‘সো যা নহিঁ তো গব্বর আয়গা,’ এই যে ভয় দেখানো, কেন বলুন তো? বাচ্চাটা যেন চুপ করে খাবারটা খেয়ে শুয়ে পড়ে। আমাদের ছোটবেলায় একানড়ে, ব্রহ্মদত্যি বা সাদা শাড়ির পেত্নীরা ঠিক খাবার আগেই এসে হাজির হত, মনে আছে? ওই একই ব্যাপার, ভয় দেখিয়ে কাজ হাসিল করা। সবচেয়ে ডানপিটে ছেলেটারও তখন চোখ বড় হয়ে গিয়েছে, মুখে যা দিচ্ছে কোঁৎ করে গিলে নিচ্ছে। পৃথিবীতে সমস্ত ভয়ের পিছনেই এই একই কারণ থাকে, ভয় দেখিয়ে আসলে একটা কাজ করিয়ে নেওয়া কিছু একটা হাসিল করা, এক অলীক জুজুকে খাড়া করে আসলে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করা। না হলে দেখুন না, প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর ইসলামিক শাসনের সময়ে, তার পরে প্রায় দু’শ বছরের খ্রিস্টান শাসনের সময়ে আমরা কখনও শুনিনি যে, ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’। সেই সাংঘাতিক মোঘল আমলেই বেনারসের আসসি ঘাটে বসে তুলসীদাস ‘রামচরিত মানস’ লিখেছেন, তার একটা ঘাট পরেই কবীর লিখছেন ‘দোহা’। পাথর পুজো করলেই যদি ভগবান মিলে যায়, তাহলে আমি পাহাড় পুজো করব! রোজ চান করলেই যদি ভগবান কে পাওয়া যায়, তাহলে জলজন্তুরা কী দোষ করল? দারাশুকো রামায়ণের অনুবাদ করছেন। কই তখন তো শুনিনি ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’। ইন ফ্যাক্ট স্বাধীনতার পরেও কি আমরা এমন কথা শুনেছি? যখন আজকের হিন্দু হৃদয় সম্রাট দেশের ক্ষমতায় এলেন, ঠিক তখন থেকে আমরা শুনতে শুরু করলাম, ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’। হ্যাঁ, এটাও সেই ভয় দেখানো। ভয় দেখিয়েই হিন্দু ভোটের মেরুকরণ ঘটানো যাতে নাকি ক্ষমতায় থাকা যায়। ঠিক সেরকম এক আতঙ্ক ছড়িয়েছে এসআইআর-কে ঘিরে। এসআইআর নয় তো যেন গব্বর সিং! এটাও সেই আতঙ্ক ছড়ানো, এবং নিশ্চিতভাবেই জানবেন সেই আতঙ্কও এমনি এমনি ছড়ানো হচ্ছে না। সেটাই বিষয় আজকে, এসআইআর নিয়ে আতঙ্ক কারা তৈরি করল, কেন করল?
সাকুল্যে ৪০ জনের মত সাধারণ মানুষ আর বিএলও, মানে সরকারি কর্মচারী মারা গিয়েছেন। হ্যাঁ, কেবল আতঙ্কে। কেউ হার্ট ফেল করে, কেউ সেরিব্রাল স্ট্রোকে, কেউ বা গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছেন। মানে এমন নয় যে, যাঁদের নাম নিয়ে সমস্যা আছে, যাঁদের ২০০২-এর লিস্টে নাম নেই, এরকম কারণে কেবল ভোটারদের মনেই আশঙ্কা, ভয় আছে। সেই সব সরকারি, আধা সরকারি কর্মচারীদের মনেও আছে, একই ভয় আছে। তাঁরাও মারা যাচ্ছেন, আত্মহত্যা করছেন। এক ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে এই এসআইআর। খেয়াল করে দেখুন, বিহারে এসআইআর সবে শুরু হচ্ছে, একটা প্রচারে নামলেন মোদিজি, অমিত শাহ, বিজেপি, ‘সব ঘুসপেটিয়া কো নিকালেঙ্গে’। বিহারে কারা ঘুসপেটিয়া? নেপাল থেকে আসা মদেশিয়ারা, কিন্তু মুখে বলা হতে থাকল বাংলাদেশি মুসলমান। হ্যাঁ, তখন থেকেই বোঝা গিয়েছিল, বিহার আসলে টেস্ট কেস, আসল প্রয়োগ এই বাংলাতে। রেজাল্ট আসার সঙ্গে সঙ্গে ‘আমাদের এবারে বাংলা চাই’, ‘বিহার হমারি হ্যায়, অবতো মমতা দিদি কি বারি হ্যায়’। ঠিক সেই সময় থেকে শুরু হল শুভেন্দু অধিকারীর চিল চিৎকার, এক কোটি রোহিঙ্গা, দেড় কোটি রোহিঙ্গা, দু’কোটি অনুপ্রবেশকারীদের নাম কাটা যাবে। হ্যাঁ, এটাই ছড়াল চার ধারে। তৃণমূলও বুঝতে পারল, এই আতঙ্ককে তাদের পালে আনতে পারলে জয় সুনিশ্চিত। এই এলেক্টোরাল পলিটিক্সে কেউ এই সুযোগ ছাড়ে নাকি! মমতা হুঙ্কার দিলেন, “একটা নাম কাটতে দেব না”, শুভেন্দু ভাষণে বলছেন, “আজ রাতেই গ্রাম ছেড়ে চলে যান”, সকালে তৃণমূল নেতা গিয়ে বলছেন, “আমরা আছি পাশে”।
আরও পড়ুন: Aajke | লালমোহন বাবুর বাজে কপি, আমাদের রাজ্যপাল গেলেন মুসলমানদের পলায়ন দেখতে
ভোটার লিস্ট সংশোধন পড়ে রইল পাশে, সর্বত্র ছড়াল এক আতঙ্ক। তাহলে কি নাম কাটা যাবে? আমার নাম ফাইনাল লিস্টে থাকবে তো? বিজেপি এই আতঙ্ক ছড়ানোর কাজটা শুরু করেছিল এই ভেবে যে, আতঙ্কিত মানুষ তাদের শ্মরণাপন্ন হবেন, কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই সেই আতঙ্ককেই কাজে লাগিয়ে এখন তৃণমূল খেলাটাকে অন্য লেভেলে নিয়ে গিয়েছে। এখন তো খেলা শুরু, এরপরে লিস্ট বার হলেই তৃণমূল বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়বে তাদের কাগজের যোগান দিতে, আপিল করতে। নাম কাটা যাওয়া একজনও কি বিজেপির দফতরে যাবেন? তখন ওই দুয়ারে তৃণমূল নামবে প্রবলেম সল্ভ করতে, ‘ম্যাঁয় হু না’। মিলিয়ে নেবেন, ক’দিন পরেই অভিষেকের ছবি আর পাশে এই ছোট্ট ডায়ালগ, ‘আমি আছি’, মমতার ছবি, ‘আমি আছি’তে ভরে যাবে দেওয়াল। বিজেপি আতঙ্ক ছড়িয়েছিল বটে, কিন্তু অন্তত এবারে তার ফসল তুলতে পারল না, আর নেপোয় দই খেয়ে চলে গেল। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, শুভেন্দু অধিকারীর “দু’কোটি ভোটারের নাম বাদ পড়বে” এই কথা থেকেই যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে, সেই আতঙ্কের ফলেই কি তৃণমূলের সমর্থন বাড়ছে? এই ভয় কি আদতে তৃণমূলের দিকেই মানুষজনকে ঠেলে দিল?
এমনিতে একটু মাথা খাটালেই বোঝা যাবে যে, তৃণমূলের কাছে বেশ কিছু সরকারি প্রকল্পের সাহায্য পাওয়া এক বড় সংখ্যক মানুষের সমর্থনের বাইরে আর কী ছিল। তৃণমূলের বিরুদ্ধে ছিল দুর্নীতির বড় বড় অভিযোগ। বিজেপির বিরুদ্ধে ছিল বাঙালি বিরোধীতার অভিযোগ, বাংলাকে বঞ্চনা করার অভিযোগ। তৃণমূলে দলের মধ্যের ঝামেলা আপাতত কম। বিজেপিতে অনেকটা বেশি। কিন্তু এই এসআইআর এসে তৃণমূলের হাতে এক ব্রহ্মাস্ত্র তুলে দিয়ে গেল, মাঠে নামার আগেই দশ গোল খেয়ে বসে আছে বিজেপি, এবার থেকে হারার আতঙ্ক তাদের ঘিরে ধরবে।
দেখুন ভিডিও:








