাই আলাদা—কেউ ডাক্তার, কেউ শিক্ষক, কেউ ব্যবসায়ী—কিন্তু দুর্গাপুজো আমাদের একসূত্রে বেঁধে রেখেছে।” এই কথাতেই স্পষ্ট, পূজো এখানে কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং এক সামাজিক সেতুবন্ধন, যা মানুষের ভিন্ন ভিন্ন জীবনকে একই আবেগে যুক্ত।
প্রতিবারই মণ্ডপ সাজানো হয় কলকাতার স্মৃতিকে সামনে রেখে। অঞ্জলি, সিঁদুরখেলা, ধুনুচি নাচ, সঙ্গীত, আবৃত্তি আর খাবারের আয়োজন—সবই যেন মনে করিয়ে দেয় ঘরের দেশকে। লন্ডনের আকাশে বাজতে থাকে ঢাকের আওয়াজ, ভেসে আসে খিচুড়ি-লাবড়ার ঘ্রাণ, আর মানুষ ভুলে যান যে তারা হাজার মাইল দূরে।
শিশুরা শিখছে নিজেদের ঐতিহ্যের গল্প, তরুণরা খুঁজে পাচ্ছে উৎসবের আনন্দ, আর প্রবীণরা খুঁজে পান স্মৃতির কলকাতা। এ যেন লন্ডনের বুকেই এক টুকরো বাঙালি পাড়া। এই পূজোয় শুধু বাঙালিরাই অংশ নেন না। ভারতীয় উপমহাদেশের নানা প্রান্তের মানুষ, এমনকি লন্ডনের অনেক ব্রিটিশও আসেন উৎসব উপভোগ করতে। ফলে এটি পরিণত হয়েছে এক বহুসাংস্কৃতিক মিলনমেলায়। দুর্গাপুজো তাই কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং আনন্দ আর সৌহার্দ্যের সার্বজনীন প্রতীক।
২৬ বছরের পথচলায় এই দুর্গাপুজো গড়ে তুলেছে এক নিজস্ব ইতিহাস। ডাক্তারদের হাতে শুরু হওয়া এই যাত্রা আজ প্রবাসী বাঙালির কাছে হয়ে উঠেছে পরিচয়ের অংশ। এটি নতুন প্রজন্মকে শিকড়ের গল্প শোনায়, শেখায় মিলেমিশে থাকার পাঠ।
লন্ডনের মাটিতে এই পূজো তাই কেবল একটি আচার নয়—এ এক আবেগ, এক বন্ধন, এক উত্তরাধিকার। প্রতিটি ঢাকের তাল, প্রতিটি ধুনুচির ধোঁয়া মনে করিয়ে দেয়—যেখানেই বাঙালি আছে, সেখানেই শরৎ ফিরে আসে কলকাতার রঙে।