skip to content
Sunday, February 9, 2025
HomeScrollFourth Pillar | মোহন ভাগবত, মোদিজির মতো বিশ্বাসঘাতকেরা দেশের স্বাধীনতার কথা বলছেন?
Fourth Pillar

Fourth Pillar | মোহন ভাগবত, মোদিজির মতো বিশ্বাসঘাতকেরা দেশের স্বাধীনতার কথা বলছেন?

স্বাধীনতার যুদ্ধে আরএসএস, হিন্দু মহাসভা কোথায়?

Follow Us :

ভারতবর্ষের প্রকৃত স্বাধীনতা এল ২২ জানুয়ারি ২০২৪-এ, জানালেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সরসংঘচালক। সেই অর্থে বিজেপি আরএসএস-এর প্রত্যেকেই কমবেশি উগ্র হিন্দুত্বের কথা প্রকাশ্যেই বলেছেন, তবে অটল বিহারী বাজপেয়ী বা গোবিন্দাচার্য, বা অরুণ জেটলির মতো নেতারা এক ধরনের ভদ্র আচরণের দায়রার মধ্যে থাকতেন, ক্যাডারদের কাছে ভাষণে কিছু বললেও সেটা থাকত ইঙ্গিতে, তাতে উগ্রতা কম থাকত। বাজপেয়ী এমনিতেই তাঁর উইট, মিছরির ছুরির জন্য পরিচিত ছিলেন, সবার কাছেই। কবিতা লিখতেন, ভালো মন্দ খেতেন, নিরামিষ নয়, আমিষ পছন্দ ছিল, কোথাও একটা অন্য মুখও ছিল, যেটা উনি ধরে রাখতে পারতেন। সেখানে আরএসএস-এর অনেক কাছের, হিন্দুত্ব এজেন্ডাকে নিয়ে অনেক বেশি সরব ছিলেন আদবানি, সিংঘল, কাটিয়ার, উমা ভারতী ইত্যাদিরা। কিন্তু এই মুখ আর মুখোশের খুব একটা নীতিগত বিরোধ ছিল না, বরং এই সফট লাইনার, হার্ড লাইনারের মোদ্দা লক্ষ্য ছিল ওই দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াই, যা অনেকেই বারবার বলেছেন, মোহন ভাগবতও বললেন।

কেন দ্বিতীয় স্বাধীনতা? কেন এটাই প্রথম স্বাধীনতা? কারণ প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের লড়াই শেষ হয়েছে ১৫ অগাস্ট, ১৯৪৭। সহিংস, অহিংস পথে লড়েছে দেশের মানুষ, লড়েছেন গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল, আবুল কালাম আজাদ, কংগ্রেসের নেতারা। লড়েছেন নেতাজী। লড়েছেন সূর্য সেন, বিনয় বাদল দীনেশ, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি, অরবিন্দ, বারীন্দ্র, ভগত সিং, আসফাকুল্লা, চন্দ্রশেখর আজাদ। লড়েছে দেশের কৃষক, শ্রমিক, লড়েছে নৌ বিদ্রোহীরা, প্রাণ দিয়েছে ছাত্ররা। আচ্ছা এই প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধে আরএসএস, হিন্দু মহাসভা কোথায়? তাঁরা কী করছিলেন? মহাফেজখানায় রাখা আছে সেই চিঠি, যেখানে একবার নয়, একটা নয়, পাঁচ পাঁচটা চিঠি, যে চিঠিগুলোতে আরএসএস বিজেপির প্রাণপুরুষ সাভারকর ব্রিটিশদের কাছে মুচলেকা দিয়ে মুক্তি চেয়েছিলেন, জেল থেকে বের হতে চেয়েছিলেন। জুলাই ১, ১৯০৯, মদনলাল ধিংরা ইন্ডিয়া অফিস, লন্ডনে গুলি করে হত্যা করলেন স্যর উইলিয়াম কার্জনকে। ডিসেম্বর ২৯, ১৯০৯, অনন্ত কানহেরে গুলি করে মারলেন নাসিকের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ টি এম জ্যাকসনকে। জ্যাকসন একটা থিয়েটার হলে বসে মারাঠি নাটক শারদা দেখছিলেন। দুটো ক্ষেত্রেই অস্ত্র জোগান দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর। বিচারের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হলেন, দুটো টার্মে ৫০ বছরের জেল এবং কালাপানি পার করে আন্দামানে পাঠানোর সাজা দেওয়া হল। তিনি আন্দামানে পৌঁছলেন ৪ জুলাই ১৯১১। ব্যস, বিপ্লবীয়ানার ইতি। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ইংরেজদের কাছ থেকে মুচলেকা দিতে শুরু করলেন। তার চিঠির ভাষা খুব পরিষ্কার, আর কোনওদিনও হবে না, যে কোনও শর্তে আমার মুক্তি চাই। ওই সময়েই জেলে ছিলেন বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, তিনি লিখছেন যে সাভারকর এমনকী ব্রিটিশ জেলারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদেও শামিল হতেন না। কী লিখলেন তিনি ব্রিটিশদের? “The Mighty alone can afford to be merciful and therefore where else can the prodigal son return but to the parental doors of the Government?” এর বদলে তিনি জানালেন, ব্রিটিশরা যেভাবে চাইবে, সেভাবেই তিনি সাহাজ্য করবেন। তিনি বললেন, তাঁকে ক্ষমা দেওয়া হলে, “all those misled young men in India and abroad who were once looking up to me as their guide will seek lesson from it.” মানে তিনি তো আত্মসমর্পণ করছেনই, বাকিদের দায়িত্বও নিচ্ছেন। এই সাভারকর গান্ধী হত্যার দায়েও গ্রেফতার হয়েছিলেন, গ্রেফতার হওয়ার পরেই আবার মুচলেকা, ৩০ জানুয়ারি গান্ধিজীকে হত্যা করা হল, ১৭ দিন পরেই সাভারকর বম্বে পুলিশ কমিশনারকে চিঠি লিখে জানালেন, “I shall refrain from taking part in any communal or political activity for any period the government may require in case I am released on that condition.” আবার মুচলেকা। যখন গডসে কেবল স্বীকার করছেন না, তিনি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলছেন, কেন, কোন কারণে তিনি গান্ধীজিকে হত্যা করলেন, ঠিক তখন, তাঁর মেন্টর মুচলেকা দিয়ে সরে যাচ্ছেন। প্রমাণের অভাবে তিনি ছাড়া পেলেন, কিন্তু জেলের মধ্যে গডসে বা অন্যদের সঙ্গে কথাও বলতেন না। গডসে এইজন্য দুঃখ পেয়েছিলেন, সে কথা বলেওছিলেন। এই হল বিজেপির স্বাধীনতা সংগ্রাম।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় আরএসএস সরাসরি তার বিরোধিতা করেছিল, তার সদস্যদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল, যাতে তারা ব্রিটিশদের সহযোগিতা করে, আরএসএস-এর সদস্যরা তা করেওছিল। এই বাংলায় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ব্রিটিশদের চিঠি লিখে কীভাবে এই আন্দোলন দমন করা যায়, তার উপায় বাতলেছিলেন। তিনি তখন বাংলার মন্ত্রিসভার অন্যতম মন্ত্রী। ওদিকে অটল বিহারী বাজপেয়ী, ব্রিটিশদের কাছে মুচলেকা দিয়েছিলেন, জানিয়েছিলেন, যারা আন্দোলনে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে দেবেন, সে চিঠিও মহাফেজখানায় রাখা আছে। তো দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই ছিল আরএসএস, হিন্দু মহাসভার অবদান। আরএসএস বা হিন্দু মহাসভার একজনও স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেননি, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে জেলে যাননি, যিনি গিয়েছিলেন, তিনি জেল থেকে বেরোনোর জন্য মুচলেকা দিয়েছিলেন। সেই আরএসএস-এর রাজনৈতিক দলের নেতা বলছেন এটা স্বাধীনতা দ্বিতীয় সংগ্রাম, শুনলে হাসি পায়।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষে ১৯৪৭ ১৫ অগাস্ট দেশ স্বাধীন হল, আমরা কী পেলাম? পেলাম এক সংবিধান, যা প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ করেছে, যা প্রত্যেক নাগরিকের ভোটাধিকার সুনিশ্চিত করেছে। পেয়েছি নিজেদের ভোটে নির্বাচিত সরকার, যেখানে আমাদের প্রতিনিধিরা দেশের বিভিন্ন প্রকল্প ঘোষণা করছেন, দেশে এক বিরাট কৃষি বিপ্লব হয়েছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প ক্ষেত্রে অগ্রগতি হচ্ছে। এগুলো আমাদের স্বাধীনতার প্রাপ্তি। অনেক কিছুই হয়নি, আজও দারিদ্র আছে, চূড়ান্ত দারিদ্র, অশিক্ষা আছে, স্বাস্থ্যের অধিকার এখনও সবার জোটেনি, কিন্তু তার জন্য লড়াইও চলছে, সেটাও স্বাধীনতারই ফসল। যতই খর্বিত হোক, রাজনৈতিক স্বাধীনতা আমাদের অনেক প্রাপ্তির উৎসস্থল। এই সংবিধানই আমাদের ধর্ম, লিঙ্গ, জাত, নির্বিশেষে সমানতার অধিকার এনে দিয়েছে।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | দিল্লি কা লাড্ডু হাতে রাখার জন্য আপ-এর ফর্মুলা নম্বর ওয়ান

এবার আসুন আমাদের সরসংঘচালক মোহন ভাগবতের স্বাধীনতায়, দ্বিতীয় স্বাধীনতায়। কেন দ্বিতীয়? প্রথমটাতে আপনারা ছিলেন কোথায়? কী অবদান আপনাদের? বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া কী করেছিলেন ১৫ অগাস্ট ১৯৪৭-এর আগে? সে কথা থাক, ওনার এই ২০২৪, ২২ জানুয়ারি স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাপ্তিগুলোর হিসেব নিকেশ করা যাক। তাঁদের এই তথাকথিত স্বাধীনতা সংগ্রামে কারা অংশগ্রহণ করলো? ওনাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্লোগান কী ছিল? মন্দির ওহি বনায়েংগে, কার মন্দির? রামের। কেন ওহি বনায়েংগে? কারণ হল, ওখানেই নাকি রাম জন্মগ্রহণ করেছিল তাই। তার জন্য কী করতে হবে? বাবরি মসজিদ ভাঙতে হবে। তাহলে দাঁড়াল স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের মুসলমান, ক্রিস্টান, শিখ, পারসি, জৈন, বুদ্ধিস্টরা বাদ। কারণ তাঁরা খামোখা রামের মন্দির বানাতে যাবেন কেন? বাদ বৈষ্ণবরাও, কারণ তাঁরাও রামের পূজারী নয়। বাদ নাস্তিকরা স্বাভাবিক কারণেও, বাদ সেইসব, এমনকী হিন্দুরাও যাঁরা ঘরে পুজোপাঠ করেন কিন্তু মন্দির বানানোর জন্য মসজিদ ভাঙতে হবে, এমন আজগুবি অসভ্য ধারণায় বিশ্বাস রাখেন না। তার মানে দেশের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ বাদ পড়লেন, এই সংগ্রাম থেকে। তারপরেও প্রচুর মানুষ, তাঁরা গেলেন, মসজিদ ভাঙা হল, তারপর মন্দিরের ভূমিপূজনও হল, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পারিজাত বৃক্ষ রোপণ করে শুরুয়াত করলেন, তারপর ২২ জানুয়ারি ২০২৪-এ স্বাধীনতা এল। বেশ। তারপর, এই তথাকথিত দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষে আমরা কী পেলাম? প্রত্যেকের শিক্ষা? স্বাস্থ্য? চাকরি? স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পূর্ণতা পেল, অর্থনীতি ধুঁকছে, জিডিপি নামছে, বেকারত্ব তার রেকর্ড চুড়োয়, শিল্পে মন্দা, মুল্যবৃদ্ধি আকাশ ছুঁয়েছে, এ কেমন স্বাধীনতার পূর্ণতা? কাদের স্বাধীনতা? প্রতি দিন ৮৭ জনের ধর্ষিতা হওয়ার স্বাধীনতা? কৃষকদের আত্মহত্যা করার স্বাধীনতা? ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পের দরজায় তালা পড়ার স্বাধীনতা? ছাঁটাই হওয়ার স্বাধীনতা? কিসের স্বাধীনতা মোহন ভাগবত মশাই?

এবং এই যে স্বাধীনতার কথা বলছেন সেটাও এসেছে গভীর চক্রান্তের পিঠে চেপে। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের পেছনে কোনও চক্রান্ত ছিল না, গান্ধী স্লোগান দিলেন ইংরেজ ভারত ছাড়ো, গান্ধীবুড়ি তমলুকে তেরঙা ঝান্ডা নিয়ে রওনা দিলেন থানার দিকে, গুলি খেলেন, মারা গেলেন মাতঙ্গিনী হাজরা। উনি বলেননি যে বাজার করতে যাচ্ছি, গান্ধীজি কোনও গোপন সার্কুলার দেননি। হিম্মত ছিল ভগৎ সিংয়ের, অ্যাসেম্বলিতে বোমা ছুড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন গ্রেফতার হওয়ার জন্য, যা করার প্রকাশ্যে করেছেন, ঘোষিত লক্ষ্য, ইংরেজ ভারত ছাড়ো। নেতাজি ব্রিটিশ পুলিশদের চোখের সামনে দিয়ে চলে গেলেন রাশিয়া হয়ে জার্মানি হয়ে জাপান, প্রকাশ্যেই স্লোগান দিলেন চলো দিল্লি। মুখে এক, কাজে এক করেননি। ষড়যন্ত্র করেননি। এটা যদি স্বাধীনতার দ্বিতীয় সংগ্রামই হবে সন্ত মোহন ভাগবত তাহলে সেটা ঘোষণা করেননি কেন? বলেননি কেন যে বাবরি মসজিদ ভেঙে রামমন্দির তৈরি করব, এটাই আমাদের লক্ষ্য, সেটাই আমরা করতে যাচ্ছি, আজ দ্বিতীয় স্বাধীনতার গল্প বলছে কারা? যারা প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল? যারা জাতির পিতাকে হত্যা করেছিল? তারা আনবে দ্বিতীয় স্বাধীনতা যারা ব্রিটিশদের কাছে মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিল। রক্তের প্রতিটি কণায় যাদের বিশ্বাসঘাতকতা, তারা বলছে স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা?

RELATED ARTICLES

Most Popular