হ্যাঁ, সেই চার্টার্ড প্লেনের কথা মনে আছে, কারা কারা চড়েছিল? ওফফ সে কী রোমাঞ্চকর যাত্রা, যাওয়ার সময়ে সেই প্লেন মিস করেছিল কেবল রুদ্রনীল ঘোষ। দুনিয়ায় যা কোনওদিন কেউ দেখেনি, দেখেছিল বাংলার মানুষ, বিজেপির যোগদান শিবির, সমাবেশে, মিছিলে, জনসভায় দলে দলে যোগ দিন তো বাংলার মানুষ শুনেছে সেই কবে থেকে, সেদিন শুনেছিলাম দলে দলে যোগ দিন, কোথায়? বিজেপিতে। মুকুল রায়ের চওড়া হাসি, দিলীপ ঘোষ নিজে হাতে ফ্লাগ তুলে দিলেন রিমঝিমের হাতে, ওদিকে জনসভায় অমিত শাহের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন শুভেন্দু অধিকারী। সেদিন বাংলার মানুষ দেখেছিল, বিজেপির পুরনো কর্মীরা হাঁ করে তাকিয়ে দেখেছিল, শুভেন্দু অধিকারীও বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন, কারও কারও পিঠে লাঠির ঘা, কানের গোড়ায় মারা থাপ্পড়ের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। রাজ্যজুড়ে বিজেপি যোগদান শিবির চলছিল, উত্তরপাড়ার অকৃতজ্ঞ বিধায়ক থেকে রাজীব ব্যানার্জি চলিলেন হেলিতে দুলিতে আর সেসব যখন চলছে তখন এক সিনিয়র সাংবাদিক টিভির কলতলার রুটিন ঝগড়ার সময়ে বলেছিলেন তৃণমূলের লক স্টক ব্যারেল যোগ দেবে বিজেপিতে, ভোটের দিন আসতে আসতে তৃণমূলে পিসি ভাইপো ছাড়া কেউ পড়ে থাকবে না। না, সেরকম হয়নি, অনেকেই বেড়ার উপরে বসেছিলেন বটে, কিন্তু তা ছিল পরের আশ্বাস, ১২০টা আসনে জিতলে লাফ দেওয়ার আশ্বাস। হ্যাঁ, সেই তালিকাতে মন্ত্রীরাও ছিলেন, কোথায় কোথায় বসে বৈঠক হয়েছে, তা অনেকে জানেন, জানেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। না, তাঁরা ওমুখো হওয়ার চান্স পাননি এবং এখন আর ওমুখো হওয়ার রিস্ক নেবেন না, হ্যাঁ, এবারে খেলা উল্টোদিকে ঘুরছে, এবারে বিজেপির চিন্তা কোন উইকেটটা পড়বে? কোন তারাটি খসবে? আর তাই অক্ষমের ঘোষণা এবারে আর দলবদলে ধুনো দেওয়া হবে না, বা কেউ যদি আসেও তাকে টিকিট দেওয়া হবে না, মানে বিজেপির আপাতত বঙ্গ নেতারা বুঝেছেন সেদিন ভুল হয়েছিল, সেটাই বিষয় আজকে, আর কোনও শুভেন্দু নয়, বিজেপির সিদ্ধান্ত।
এ খবর সব্বাই জানেন যে গতবারের সেই বর্গির ছেলে এবারে নেই, এবারে সুনীল বনসল। তো গত সপ্তাহেই বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক সুনীল বনসল শুভেন্দু অধিকারী এবং শমীক ভট্টাচার্যকে জানিয়ে দিয়েছেন, ভোটের আগে অন্য দল ভাঙানো যেতেই পারে। তবে দলবদলুদের বিধানসভা ভোটের টিকিট দেওয়া হবে না। সাধারণ কর্মী হিসেবেই কয়েক বছর তাঁদের বিজেপিতে কাজ করতে হবে। সেই পরীক্ষায় পাশ করলে তবেই তাঁদের পার্টিতে গুরুত্ব বাড়ানোর কথা ভাবা যেতে পারে। কী কঠিন শর্ত মাইরি? আসুন একটু অঙ্ক কষে দেখা যাক।
আরও পড়ুন: Aajke | বিধানসভা এবং কমরেড সুজন চক্রবর্তীর কিছু কথা
আচ্ছা এ রাজ্যে কোন দলকে ভেঙে বিজেপি তার ক্ষমতা বাড়াতে পারে? সিপিএম বা কংগ্রেসের কাকে ভেঙে বিজেপির শক্তি বাড়বে? তলায় ভোট ট্রান্সফার করা টগর বোষ্টমী সিপিএম-এর কোনও নেতা হাত বা মুখ পোড়াতে রাজি হবেন না। কংগ্রেসের মধ্যে একমাত্র ভালনারেবল ক্যান্ডিডেট অধীর চৌধুরী, কিন্তু সম্ভবত তিনিও জানেন যে আম ছালা সব যাবে, কাজেই মনে হচ্ছে না উনি এরকম কোনও অ্যাডভেঞ্চারে নামবেন। তাহলে পড়ে রইল তৃণমূল। হ্যাঁ আসতেই পারেন, কিন্তু এই শর্ত মেনে? এমএলএ আসনে লড়তেই দেওয়া হবে না? তাহলে বসে বসে কী করবেন? ঘাস কাটবেন? এ রকম ‘কঠিন আর অবাস্তব শর্ত’ আরোপ করার পরে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে একজনও বিধানসভা ভোটের মুখে পদ্ম–শিবিরে নাম লেখাতে চাইবেন কি না বলে কি কেউ বিশ্বাস করেন? ২০২১–এর বিধানসভা নির্বাচনে দলবদলুদের উপরেই বাজি ধরেছিল বিজেপি। গতবারে দলের তৎকালীন কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়র উদ্যোগেই মূলত পুরোনো বিজেপি নেতাদের ছেঁটে দলবদলুদের টিকিট দেওয়া হয়েছিল। যা নিয়ে তীব্র আপত্তি তুলেছিলেন দিলীপ ঘোষরা। তবে সেই আপত্তি টেকেনি। তিনি দিল্লির শীর্ষ নেতাদের বুঝিয়েছিলেন, বঙ্গ–বিজেপি নেতাদের রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটানোর মুরোদ নেই। ফলে কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলতে হবে। অর্থাৎ, তৃণমূল থেকে আসা নেতাদের বিজেপি প্রার্থী করে অফিসিয়াল তৃণমূলকে হারাতে হবে। কৈলাসের এই কৌশল ডাহা ফেল মেরেছিল। অধিকাংশ দলবদলুই গো–হারা হেরেছিলেন কেবল নয় ভোটের পর দিন থেকে তাঁরা দিদির চরণে সেবা লাগে বলে কালীঘাটমুখো হয়ে বসেছিলেন। কাজেই আর শুভেন্দু আখ্যানের পুনরাবৃত্তি নয়, সিদ্ধান্ত নতুন রাজ্য সভাপতির এবং দিল্লির পর্যবেক্ষকের। এবং শোনা যাচ্ছে দলের আপাতত বিধায়কদের মধ্যেও আবার কতজন আদতে মমতা বা অভিষেকের গুপ্তচর নয়, তা তন্নতন্ন করে খোঁজা হচ্ছে। দিলীপ ঘোষ নাকি বলছেন পালের গোদাটার সঙ্গেই পুরনো দলের সম্পর্ক সব থেকে ভালো, সরকারের সাহায্য নিয়েই নাকি তাঁর ব্যবসা চলছে। তো জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওই পালের গোদাটা কে? উনি বলেছেন আপাতত বুঝে নিন, সময় এলে সব জানাব। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, একে তো রমরমা বাজার তৃণমূলের, তারাই শাসন ক্ষমতায়, অন্যদিকে খুউউব হিসেব ইত্যাদি করেও তৃণমূল আর বিজেপিতে এমনকী একটা জোরদার মোকাবিলা হবে, সেটাও কেউ ভাবছে না। তাহলে গতবারের মতো তৃণমূলের নেতাদের এক বড় অংশ বা তৃণমূলের কোনও বড় নেতাকে কি ২০২৬-এর আগে দল বদলাতে দেখা যাবে? শুনুন কী বলেছেন মানুষজনেরা।
২০২৬-এর আগে বিজেপির কাছে বহু ইস্যু আছে, কিন্তু সেই ইস্যুগুলো একে একে শুকিয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতির ইস্যুতে দম নেই কারণ তাদের অধীনে থাকা ইডি বা সিবিআই এই বাংলার একটা দুর্নীতিরও কিনারা করতে পারেনি, প্রত্যেক অভিযুক্ত দোষী উল্টে জামিন পেয়ে যাচ্ছে। অভয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা, চাকরি দুর্নীতি নিয়েও একই অবস্থা। উল্টে শিক্ষকদের পরীক্ষা হয়ে গেল, নির্বিঘ্নেই হল, বাইরের রাজ্য থেকেও পরীক্ষা দিয়ে গেলেন অনেকে। অন্যদিকে ২১-এর দলবদলের ঘা শুকিয়ে তো যায়ইনি, উল্টে তা আরও দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, ঠিক তাই এবারে নির্বাচনের বহু আগেই রাজ্য বিজেপির ঘোষণা আর শুভেন্দু কাণ্ড চাই না, দলবদলুদের নিয়ে লাভ হচ্ছে না, এটা ঘোষণা করেই বলছে বিজেপি। দিলীপ ঘোষ মুচকি হাসছেন, কারণ গতবারে এই দলবদলের তত্ত্বকে তিনিই প্রথম মানতে চাননি, পরেও বিরোধিতা করেছিলেন।