যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। আজ বিষয় ভোটার লিস্ট, হ্যাঁ, ভোটার লিস্টে ভটভটি।
ভটভটির গল্পটা বলে নিই। সেবার ক্যানিংয়ে গিয়েছিলাম, নদীর ধারে একটা গ্রামের পাশেই এক রিসর্টে। তো এদিক সেদিক ঘোরা, গ্রাম দেখা, মাছের বাজার থেকে কাঁকড়া আর পায়রাচাঁদা কিনে এনে খাওয়া ইত্যাদিই ছিল আমাদের সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্য আর ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, তো এই সুযোগে একদা আরএসপি-র দুর্গ ওই বাসন্তী ক্যানিংয়ে তৃণমূল কতটা জমি পেয়েছে তার খোঁজ নেওয়াটাও ছিল ওই রথ দেখা কলা বেচার মতো এক কাজ। তো ওখানে গিয়েই হেলে, হ্যাঁ, তাঁর ভালো নাম, খারাপ নাম ওই হেলে দলুই ছিলেন আমাদের পাইলট, তিনিই জানালেন চাইনিজ মোটর লাগানো তাঁর ভটভটিতে নাকি অনায়াসে এলাকা ঘোরা যাবে, দামদস্তুরের পরে বোঝা গেল তাঁর এক অসামান্য মুদ্রা দোষ আছে, যে কোনও গন্ডগোলকেই তিনি ভটভটি বলে ডাকেন। আমরা খাঁটি খেজুর রসের সন্ধানে গিয়েছিলাম, তো যিনি দেবেন তাঁকে হেলে আগে থেকেই শাসিয়ে রাখল, রসে আবার ভটভটি মেশাস না যেন। একজনের সঙ্গে কথা বলছিলাম জানতে চাইছিলাম চাষবাসের অবস্থা কী রকম। তাকে হেলেবাবু শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছিলেন ঠিক করে বলবি, ভটভটি মিশিয়ে বলিসনিকো। কাঁকড়া পিস হিসেবে বিক্রি হয়, সেদিন জেনেছিলাম, তো হেলে তাকেও বলল দেখে দিবি, ভটভটি মিশিয়ে দিস না। সেদিন জেনেছিলাম মরা কাঁকড়াও জ্যান্ত কাঁকড়াদের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়, আমাদের হেলে বাবু জানিয়েছিলেন, ওরা তো গরিব মানুষ, তো এইসব ভটভটি মিশিয়ে খানিক রোজগার করার চেষ্টা করে, এই ছিল হেলেবাবুর বুঝিয়ে বলা। তো সেই থেকে আমাদের নিজস্ব আলোচনাতেও সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়েছে ওই ভটভটি, গোলমাল বা ভেজাল দেখলেই আমরা বলি ভটভটি মেশাচ্ছে। আজ তাই ওই ভোটার লিস্ট আর ভটভটির কথা বলতে বসেছি। মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, দিল্লি সর্বত্র এক অপ্রত্যাশিত হারের ব্যাখ্যায় উঠে এসেছে ভোটার লিস্টে ভয়ঙ্কর গরমিলের অভিযোগ। কোথাও কোথাও নাকি ভুয়ো ভোটারের সংখ্যা ১৫-২০ শতাংশ। আর তা যদি সত্যি হয় তাহলে গণতন্ত্রের অন্যতম উপাদান নির্বাচনই হয়ে উঠবে এক ফার্স, এক হাস্যকর নাটক। মানুষের রায়ের প্রকৃত প্রতিফলন ছাড়া গণতান্ত্রিক কাঠামো টিকবে না।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | যাদবপুর, যাদবপুর
এবারে আসুন দুটো দিক থেকে এই অভিযোগের উপাদানগুলোকে ব্যাখ্যা করা যাক। এই অভিযোগ আসার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের একটা সাধারণ দাবি উঠবে, যে তাহলে এই অভিযোগের তদন্ত হোক। এমন গুরুতর অভিযোগের তদন্ত হওয়াটাই তো উচিত। কিন্তু সেখানেই প্রথম প্রশ্নটা দাঁড়িয়ে আছে, নির্বাচন কমিশন যদি কারও নির্দেশমতো চলে, সে যদি তার নিরপেক্ষতা হারিয়ে এক দলের নির্দেশে কাজ করে তাহলে তদন্তটা করবে কে?
কেন এই প্রশ্ন উঠছে? উঠছে কারণ এর আগে চিফ ইলেকশন কমিশনার বাছার জন্য তিনজনের একটা প্যানেল ছিল, সেখানে ছিলেন চিফ জাস্টিস অফ ইন্ডিয়া, প্রাইম মিনিস্টার অফ ইন্ডিয়া আর সংসদে বিরোধী দলের নেতা। একটা আপাত হলেও ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা ছিল, কারণ তৃতীয় জন, ওই সর্বোচ্চ আদালতের মুখ্য বিচারককে এক নিরপেক্ষ মত বলে ধরে নিতে অসুবিধে ছিল না। এবারে খুব সন্তর্পণে সেই তিনজনের প্যানেলকে বদলে দেওয়া হল, চিফ জাস্টিসকে সরিয়ে একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীকে সেই জায়গাতে বসানো হল। মানে খেলা এখন পরিষ্কার ২–১। কাজেই একজন মুখ্য নির্বাচনী অফিসার নিয়োগ হচ্ছে যিনি সরকারে থাকা দলের খুব কাছের লোক, সেই দলের লোক এমনকী এক কাঠপুতুল হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। যার ফলে যে কোনও অভিযোগের তদন্তের প্রশ্নটা এখন আরও এক বড় নাটক হয়ে উঠেছে। এবং সমস্যা হল যদি এই ভুয়ো ভোটারের যে অভিযোগ তার সঠিক তদন্ত এবং তারপরে সেই অভিযোগের নিরসন না হয়, যে অভিযোগ উঠেছে তা যদি অভিযোগই থেকে যায়, তাহলে দেশের এক বিরাট সংখ্যক মানুষ এই নির্বাচন নামক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মেনে নিতে অস্বীকার করবে এবং সময় মতো সেই রাগ, সেই জমে থাকা ক্রোধ আগুন বর্ষাবে। তাকিয়ে দেখুন বাংলাদেশের দিকে, দিনের পর দিন এক চাপিয়ে দেওয়া অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কীভাবে ভেঙে পড়ে। হ্যাঁ, এটা হল প্রথম কথা। দ্বিতীয় কথা হল, এই বাংলাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে বিষয়টা তুললেন তা মানুষের কাছে এক বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়াবেই, মানুষ বলতে শুরু করেছে আমাদের ভোট চুরি হচ্ছে। হ্যাঁ, এটাই আগামী নির্বাচনের এক বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে, আদতে আমাদের রাজ্যের রাজনৈতিক সচেতনতার ইত্যাদিতে না গেলেও বলাই যায় যে নির্বাচন নিয়ে মানুষের এক অসম্ভব আবেগ কাজ করে, সেই জায়গাতে নির্বাচন শুরুর আগেই এত বড় অস্ত্র তৃণমূলের হাতে গেলে তারা অনেকটা এগিয়ে থেকেই দৌড় শুরু করবে, এটা বলাই বাহুল্য। সবমিলিয়ে মোদি-শাহের সরকার বা বিজেপি দলকে কেবল গণতন্ত্রের কথা বললেই হবে না, গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত নির্বাচনকে অবাধ এবং নিরপেক্ষ করার যথেষ্ট ব্যবস্থা করতে হবে। আর যতদিন পর্যন্ত ওই মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের পদে এক জো হুজুরকে বসানো হবে ততদিন মানুষের মন থেকে এই সন্দেহ উপড়ে ফেলা অসম্ভব। মোদ্দা কথা হল ভোটার লিস্টে ভটভটি মেশানোর ব্যপারাটা মানুষের মনে ধরেছে আর সেই সন্দেহ আগামিদিনে বিজেপির বিরুদ্ধেই কাজ করবে।