আজ নয়, ২০১১-র সেই পরিবর্তনের জোয়ারেও আমরা দেখেছিলাম কালীঘাট থেকে দূরত্ব বাড়লে তৃণমূলের প্রভাব কমে। হ্যাঁ, সব অর্থেই এটা এক প্রমাণিত সত্য। আপনি রাজ্যের ম্যাপ খুলে বসুন, প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যাগুলোকে বসাতে থাকুন, তারপর দেখে নিন, কীভাবে কালীঘাট হয়ে উটেছে এক এপিসেন্টার যার থেকে দূরত্ব বাড়লেই তৃণমূলের ঢেউ দুর্বল হয়। এই রোগ মমতা ব্যানার্জির চোখে কি আজ ধরা পড়েছে? না, সেই শুরু থেকেই তিনি উত্তরবঙ্গে যতবার গেছেন ততবার এই রাজ্যের প্রত্যেক মুখ্যমন্ত্রীর সম্মিলিত সফরের সংখ্যার দ্বিগুণ কি তিনগুণ হবে। কিন্তু কোনওভাবেই সেই কাঙ্ক্ষিত শক্তি অর্জন করতে পারেনি তৃণমূল। একটা সময় পর্যন্ত সিপিএম ক্ষইলেও আরএসপি, ফরোয়ার্ড ব্লক ধরে রেখেছিল বাম দুর্গ, কিন্তু বিজেপির উত্থান এল সেই বাম শরিকদের ভোটব্যাঙ্ক থেকেই, কাজেই বামেদের বদলে উত্তরবঙ্গে দখলদারি বাড়াল বিজেপি। বিজেপির বেশ কিছু নতুন মুখও বেরিয়ে এল, দার্জিলিংয়ে হাজার চেষ্টা করেও সেখানকার জনজাতির মূল স্রোতকে মমতা আনতে পারেননি তৃণমূলের পিছনে। এখনও তারা স্বাধীন গোর্খাল্যান্ডের দাবি নিয়েই বিজেপির সঙ্গে। তলায় চা বাগান আর আদিবাসীরাও তৃণমূলের থেকে বিজেপিতে আস্থা রেখেছিলেন এতদিন। আর সেটা বুঝেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো, বুঝেছেন যে দক্ষিণবঙ্গের কিছু ইন্সিডেন্টাল লস হতেই পারে আর সেটা কিছুটা হলেও উদ্ধার করতে হবে এই উত্তরবঙ্গ থেকে, আর সেই পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে অন্তত তিনবছর আগে থেকে, ইন ফ্যাক্ট ২০২১-এর নির্বাচনের পর থেকেই অপারেশন উত্তরবঙ্গ নিয়ে নেমেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেটাই বিষয় আজকে। উত্তরবঙ্গে ঘুঁটি সাজাচ্ছে তৃণমূল।
২০২১-এ ভোট শতাংশের হিসেবে তৃণমূল আর বিজেপি ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে ছিল? কোচবিহারে তৃণমূলের ভোট ছিল ৪৪.৮%, বিজেপির ৪৯.৫% আর বামেদের ৩% এর মতো। আলিপুরদুয়ারে ৪১.৮% ভোট ছিল তৃণমূলের, বিজেপির ৪৭.৭%। জলপাইগুড়িতে তৃণমূলের ভোট ৪২.৯% আর বিজেপির ৪৮.১% ভোট ছিল, কংগ্রেস আর সিপিএম-এর মোট ভোট ছিল ৪.৭%। কালিম্পংয়ে তৃণমূলের ভোট ১৯.৬%, বিজেপির ৩৫.১% পাহাড়ের দল আর নির্দলের কাছে ছিল ৩৭.৬%। দার্জিলিংয়ে তৃণমূলের ২৯.৬%, বিজেপির ৪৭.৪%। উত্তর দিনাজপুরে তৃণমূলের ৫৩.৩%, বিজেপির ৩৭.৪% ভোট ছিল। দক্ষিণ দিনাজপুরে তৃণমূলের ৪৭.২%, বিজেপির ৪৩% ভোট ছিল। আমি মালদাকে এই হিসেবের মধ্যে আনছি না। তারমানে খুব পরিষ্কার, উত্তর দিনাজপুর আর দক্ষিণ দিনাজপুরে সমীকরণ তৃণমূলের দিকে থাকলেও, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়িতে কিন্তু বিজেপি এগিয়ে আছে। কালিম্পং দার্জিলিং চিরটাকালই ওই পাহাড়ের রাজনৈতিক দলের সমর্থনের রাজনীতি, যদিও সেখানে তৃণমূলের নিজস্ব একটা অস্তিত্ব গড়ে উঠেছে, মানে অবস্থাটা একেবারে একতরফাও নয়। কিন্তু এই তিনটে জেলা তৃণমূলের কাছে মাথাব্যথার বইকী। আর ঠিক তাই ২০২১-এর নির্বাচনের পর থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এই তিনটে জেলাকে আলাদা করে টার্গেট করেছেন, তার জন্য ঘুঁটি সাজাচ্ছেন। তাঁর প্রথম অস্ত্র হিসেব তিনি বেছে নিয়েছেন চা বাগানের শ্রমিকদের, তরাইয়ের আদিবাসী মানুষজনেদের। প্রথমে সিপিএম থেকে আসা বাম ঘরানার ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কে ওই অঞ্চলে পাঠিয়েছেন, প্রকাশচিক বরাইককে, ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কে অবাধে কাজ করার জন্য রাজ্য সভার সাংসদ করেছেন। কিছুদিন আগে প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ জন বার্লা তৃণমূলে চলে এলেন। কোচ-রাজবংশী ভোটকে মাথায় রেখেই অনন্ত রায়ের সঙ্গে তৃণমূল নেত্রীর সাক্ষাৎ আগামী দিনে নতুন সমীকরণ গড়ে তুলবে। উত্তরবঙ্গের আরও দু’ একজন বিজেপি নেতা হয়তো এই বছরের মধ্যেই শিবির পাল্টাবেন। অন্যদিকে এখনও কংগ্রেসের যে ৩-৪-৫% ভোট এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সেখানেও এবার নজর দিল তৃণমূল। কংগ্রেস নেতৃত্বের অবশিষ্ট দুজনের একজন, শঙ্কর মালাকার চলে এলেন তৃণমূলে, পড়ে আছেন ডি পি রায়, মানে কংগ্রেসের বেশ খানিকটা ভোট এবার তৃণমূলের দিকে আসবে। সবমিলিয়ে বিজেপি কংগ্রেসের কিছু নেতাদের দলে এনে ঘুঁটি সাজাচ্ছে তৃণমূল, লক্ষ্য আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার আর জলপাইগুড়ি। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, গত ক’ বছর ধরেই উত্তরবঙ্গে বেশ কিছু বিজেপি, কংগ্রেস নেতাকে তৃণমূলে যোগ দিতে দেখা যাচ্ছে, আগামী ২০২৬-এ উত্তরবঙ্গে কি তৃণমূল ২১-এর চেয়ে ভালো করার মতো জায়গাতে গেছে? শুনুন মানুষজন কী বলছেন।
আরও পড়ুন: Aajke | দিলীপ ঘোষ বিজেপি থেকে বিচ্ছিন্ন, এটা তৃণমূলের বড় লাভ
হ্যাঁ, এখন প্রস্তুতিপর্ব, ২০২৬-এর মহারণের ঘুঁটি সাজাচ্ছে সবাই, প্রত্যেক রাজনৈতিক দল, প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের নেতারা আগাম হিসেবে ব্যস্ত, কোন দলে গেলে তাঁদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে, ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া যাবে। প্রত্যেক রাজনৈতিক দল হিসেব কষছে কোন নেতা দলে এলে কত লাভ হতে পারে, কোন নেতা চলে গেলে কত ক্ষতি। কিন্তু গত ৮-৯ মাসের হিসেবে তৃণমূলের ক্ষতি শূন্য, কিন্তু লাভের খাতায় জন বার্লা, শঙ্কর মালাকার, হ্যাঁ উত্তর বঙ্গের এই দলবদল কিছুটা হলেও তৃণমূলকে অক্সিজেন দেবে।
জেলার নাম AITC প্রাপ্ত ভোটের % BJP প্রাপ্ত ভোটের % অন্যান্য প্রধান দল (প্রাপ্ত ভোটের %)
কোচবিহার ৪৪.৮% ৪৯.৫% AIFB ১.৭%, CPI(M) ১.৩%
আলিপুরদুয়ার ৪১.৮% ৪৭.৭%
জলপাইগুড়ি ৪২.৯% ৪৮.১% CPI(M) ২.৫%, INC ২.২%
কালিম্পং ১৯.৬% ৩৫.১% GJM(T)/IND ৩৭.৬%
দার্জিলিং ২৯.৬% ৪৭.৪% GJM(T)/OTH ১৭.১% (প্রধানত পাহাড়ে)
উত্তর দিনাজপুর ৫৩.৩% ৩৭.৪% INC ৩.৩%, AIFB ২.২%
দক্ষিণ দিনাজপুর ৪৭.২% ৪৩.০% RSP ৩.৮%, CPI(M) ২.৩%
মালদা ৫৩.০% ৩২.৮% INC ৮.৮%