গন্ডায় গন্ডায় জ্যোতিষীদের কাছে নাকি ওই উনি, কাঁথির খোকাবাবু, তাঁর কুষ্ঠি ঠিকুজি পাঠাচ্ছেন, মানে সময় ভালো না গেলে মানুষ আর সব ছেড়ে ভাগ্য বিচারেই নামে, মনে হয় যা হচ্ছে সবই গ্রহের ফেরে। তো ওনার এক ফাঁড়া আসছে, অন্য ফাঁড়া ঝুলছে কপালে। কাজেই আপাতত রামমন্দির, সরযূতে গলাজলে দাঁড়িয়ে সূর্যপ্রণাম, কাকে দিয়ে যেন শুনলাম, মানে আমরা খবরটা বলছি কিন্তু সে খবর খতিয়ে দেখিনি, এরকম বলা এখন চলে। তো খবরটা হল যে তিনি নাকি আজমের শরিফেও চাদর পাঠিয়েছেন, ওনার আপাতত অভিভাবকও পাঠিয়েছেন, উনিও পাঠিয়েছেন। অবস্থা কতটা খারাপ হলে তিন দফতরের মন্ত্রী, মেদিনীপুরের ডিফ্যাক্টো মুখ্যমন্ত্রী নিজের উঠোনে পপাত চ, মমার চ, ধড়াম করে পড়ে গেলেন। কতটা হাল বেহাল হলে মাত্র ক’দিন আগে যিনি তাঁকে নিয়ে কথা বলার আগে ১০০ বার ভাবতেন সেই সুকান্ত মজুমদার অনায়াসে বলেই দিলেন, উনি সংগঠন বোঝেন না, আড়ালে আবডালে নাকি বলেছেন কোনও কম্মের নয়। কতটা কপালে শনি নাচলে যিনি দাবি করেন নন্দীগ্রাম সিঙ্গুরের আন্দোলনে করেছেন, তিনিই এক স্বাস্থ্যভবনের ঘেরাওয়ে যেতেই পারলেন না। হোমে যজ্ঞে কোথাও যদি তিনি না থাকেন, তাহলে অনুগামীরাও আর ক’দিন পর থেকে ছেড়ে চলে যাবেন, স্বাভাবিক, পাওয়ার পলিটিক্সে এসব নতুন কিছু নয়। ৭৭ রানে ব্যাট শুরু করেছিলেন, আপাতত সংখ্যাটা ৬২-৬৪ তে এসে ঠেকেছে, লিখে রাখুন ওই ২০২৬ আসতে আসতে এই সংখ্যা ৪০-এ ঠেকবে। এবং এরই মধ্যে আর এক দুঃসংবাদ, সেই দুঃসংবাদই বিষয় আজকে, ও শুভেন্দুবাবু, এ বাংলায় বিজেপির আর একটা উইকেট পড়ল।
উত্তরবঙ্গ এখনও বিজেপির একটা ভরসার জায়গা, এবারেও সেখানে খুব খারাপ করেনি বিজেপি, কিন্তু একটা ফাটল যে ধরেছে তা তো গত উপনির্বাচনেই বোঝা গেছে। মাদারিহাট ছিল বিজেপির আসন, মনোজ টিগগা যিনি এই জন বার্লার বদলে আলিপুরদুয়ারে সাংসদ হলেন তিনি গত নির্বাচনে পেয়েছিলেন ৫৪ শতাংশের কিছু বেশি ভোট, তৃণমূল ৩৪ শতাংশ। উপনির্বাচনে এই অঞ্চলে মাঠেই নামেননি জন বার্লা। বিজেপি পেয়েছিল ৩৬ শতাংশ ভোট আর তৃণমূল ৫৪ শতাংশ, রোল রিভার্সাল, সবাই জানত যে জন বার্লা সরে যাওয়াই ছিল এর অন্যতম কারণ, কিন্তু এতদিন ধরেও বার্লাকে বোঝানো গেল না, সেই উইকেট আজ পড়ল।
আরও পড়ুন: Aajke | শকুনির ভূমিকাতে শুভেন্দু অধিকারী?
উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের সেই প্রভাব গড়ে ওঠার আগেই বামেদের বিরাট ভোট চলে গিয়েছিল বিজেপির দিকে, আর সেটাই এখনও বিজেপির ভিত্তি। না সংগঠন, না আদর্শগত জায়গা থেকে বিরাট কোনও সমর্থন। এই বাংলাতে বিজেপির কোর ভোট, মানে বিজেপির ওই হিন্দুত্ব বা বিজেপির সমর্থনের ভোট খুব বেশি হলে ওই ২০ শতাংশের এধারে ওধারে, যা আগে ছিল ১৪-১৫ শতাংশ। কিন্তু এক বিরাট সংখ্যক বামেদের ভোট গিয়ে জমা হওয়াতে বেড়ালকে বাঘ মনে হচ্ছে বটে, সেই ভোট একটু ধসে গেলেই হেরে ভূত হবে বিজেপি। একটা বড় বর্ষার পরে যেরকম মাটি গলে পড়ে গিয়ে বাঁশ আর খড়ের কঙ্কালসার চেহারাটা বেরিয়ে আসে, ঠিক সেই রকম। আমাদের কাঁথির খোকাবাবু সেটিই বুঝে উঠতে পারেননি, ওনার মনে হয়েছিল ৪০-৪১ শতাংশ ভোট তো এসেই গেছে, এবারে আর সামান্য ২/৩ শতাংশ ভোট এলেই মমতা হঠাও অভিযান সাকসেসফুল, তারপর মুখ্যমন্ত্রীর গদি। কিন্তু এখন এক আঞ্চলিক পরিচিতির উপরে ভর করে ভোটের, সমর্থনের পুনর্বিন্যাস হচ্ছে, আর ক্ষমতা ধরে রাখার, নানান ঝড়ঝাপটা সহ্য করেও নিজেদের সংগঠন আর সংসদীয় ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলার পরে বিজেপিতে ক্ষুব্ধ, বা পাওয়ার পলিটিক্সে অনিবার্যভাবেই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চাওয়া লোকজন আবার তৃণমূল-মুখো হবে, এই এক্সোডাস রুখতে পারবেন না শুভেন্দু অধিকারী বা সুকান্ত মজুমদার। সেই সূত্র ধরে আজ উত্তরবঙ্গের একটা চৌখস উইকেট পড়ে গেল বিজেপির। এবং এখানেই শেষ নয়, বছরের মাঝখানও কি যেতে পারবে, তৈরি থাকুন আরও অঘটনের জন্য, এই বাংলাতে তৃণমূল বিজেপির প্রত্যেকটা শিক্ষা মনোযোগ দিয়ে শিখেছে, একটা সময়ে তারা শিক্ষা নিয়েছে সিপিএম-এর কাছ থেকে, এখন রোজকার রাজনীতি, আদর করে যাকে রিয়েল পলিটিক্স বলে, সেই পলিটিক্স-এ বিজেপির সবকটা পদ্ধতি আপাতত করায়ত্ত তৃণমূলের। যতদিন মমতা কোনও প্রকাণ্ড ভুল না করছেন, যতদিন দল ওনার হাতে ততদি ন শুভেন্দু অধিকারী, আপনি বরং অন্তত বিরোধী দলনেতার পদটাও কীভাবে ধরে রাখা যায় তার চেষ্টা মন দিয়ে করুন, ঘরে বাইরে এত শত্রু আর এই মহাজগতের সবকটা গ্রহ উপগ্রহ বড্ড কুপিত বলেই মনে হচ্ছে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে অন্য রাজ্যে বিরোধী দল ভেঙে ফেলছে বিজেপি, কিন্তু এ বাংলাতে তাদের দল ভাঙছে কেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
বিজেপি বা আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদী আদর্শের চাষবাসের জন্য এক ধরনের মাটি লাগে, যা উত্তর ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আছে। পঞ্জাব ব্যতিক্রম, কারণ সেখানে এক রিলিজিয়স মাইনরিটির উপস্থিতি, বিহারে এক বিশাল ওবিসি, পিছড়ে বর্গের উপস্থিতি বিহারে সেইভাবে বিজেপিকে বাড়তে দেয়নি। বাংলার সমস্যা হল রাজা রামমোহন থেকে বিদ্যাসাগর, রবিঠাকুর, লালন, নজরুল, সুভাষ বসু। বাঙালির কোনও আইকনেই এই হিন্দুত্বের মাখামাখি দুর্গন্ধ ছিল না, নেই। যার ফলে ঠিক যে কারণে পঞ্জাবে বিজেপি নেই, তামিলনাড়ু, কেরালাতে বিজেপি নেই বা এঁটে উঠতে পারে না, তেলঙ্গানা, অন্ধ্রতে বিজেপি বাড়তে পারে না, সেই কারণেই বাংলায় বিজেপির বেড়ে ওঠা কঠিন। এই সারসত্য কাঁথির খোকাবাবুর মাথায় ঢুকবে বলে মনে হয় না, ঢুকলে এই মুহূর্ত থেকে ওনার চেষ্টা করা উচিত ঘর বাপসির, মমতা সোমেন মিত্রকে দলে নিয়েছেন, শুভেন্দু ফিরতে পারেন না?