খোদ মুখ্যমন্ত্রীই বলেছেন যে, গতকালের ঘটনা অবাঞ্ছনীয়। আমরাও বলছি, এটা সভ্য সমাজের রীতি নীতির বিরুদ্ধে। সংখ্যাগরিষ্ঠের গুন্ডামিকে গণতন্ত্র বলা যায় না, জনরোষ ইত্যাদিও বলা যায় না। তাহলে দেশের আর বাকি বহু জায়গাতে যেখানে বিজেপি বিরোধী দলের কর্মীদের মারা হচ্ছে, পেটানো হচ্ছে, ঘর ভেঙে দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোও জনরোষ বা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামত বলে ধরে নিতে হবে। কিন্তু তা তো নয়, কাজেই এই ঘটনাকে নিন্দনীয় বলেই কটা কথা বলা যাক। এই ঘটনা কটা জিনিস আমাদের সামনে এনে দিল। উত্তরবঙ্গ যেখানে নাকি বিজেপির দূর্গ, যেখানে থেকে তাঁদের ৭৫ শতাংশ এমপি, এমএলএ, সেখানে তাঁদের নেতাদের চড়-চাপাটি খেতে হচ্ছে। একজন কর্মীও পাশে নেই, রুখে দাড়ানোর মতো? শিলিগুড়ির এমএলএ নাগরাকাটা গেলেন, সঙ্গে ছিলেন মালদা উত্তরের বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু। তো সেই নাগরাকাটাতেও তো বিজেপির এমএলএ আছেন পুনা ভেঙ্গরা, তিনি কোথায় ছিলেন? তাঁর কর্মী সমর্থকরা কোথায় ছিলেন? আমাদের কাছে কেবল নয়, প্রত্যেক সংবাদমাধ্যমের কাছে ভিডিও মুহুর্তের মধ্যে পৌঁছে দিল কে? তার একটাতেও কেন কোনও একজনও বিজেপি কর্মীকে দেখা যাচ্ছে না। মানে নেতারা যাচ্ছেন, তাও যে সে নেতা নয়, শঙ্কর ঘোষ – উত্তরবঙ্গের এই সময়ে সবথেকে বড় নেতা। সেখানে এমএলএ সাহেবের একজনও কর্মী নেই। ধাক্কা মারা হচ্ছে, চড়-চাপাটি পড়ছে, অন্তত কেউ তো একজন বলবে, মারছেন কেন? কেউ নেই। কেন নেই? হ্যাঁ, বারো-চোদ্দ ঘন্টা পর থেকে এই প্রশ্ন উঠছে। ওঠাটা স্বাভাবিক। এ তো গণশার শশুরবাড়ি যাওয়া নয়, এক সাংসদ, এক এমএলএ, বিধানসভায় বিজেপি দলের চিফ হুইপ। সেটাই বিষয় আজকে, শঙ্কর ঘোষ, খগেন মুর্মুর উত্তরবঙ্গ অভিযান।
এর আগে আমরা দিলীপ ঘোষকে দেখেছিলাম দুম করে ঢুকে পড়তে। তখন পাহাড়ে জব্বর বিজেপি বিরোধী হাওয়া, দিলীপ ঘোষ তাঁর দলবল নিয়ে ঢুকেছিলেন, ধাক্কাধাক্কি হয়েছিল, কিন্তু খুব বেশি কিছু হওয়ার আগেই বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন। আমরা দেখেছিলাম এক গোলমেলে উত্তেজিত ভিড়ে লাথি খেয়ে জয়প্রকাশ মজুমদারকে, তিনি তখন বিজেপিতে ছিলেন, কচুবনে পড়ে থাকতে দেখেছি। এদিক থেকে বামেরা অনেক সতর্ক, আগে থেকে লোকজন জোগাড় করে তবেই এলাকাতে যান, এবং একটা ব্যাক আপ টিমও থাকে। কিন্তু এ রাজ্যে বিজেপির নেতারা মাঝে মধ্যেই হুট বলতে ঝুট ঢুকে পড়েন, মারধোর খান, এ তো নতুন কিছু নয়।
আরও পড়ুন: Aajke | সজলের ছ্যাবলামি, শুভেন্দুর ফুচকা
কিন্তু কথা হল, এক হঠাৎ বন্যা পরিদর্শনে যাওয়া এমএলএ, এমপি-কে খুব পরিকল্পিতভাবে ঠ্যাঙানো হল, তা তো নয়। এটা বুঝিয়ে দেয় যে, এলাকাতে ভোট তো আছে, লোক নেই। বুঝিয়ে দেয়, যাঁরা বিজেপিকে ভোট দেন, তাঁরা এখনও মুখোমুখি লড়ে যাওয়ার মতো দম সঞ্চয় করে উঠতে পারেননি। এটাও বোঝায় যে, ২৬-এর মহারণের মাত্র ক’মাস আগে এতবড় এক দুর্যোগকে রাজনৈতিক উপাদানে তৈরি করার মত সাংগঠনিক ক্ষমতা এমনকি উত্তরবঙ্গেও, বিজেপির নেই। কলকাতায় জল জমল, সজল ঘোষের কিছু বাইট ছাড়া কিছুই নেই! শুভেন্দু অধিকারী কি দান ছেড়ে দিয়েছেন, এবারে হবে না বুঝেই গেছেন? উত্তরবঙ্গে এত বড় বিপর্যয়, ২৩ থেকে ২৪ জনের মৃত্যু। কিন্তু তাকিয়ে দেখুন নিজেদের এলাকাতেই মার খাচ্ছেন দলের এমএলএ, এমপি-রা। অনেকে বলছেন এই দু’জনকে নাকি ডেকে নিয়ে গিয়ে মার খাওয়ানো হল। খুব অবাক হওয়ার কিছু নেই, মেরেছে নিশ্চয়ই তৃণমূলের তলার সারির অতি উৎসাহী কর্মীরা। কিন্তু নেতাদের আড়াল করার লোকজনদের সম্ভবত আগে থেকেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যার ফলে এক্কেবারে অসহায় ছিলেন ওনারা। বঙ্গ বিজেপিতে এটা হতেই পারে, প্রত্যেকটি নেতা নেত্রী এখন কালীদাস। এ ওর ভিডিও তুলে দিচ্ছে, সে তার কাগজ লিক করে দিচ্ছে। কাজেই ডেকে নিয়ে গিয়ে বাঘের মুখে ফেলে আসাটা একটা ষড়যন্ত্র হতেই পারে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করছিলাম, উত্তরবঙ্গে নাকি বিজেপির এত শক্তি, সেখান থেকেই তাঁদের এতজন এমএলএ, এমপি, তাহলে সেখানেই দু’জন বড় নেতা এরকমভাবে অসহায়ের মত পাবলিকের তাড়া খেলেন কেন?
এবারে আরও দুটো দামি কথা। (১) দেশজুড়ে বাঙালি, বাংলাভাষায় কথা বললেই মার খাচ্ছে, তাঁদের হাজতে পোরা হচ্ছে, শুনেছেন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী একটা কথাও তা নিয়ে বলেছেন? সেই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে একটা কথাও বলেছেন? না বলেননি। কিন্তু গতকালে ঘটনার পরে তিনি চটজলদি রিঅ্যাকশন জানিয়েছেন, তীব্র নিন্দা করেছেন, যা প্রমাণ করে উনি দেশের প্রধানমন্ত্রীই নন, উনি বিজেপির প্রধানমন্ত্রী। (২) সিপিএম-এর রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমকে যত দেখি তত অবাক হই। এত নিম্ন মেধা, নিম্ন বুদ্ধির মানুষ কী করে সেই আসনে বসেছেন, যে আসনে প্রমোদ দাশগুপ্ত, সরোজ মুখার্জি, অনিল বিশ্বাসেরা বসেছিলেন। গতকাল তিনি অ-আরএসএস, বিজেপি বলে একটা ব্যখ্যা দিয়েছেন। মানে বিজেপিতে এমন এমএলএ, এমপি’ও আছেন, যারা আরএসএস-এর বাইরে, মানে আরএসএস-এর আওতার বাইরের বিজেপির সন্ধান পেয়েছেন এই হামবাগ নেতা। শঙ্কর ঘোষ, খগেন মুর্মু সেই অ-আরএসএস, বিজেপি যাঁরা আগে সিপিএম ছিলেন, সেটা ফলাও করে তিনি বলেছেন। এই মানুষটি সিপিএম-এর নেতৃত্বে থাকলে দল শূন্য নয়, এবারে নেগেটিভে রান করবে।