বাংলায় একটা প্রবাদ আছে – ‘বুনো ওল বনাম বাঘা তেঁতুল’। বিজেপি আর নীতীশ কুমারের সম্পর্কটা কিন্তু অনেকটা সেরকমই। নীতীশ কুমার হলেন তেমন একজন রাজনীতিবিদ, যাঁকে স্রেফ এক গ্লাস জল দিয়ে গিলে ফেলতে বিজেপির একটি অসুবিধা হবে। কিন্তু গিলে ফেলা, এটাই তো বিজেপির নীতি। সেই সেই খেলাই বিজেপি দেখিয়েছে মহারাষ্ট্রে, দেখিয়েছে উত্তরপ্রদেশে। বেশি কী আর বলব, নর্থ-ইস্টে একাধিক রাজনৈতিক দল জোট বেঁধেছে শুধুমাত্র বিজেপির এই থাবা থেকে বাঁচবে বলে। নর্থ-ইস্টের এইসব দল, এরাই কিন্তু একসময় এনডিএ-র শরিক ছিল। অর্থাৎ, বিজেপির পার্টনার। কিন্তু নীতীশ কুমার, তাঁর কথা একটু আলাদা। বেশিদূর যাওয়ার দরকার নেই। আপনি যদি গুগলে নীতীশ কুমার ও বিজেপির সম্পর্ক নিয়ে টাইপ করেন তাহলে দেখতে পাবেন, প্রথম লাইনটাই হল, নীতীশ কুমার আর বিজেপির সম্পর্ক দীর্ঘ ও জটিল। এই দীর্ঘ জটিল সম্পর্কের মধ্যে কাছে আসা আছে, হাত মেলানো আছে, আবার বিচ্ছেদ আছে, দূরে সরে যাওয়া আছে। কিন্তু এর কোনওটাই প্রেমিক-প্রেমিকার মতো নয়। রাজনীতির অঙ্কের চুলচেরা হিসেবে তৈরি হয়েছে এই সমীকরণ। বলব সেই কথা। তার আগে একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি।
‘মাৎসন্যায়’ – এই কথাটা কিন্তু রাষ্ট্র আর রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা পরিচিত শব্দ। এর আগে মধ্যযুগের ভারতে এই মাৎসন্যায়ের ব্যবহার বারবার দেখা গিয়েছে। মৎস্যন্যায় কথাটার অর্থ তো আমরা সকলেই জানি – বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে গিলে খায়, ঠিক তেমনই বড় রাজারা ছোট রাজাদের রাজত্ব আত্মসাৎ করতেন। আধুনিক সময়ে কোনও রাজা নেই, কিন্তু পলিটিকাল দলগুলো আছে। আর আছে মূল কথাটা, তা হল – ক্ষমতার দখল। বিজেপি কিন্তু এই মাৎসন্যায়ের ব্যবহারে খুবই পটু। ক্ষমতা দখলের দরকারে তারা দল পাকায়, তৈরি করে এনডিএ জোট, আর তারপর ছোট দলগুলোকে এমনভাবে গিলে নেয় যে, তাদের আর কোনও ক্ষমতাই থাকে না, কোনও স্বরই থাকে না। কিন্তু বহুস্বর না হলে গণতন্ত্র টিকবে কীভাবে? বিজেপি সেসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। মধ্যযুগীয় স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে চায় তারা। তাদের একটাই লক্ষ্য – ক্ষমতা দখল। আর তাই এই মাৎসন্যায়। এবার তার দু-একটা উদাহরণ পেশ করছি।
মহারাষ্ট্র দিয়েই শুরু করা যাক। খবরটা ছিল এরকম – মহারাষ্ট্রে শাসক জোটেই জটিলতা দেখা দিয়েছে। শিন্ডেপন্থী শিবসেনার ঘর ভাঙতে বিজেপি তৎপর। আর তাতেই শাসক জোটে ফাটল ক্রমেই চওড়া হচ্ছে। মুখে জোটের কথা বললেও, কাজে সেটা মানতে বিজেপির আপত্তি আছে। এমনই দাবি করেছেব রাজ্যের উপ-মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডে। খালি তাই নয়, নিজের অসন্তোষের কথা জানিয়ে সতর্ক করেছেন বিজেপি নেতৃত্বকে। বছর দুয়েক আগে মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে ব্যপক সাফল্য পেলেও, এনডিএ-র অন্দরে শরিকি বিরোধ কিন্তু ইদানিং মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছিল। পুরসভার আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে উপ-মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডের শিবসেনার সঙ্গে বিজেপির বিরোধ এখন খোলাখুলিই চোখে পড়ছে। স্বভাবতই, মহারাষ্ট্রের শাসক জোটে বিজেপির সঙ্গে শিন্ডেপন্থী শিবসেনার ক্রমবর্ধমান দূরত্ব রাজ্য রাজনীতিতে চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। সোজা কথায়, গোলমাল এমন জায়গায় পৌঁছিয়েছে যে, ফড়নবিশ-শিন্ডে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হওয়ার যোগাড়। মহারাষ্ট্রের বিজেপি তার জোট সঙ্গী শিবসেনাকে গিলে খাওয়ার চেষ্টা করছে। পারবে কি? সে প্রশ্নের উত্তর সময় দেবে। কিন্তু নর্থ-ইস্টের ছবিটা একটু অন্যরকম। কী হয়েছে সেখানে? বেশ শুনুন তবে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | রাজা তোর কাপড় কোথায়?
সত্যিটা হল, বিজেপির গ্রাস থেকে বাঁচতে উত্তর পূর্বের এনডিএ শরিকদলগুলোকে শেষ পর্যন্ত এক হতে হয়েছে। সদ্য গঠিত ‘ওয়ান নর্থ-ইস্ট’ নামে সংগঠনের প্রথম প্রকাশ্য জনসভা হল আগরতলায়। সেখানেই এনডিএ শরিকদের এই জোটের লক্ষ্য যে বিজেপির দাদাগিরির মোকাবিলা করা, সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন জনসভার হাজির থাকা উত্তরপূর্বের শাসক জোটের নেতারা। অসম, নাগাল্যাণ্ড, অরুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম, মণিপুর, মেঘালয় ও ত্রিপুরা – এই সাত রাজ্যের এনডিএ শরিকরাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে নতুন সংগঠন গড়ে তুললেন। আপাতভাবে আঞ্চলিক জোট হলেও প্রকৃত উদ্দেশ্য বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র বাইরে আরেকটি গোষ্ঠী তৈরি রাখা। এনডিএ-র শরিক টিপ্রা মোথার প্রধান প্রদ্যোৎ কিশোর মাণিক্যর দাবি, বিজেপি নিজেদের শরিক দলকেই দুর্বল করে দেয়। শিবসেনা থেকে অসম গণপরিষদ, বোরোল্যাণ্ড পিপলস ফ্রন্ট – সবাই বিজেপির আগ্রাসনের শিকার হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
অসমের মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা হিমন্ত বিশ্বশর্মার নেতৃত্বে গঠিত উত্তরপূর্ব উন্নয়ন পর্ষদ বা নিডার কর্মকাণ্ড নিয়ে এনডিএ শরিক দলগুলোর ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। হিমন্তের দাদাগিরি মানতে নরাজ ছোট শরিকরা। সেই কারণেই বিকল্প মঞ্চ হিসেবেই প্রদ্যোৎ কিশোরের নেতৃত্বে গঠিত ‘ওয়ান নর্থ-ইস্ট’-এর শামিল হয়েছেন মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী করনাড সাংমা, নাগাল্যান্ডের প্রাক্তন মন্ত্রী এমএম কিকন, মণিপুরের আরকে মেগান সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের জনজাতি নেতারা। আপাতাবে এনডিএ বা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমর্থক হলেও উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজনীতিতে সংঘ পরিবারের আগ্রাসনকেই বাজনৈতিক ও সামাজিক স্তরে মোকাবিলায় ওই মঞ্চের অস্তিত্ব কিন্তু এই মুহূর্তে বিজেপির কাছে যথেষ্ট বিড়ম্বনার।
তাহলে কি বোঝা গেল? ছোট মাছের দল বাড়ছে যাতে বড় মাছ অর্থাৎ বিজেপি তাদের গিলে খেতে না পারে। কিন্তু নীতীশের ব্যাপারটা আলাদা। এবারের বিহার নির্বাচনে বিজেপি অনেক ভালো ফল করা সত্ত্বেও নীতীশকে তারা মুখ্যমন্ত্রী করেছে। কেন না বিজেপি ভালো করেই জানে, মুখ্যমন্ত্রী করা না হলে পাল্টুরাম নীতীশ আবার পাল্টি খেতে পারেন। যদিও নীতীশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়াটা কিন্তু বিজেপির হজম হচ্ছে না। আর তাই প্রশাসনিক স্তরে ইতিমধ্যেই গোলমাল বেধেছে নীতীশ বনাম বিজেপির। এর আগে যখন বিজেপির সঙ্গে নীতীর গন্ডগোল হয়েছিল, নীতীশ সরাসরি হাত ধরেছিলেন লালু প্রসাদের। স্বাভাবিকভাবেই বিজেপি নীতীশকে একটু সমঝে চলে। কিন্তু কতদিন? বিজেপি চাইছে ‘এক দেশ, এক দল’, মানে ভারতীয় জনতা পার্টি, আর অবশ্যই এক নেতা নরেন্দ্র মোদি। আগে হোক আর দু’দিন পরে, স্বৈরাচারী তার রং দেখাবেই। বিজেপির সেই আসল রং এখন গোটা ভারত দেখছে।
দেখুন ভিডিও:







