রাশিয়ান সার্কাস দেখেছিলাম, ঘেরা রিংয়ের মধ্যে ১৬টা সিংহ, সিংহি, একা রিং মাস্টার তাদের ওঠাচ্ছেন, বসাচ্ছেন, হাঁটাচ্ছেন, সেই মুষকো চেহারার সিংহেরা শুনছে, রিং মাস্টারের সব কথা বাধ্য ছেলের মত শুনছে, যেন বাধ্য বেড়াল। কেউ কেউ বলেন হাতের নখ কাটা থাকে, তাতে কী? দাঁত তো আছে, সিংহগুলো তো ফোকলা নয়। তো প্রায় সেই রকমই রিং মাস্টারের ভূমিকাতে আবার দেখলাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে, ফারাক একটাই, সামনে বসে থাকা কেউই সিংহ পদবাচ্য নন। এক ধমক খেয়ে অমন যে অমন ব্রাত্য বসু, তাঁর মুখ দেখে আর যাই হোক ওনার ভেতরে এক সিংহ লুকিয়ে আছে তেমন কথা কেউই বলবে না। নরমে গরমে বছরের দ্বিতীয় দিনেই মুখ্যমন্ত্রী বোঝালেন কাজ করো নয়তো ফোটো। বুদ্ধ ভট্টাচার্য এই কথা বলেছিলেন, কিন্তু তিনি রিং মাস্টার ছিলেন না, রিং মাস্টার এরেনার বাইরে বসে থাকা দলের সম্পাদক, তিনিও আবার এক দুর্বল মানুষ, অন্তত ২০০৬ থেকে তো বটেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক অত্যন্ত পরিশ্রমী ছাত্রের মতো বছরের শুরুর দিন থেকেই পড়াশুনো আর হোম টাস্ক করে রাখতে চান, যাতে করে পরীক্ষার আগে টেনশনে না পড়তে হয়। তিনি আপাতত যা যা করছেন তার এক এবং একমাত্র লক্ষ্য হল ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচন। তিনি বুঝে নিতে চান মানুষের সমস্যা, বুঝে নিতে চান কোন কাজ বাকি আর কোন কাজ আগে করা দরকার। আর তার থেকেও বেশি যেটা চান সেটা হল রাজ্যের মানুষের কাছে সেই মেসেজটা পৌঁছে দেওয়া, আরে বাবা ম্যায় হু না। কেবল কাজ করলেই তো হবে না, কাম দিখনা চাহিয়ে। কাজ যে হচ্ছে সেটা মানুষ যেন বুঝতে চায়, এখন সবটাই পারশেপশন গেম, ধারণা। সেটাই বিষয় আজকে একা মমতা, যেন রিং মাস্টার, ঝাঁকানি দিলেন নেতা মন্ত্রী আমলাদের।
ধরুন দিন তিনেক আগেই খবরের কাগজে বেরিয়ে গেছে প্রাইমারিতে সিমেস্টার চালু হচ্ছে, মানে বছরে একবারের বদলে বার দুই কি তিন ফাইনাল পরীক্ষা, মানে বেশ কিছুটা চাপ। আর এমনটা নতুনও নয়, মোদি শাহের শিক্ষা নীতিতে এমনটা তো আছেই। কিন্তু আধুনিক পঠনপাঠন পদ্ধতি বলছে চাপ কমাও, শিশুদের উপর থেকে চাপ কমাও। বচ্ছরভর অসাধারণ প্রবন্ধ রচনা, ফাটাফাটি নাটক লেখা এবং সিনেমা পরিচালনায় ব্যস্ত আমাদের শিক্ষামন্ত্রী এ বিষয়ে চর্চা করার সময় পাননি।
আরও পড়ুন: Aajke | শুভেন্দু একটি দুষ্টু লোক, তার মাথায় উকুন হোক
এ পর্যন্ত তো ঠিকই ছিল, কিন্তু তা নিয়ে ঝপাং করে এমন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবেন তা তো হেড অফিসের বড়বাবুও জানতেন না, তো নিলেন। তা কাগজে ফলাও করে ছাপাও হল, শিক্ষামন্ত্রী পরদিন কিছুই বলেননি, মানে ওনার জ্ঞানতই এই খবর বের হয়েছে, উনি আবার সংবাদমাধ্যমের লোকজনদের কাছের লোকও বটে, শ্রেষ্ঠ বাঙালি ইত্যাদিতে সাদর নেমন্তন্ন তো থাকেই। সেটা বড় কথা নয়, সেই খবর তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও দেখেছেন, ফোন করে সটান বলতে পারতেন, তুলে নেওয়ার নির্দেশ দিতেই পারতেন, কিন্তু ওই যে কাম দিখনা চাহিয়ে। সভামধ্যে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মতোই তিনি এক ধমক দিলেন শিক্ষামন্ত্রীকে, ওসব সিমেস্টার ফেমেস্টার চলবে না। চলবে না তো চলবে না। এরপরেও মন্ত্রীর রিয়্যাকশন যাঁরা নিতে গিয়েছিলেন তাঁরা হয় বোকা না হলে আমোদগেঁড়ে, রগড় দেখার জন্য হাজির হয়েছিলেন। তো ব্রাত্য বসুও সেই কথা বলেছেন, চলবে না তো চলবে না, এর উপর আবার কথা হয় নাকি রে পাগলা? অতএব মানুষের কাছে মেসেজ লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার, ভাগ্যে দিদি সঙ্গে ছিল। একই ভাবে ধমক বরাদ্দ ছিল পরিবহণ মন্ত্রীর জন্য, বাস নেই কেন সন্ধে ৮টার পরে? মহানগরের ঝুলন্ত বাদুড় আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত সমাজ দেখলেন চোখের সামনে তাঁদের মুখ্যমন্ত্রী কড়কে দিয়েছেন পরিবহণ মন্ত্রীকে, বাস নেই কেন? আপাতত কিছুদিন তো নিশ্চিন্ত। নয়ানজুলিতে নেই কেন সরকারি বোর্ড? বাচ্চারা ডিম পাচ্ছে কি না? ওয়েব পোর্টালে সরকারের কাজের প্রগ্রেস রিপোর্ট থাকবে কি না ইত্যাকার বিষয় নিয়ে সর্বসমক্ষে মুখ্যমন্ত্রী অনায়াসে এক রিং মাস্টার, সামনে বসে বাধ্য ছাত্রের দল, সামনে ২০২৬, তার প্রস্তুতিপর্ব। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, মমতা বসেন মন্ত্রী আমলাদের সঙ্গে, কাজ পছন্দ না হলে ধমক, সিদ্ধান্ত বদলে দেওয়া, নির্দেশ দেওয়া, এসবই করেন সর্বসমক্ষে, লাইভ স্ট্রিমিং চলে, কোনও লুকোছাপা নেই। এই ব্যবস্থা কি আপনাদের পছন্দ? নাকি এসব মিটিং রুমের গোপনীয়তায় হওয়া উচিত বলে মনে করেন? শুনুন কী বলছেন মানুষজন।
সংসদ আর নীতি আয়োগ ইত্যাদি বৈঠক ছাড়া ভারতবর্ষে বৈঠকে লাইভ স্ট্রিমিং-এর চল নেই। এবং কোনও রাজ্যে এমন বৈঠকের লাইভ স্ট্রিমিং, এবং সেখানে এক মুখ্যমন্ত্রীর এই প্রবল নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে রাজ্য চালানোর এমন কোনও নজির আজও কেউ তৈরি করতে পারেনি। মানুষ দেখতে পাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী কী চান? মানুষ দেখতে পাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী কতটা সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, কতটা চটজলদি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আর সেই দিক থেকে ওই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ইত্যাদির থেকেও এক কার্যকরী প্রশাসনিক ব্যবস্থার উদাহরণ রেখে যাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আগামী দিনে যা প্রত্যেকে কাজে লাগাবে, মানুষ কেবল কাজ চায় না, কাজ হচ্ছে সেটা দেখতেও চায়, আজ বলছি, পরে মিলিয়ে নেবেন।