উত্তর ২৪ পরগনার বালুদা, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক জামিন পেলেন, জেলের বাইরে এলেন। এই ক’দিন আগে পর্যন্ত যা ফিরিস্তি দেওয়া হচ্ছিল, তাতে মনে হচ্ছিল, ফাঁসিতে লটকিয়ে না দেয়, এত ভূরি ভূরি চুরি আর তার প্রমাণ, অথচ দেখা গেল, ওনাকে আপাতত বেল দেওয়া হয়েছে, আর আপনারা সব্বাই জানেন যে জামিন পাওয়া মানেই দোষ মুক্তি নয়। কিন্তু এটাও তো জানেন যে তেমন প্রমাণ থাকলে, তেমন অপরাধের সঙ্গে যোগসাজস আছে তার কংক্রিট এভিডেন্স থাকলে ওনাকে বেল দেওয়া হত না। একই কথা প্রযোজ্য কেষ্ট মোড়লের বিষয়েও, উরিব্বাস, লক্ষ লক্ষ গরু পাচার থেকে শুরু করে ধানকল, তেল কল, কী ছিল না সেই তালিকাতে, কিন্তু ওই বারো, পনেরো, আঠারো মাস পরে পরে এঁরা জামিন পেয়ে যাচ্ছেন, আর একবার জামিন পাওয়ার পরে সে মামলার যে কী হচ্ছে কেউ জানে না। কাজেই প্রশ্ন দুটো উঠছে, উঠবেই। আদৌ কোনও প্রমাণের ভিত্তিতে এনাদের ধরা হয়েছিল? নাকি ধরার পরে সেটিং হয়ে গেল? সেটিং হলে তো কথাই নেই, ইডি আর ফিরেও তাকাবে না। যাই হয়ে থাকুক, ইডির এই গ্রেফতারি, সিবিআই-এর এই তদন্ত ইত্যাদি ক্রমশ এক কমেডি ফিল্ম হয়ে উঠছে। নিশির ডাক তো জানে সবাই, কেউ কেউ নাকি সে ডাক শুনেছে। নিশুতি রাতে নিশি ডাকে আয় আয় আয়, তারপর মুখে ফেনা ওঠা, ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকা দেহ পাওয়া যায়। কাদের ডাকে নিশি? তার বেছে নেওয়ার পদ্ধতির কোনও সমীকরণ নেই, ডাকে, যাকে ইচ্ছে ডাকে। ইডি কিন্তু তেমন নয়, তার ডাকার নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, সে পদ্ধতি কারও কাছেই অজানা নয়। এ ভারতবর্ষে দু ধরনের এলাকা আছে, বিজেপি বা তার বন্ধুদের শাসিত রাজ্য, বিজেপি বিরোধী দল শাসিত রাজ্য। প্রয়াগ সঙ্গমে গেলে দেখবেন, গঙ্গার জল ঘোলাটে, যমুনার জল সাদা, স্বচ্ছ। খানিকটা সেইরকম আর কী, ইডি বিজেপি শাসিত রাজ্যে বিরোধীদের ঘরে কড়া নাড়ে, আর অবিজেপি শাসিত রাজ্যে শাসকদলের দরজ্য টোকা দেয়, রাতে নয়, দিনদুপুরে প্রেমপত্র আসে, চলে আসুন কথা আছে, আপনি অভিযুক্ত? আপনি কোনও অন্যায় লেনদেনের সাক্ষী? না, এসব জানানোর দায় ওনাদের নেই। ধরুন পুলিশ আপনাকে ডাকছে, কেন ডাকছে? জানাতে হবে, আপনি অভিযুক্ত নাকি সাক্ষী, তা জানাতে হবে, এনফোর্সমেন্ট ডিরেকটরেটকে সে সব জানাতে হবে না। ধরুন পুলিশ আপনাকে ডাকল, কলার চেপে রুলের গুঁতো দিয়ে বলল, বলে ফ্যাল চুরি করেছিস। গুঁতো খাবার ভয়ে আপনি বলে দিলেন, কিন্তু আদালতে গিয়ে বেমালুম অস্বীকার করতে পারেন, পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দি আদালতকে মেনে নিতেই হবে, এমন তো নয়। কিন্তু ইডির কাছে? যা বলেছেন, তা আপনার বিরুদ্ধেই ব্যবহার হতে পারে, মানে চার দেওয়ালের ভেতরে আপনাকে দিয়ে জোর করে বলিয়ে নেওয়া যা কিছু, তার সবটাই আপনার বিরুদ্ধেই ব্যবহার হতেই পারে।
এরপর আসবে জামিনের কথা, জামিন পাওয়াটা অভিযুক্তের অধিকার, দয়া বা করুণা নয়। কিন্তু ইডি ধরলে বিচারক কখন জামিন দিতে পারে? মানি লন্ডারিং-এর মামলায় যদি বিচারক মনে করেন যে আপনি নির্দোষ, তাহলেই একমাত্র জামিন দিতে পারেন, কী কাণ্ড বলুন তো? বিচারক যদি মনে করেন আপনি নির্দোষ, একমাত্র তখনই আপনাকে আমিন দিতে পারবেন, কিন্তু বিচারকের চোখে আপনি যদি নির্দোষই হন, তাহলে মামলাটা চলছে কেন? জবাব নেই। এই মানি লন্ডারিং নিয়ে যে আইন, তা কংগ্রেস বা ইউপিএ-র আমলেই গোলমেলে হয়ে উঠেছিল, এখন তা আরও শক্তপোক্ত হয়েছে, এমন ক্ষমতা এই আইনে দেওয়া হয়েছে, যাতে ইডি আপনাকে চাইলে বছরের পর বছর ডাকতে পারে, জেরা করতে পারে, জেলে পুরে রাখতে পারে, আবার ছেড়েও দিতে পারে। মজার কথা হল, কতদিন পুরনো লেনদেন নিয়ে এই মামলা হতে পারে? রেট্রোস্পেকটিভ এফেক্ট যাকে বলে, সেখানে কোনও বাধা নেই ১৯৪৭ সালের লেনদেনও স্ক্রুটিনির মধ্যে আসতেই পারে, আপনি কোম্পানির মালিক ছিলেন না, ডিরেক্টর ছিলেন না, পরে এসেছেন, তাতে কী? আপনাকে ডাকতে পারে, জেরা করতেই পারে, এবং এটা না বলেই যে আপনি মনি লন্ডারিং-এর মামলায় দোষী? অভিযুক্ত? নাকি সাক্ষী? আইন তৈরি হয়েছিল দুনিয়াজোড়া ড্রাগ কার্টেলের টাকা কোথায় আসছে, কোথায় থাকছে, তা খুঁজে বার করার জন্য, এরপর উগ্রপন্থার বিষয়টা জুড়ে যায়, এখন প্রায় সব কিছু, কপিরাইট ভায়োলেশন-এর বিষয়েও মনি লন্ডারিং, টাকা তছরুপের মামলা করা যায়, এবং মজার কথা হল যেই মাত্র আপনি পদ্ম হতে ধরবেন, সেই মাত্র আপনি মিঃ ক্লিন, আপনার ডাক পড়বে না, নিশি নয় ইডিও আপনার কাছথেকে দূরে থাকবে, কিন্তু বিজেপি বিরোধী হলে? উদার গণতান্ত্রিক মতের এক সাংবাদিক হলে? কিংবা কোনও কারণে মোদি – শাহের কুনজরে পড়লে, ইডি ডাকবে আয় আয় আয়। কলকাতায় থাকেন? তাতে কী? দিল্লিতে আসুন, জেরা? কত ঘণ্টা চলবে কেউ জানে না। সাত থেকে ৭০ ঘণ্টা, যা খুশি, বা বলা ভালো যেমন কর্তার নির্দেশ, এবং তার সঙ্গে সিলেক্টিভ লিকেজ, মানে জেরা বা পাওয়া ডকুমেন্ট, ছবির খানিকটা চলে যাবে বাছাই করা সাংবাদিকদের কাছে, সক্কাল থেকে তাঁরা ব্রেকিং নিউজ চালাবেন, অবশ্য এটা কেবল ইডি নয়, এনআইএ, নারকোটিকস ব্যুরো, সিবিআই, ইনকাম ট্যাক্স মায় থানার কনস্টেবলও জেনে গেছে, কোন খবর লিক করে দিলে কর্তারা খুশি হবে, আফটার অল কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম, ইহাই শ্রমিকদের ধর্ম।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোহন ভাগবত, মোদিজির মতো বিশ্বাসঘাতকেরা দেশের স্বাধীনতার কথা বলছেন?
শাহরুখ খানের ছেলে ড্রাগ পাচারে জড়িত, গ্রেফতার আরিয়ন খান। একে শাহরুখ, তারপর খান সব মিলিয়ে টি আর পি রকেটের মতো উঠছে, এবার সেই ঘটনার আঁখো দেখি বিবরণ, চার মাস পরে জানা গেল, আরিয়ন নির্দোষ, তার কাছ থেকে কোনও ড্রাগ বাজেয়াপ্ত হয়নি, এবং তখন জানা গেল যিনি এই গ্রেফতারি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আওয়াজ তুলেছিলেন, বলার চেষ্টা করছিলেন যে এটা একটা ষড়যন্ত্র, ষড়যন্ত্রের প্রমাণ দিচ্ছিলেন, সেই নবাব মালিক খান নাকি মনি লন্ডারিং-এ যুক্ত, তাঁকে ধরা হল, তিনি জেলে বসে খবর পেলেন, আরিয়ন ছাড়া পেয়েছে, কিন্তু তিনি আনন্দ করবেন কী? তিনিই তো জেলে, ইডি ডেকেছে, জেরা করেছে, গ্রেফতারও করেছে। এই নবাব মালিকের ইডি মামলাটাও বেশ ইন্টারেস্টিং, বলি তাহলে? ২০২২ নভেম্বর দেবেন্দ্র ফড়নবিশ, একদা মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী, বিজেপির নেতা, একটা টুইট করলেন, তাতে লেখা হল, “নবাব মালিক, আপনি মুম্বইয়ের হত্যাকারীদের সঙ্গে ব্যবসা করছেন কেন?“ তিনি সাংবাদিকদের বললেন, নবাব মালিকের কোম্পানি মুম্বাইয়ের কুরলাতে গ্যাংস্টারদের কাছ থেকে, তিন একরের একটা সম্পত্তি কিনেছেন, চার মাস পরে এনআইএ চলে এল, ৩ ফেব্রুয়ারিতে এফআইআর হল, জানাল রিলায়েবল ইনফর্মেশন, ভরসা করা যায় এমন খবর পাওয়ার পরেই এই এফআইআর করা হয়েছে, সেই রিলায়েবল ইনফরমেশনে আরও বলা হয়েছে যে, এই সম্পত্তি গ্যাংস্টার দাউদ ইব্রাহিমের ডি কোম্পানি থেকে কেনা হয়েছে, এই টাকা বিভিন্ন নাশকতার কাজেও লাগানো হতে পারে, অতএব ইউএপিএ-র ধারাও দেওয়া হল, এর ১১ দিন পরে ইডি মনি লন্ডারিং-এর মামলা আনল, মানে আগে বিজেপির কাছে খবর এল, তারপরে ইডি জানতে পারল। ঘটনাটা কী? মুম্বই এয়ারপোর্টে দক্ষিণে একটা সম্পত্তি ছিল, যার অনেকটা এক গ্যারাজ মালিক দখল করে রেখেছিল, সম্পত্তির মালিক মুনিরা এস প্লাম্বার এবং তাঁর মা। তাঁরা এই জায়গা থেকে ওই গ্যারাজকে তুলতে ১৯৯৯ সালে, একজন কে নিয়োগ করে, যাঁর নাম সলিম প্যাটেল, তিনি দাউদের বোন হাসিনা পার্কারের ড্রাইভার ছিলেন, ঐ নিয়োগের সময় প্যাটেলের কাছে সম্পত্তির মালিক একটা পাওয়ার অফ আটর্নি দেয়, প্যাটেল সেটাকে কাজে লাগিয়ে সম্পত্তিটা বিক্রি করে, সলিডাস ইনভেস্টমেন্ট নামে এক কোম্পানির কাছে, ২০০৩ এ, সেই কোম্পানির মালিকানা নবাব মালিকের পরিবারের হাতে ছিল, যদিও মধ্যে ছ’মাস বাদ দিলে নবাব মালিক এই কোম্পানির কোনও পদেই ছিলেন না, কেনার সময়ও নয়, নবাব মালিকের দাদা, যিনি এই সম্পত্তি কিনেছিলেন, তিনি মৃত। তখনও মনি লন্ডারিং আইন তৈরিই হয় নি, কিন্তু নবাব মালিক এখন জেলের বাইরে, তিনি অজিত পাওয়ার এনসিপির এমএলএ, বিজেপির সেই নেতা দেবেন্দ্র ফড়নবিশ এখন মূখ্যমন্ত্রী, বিধানসভাতে সেই দাউদের “নাকি”সহযোগী নবাব মালিকের সমর্থন নিয়েই তিনি মূখ্যমন্ত্রী।
দেশের প্রত্যেক উল্লেখযোগ্য বিজেপি বিরোধী নেতা, ইডির ডাক পেয়ে গেছেন, সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, এই বাংলায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সমেত আরও অনেকে, লালু প্রসাদ যাদব, অখিলেশ যাদব, মায়াবতী, শরদ পাওয়ার, কে নয়? স্বাধীনতার পরে এই প্রথম এক সরকার যারা কেবল রাজনীতি নয়, কখনও সখনও পুলিশ নয়, দেশের সুরক্ষা, অর্থনৈতিক অপরাধ ধরার এজেন্সিকে ব্যবহার করছে বিরোধীদের বিরুদ্ধে। এ এক অঘোষিত জরুরি অবস্থা। আমাদের সংবিধানের রচয়িতারা, এরকম কোনও অবস্থা হতে পারে, তার কথা মাথাতেও আনেন নি। কিছু হিসেব দিয়ে বোঝানো যাক, কতটা ব্যপক হয়েছে এই আক্রমণ? ২০০৫ থেকে ২০১৪-র মধ্যে এই মনি লন্ডারিং মামলায় সার্চ করা হয়েছে ১১২টি ঘটনায়, ২০১৪ থেকে ২০২২ এর মধ্যে সার্চ করা হয়েছে ২৯৭৪ জায়গায়, ২০০৫ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত মামলা করা হয়েছে ১৮৬৭টি, সেটাই ১৪ থেকে ২২ এর মধ্যে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭৭০টিতে। তদন্ত করে, ২০০৫ থেকে ১৪-র মধ্যে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে ১০৪টিতে, ১৪ থেকে ২২ এ ৮৩৯টি ক্ষেত্রে এবং এই ১৭ বছরে দোষী সাব্যস্ত কত মামলায়? মাত্র ২৩টি মামলাতে দোষীদের শাস্তি দেওয়া গেছে, কিন্তু এই ক’বছরে ঐ যে নিশির ডাক, থুড়ি ইডির ডাক, কতটা বেড়েছে? ২০১৬-১৭-তে ৪৫৬৭ জনকে সমন ধরানো হয়েছে, ২০১৭-১৮-তে ৫৮৩৭ জনকে, ২০১৮-১৯-এ ৯১৭৫ জনকে, ২০১৯-২০-তে ১০৬৬৮ জনকে, ২০২০-২১-এ ১২১৭৩ জনকে, ২০২১–২২-এর নভেম্বর পর্যন্ত ১১২৫২ জনকে মনি লন্ডারিং মামলায় সমন ধরানো হয়েছে। তারপর থেকে আর ডেটাও পাওয়া যাচ্ছে না, লজ্জায় তাঁরা জানাচ্ছেন না, তা হোক যা মিলেছে তাতেই পরিস্কার ছবি, পরিস্কার মেসেজ।
ওহে এখনও বলছি সাবধান হও, নাহলে জ্যোতিপ্রিয়, কেষ্ট মোড়লের হাল দেখে নাও, অ্যাট লিস্ট ১৪ মাস তো জেলে পুরে রাখবো। লাউড আন্ড ক্লিয়ার মেসেজ, কিন্তু সমস্যা হল, মানুষ এই নৌটঙ্কিটা বুঝে ফেলেছে, বিরোধী হলে জেলে পোরো, ১০/১৫ মাস জেলে রেখে ছেড়ে দাও, প্রয়োজনে আবার গ্রেফতার কর। আর সেটিং হয়ে গেলে তো সাত খুন মাফ। অজিত পাওয়ার বা নবাব মালিক, কারোর ওপরের ইডির নজর আর নেই। ইডি কর্তারা জানেন ভাল করে নজর দিলে চোখ গেলে দেবে।