যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন।
সেই ১৯৫৬-তে মজরুহ সুলতানপুরির লেখা ও পি নাইয়ারের সুর, সিনেমার নাম সিআইডি আর সমশাদ বেগমের গলায় সেই বিখ্যাত গান ‘কহি পে নিগাহে, কহি পে নিশানা’। হ্যাঁ, দৃষ্টি এক জায়গায় কিন্তু লক্ষ্য অন্য কোথাও। পুরনো খেলা। গুলিয়ে দেওয়ার খেলা। আপনার দেখলে মনে হতেই পারে যে মেসি ডান দিকের গোলপোস্টটার দিকেই তাকাচ্ছেন, সেখান দিয়েই বলটা পুরে দেবেন, কিন্তু না, তিনি বাঁদিকের জমি ঘেঁষে বল গোলে পাঠিয়ে দিলেন। কহি পে নিগাহে, কহি পে নিশানা। তো আমাদের রাজনীতিতে এই খেলাটা কিন্তু বহু পুরনো। শশী থারুর সিপিএম বা এলডিএফ সরকারের খানিক প্রশংসা করছেন বলে ভাবার কোনও কারণই নেই যে তাঁর নজর ওই দিকেই আছে। হঠাৎ নজর এক্কেবারে ঘুরে যেতে সময় নেয় না। নীতীশ কুমার বা জর্জ ফার্নান্ডেজ প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জনসংঘ আর আরএসএস-এর দ্বৈত সদস্যপদ নিয়ে সবথেকে উল্লেখযোগ্য বক্তৃতা দেওয়ার পরে অনায়াসে জর্জ চলে গিয়েছিলেন বিজেপির দিকে, কেউ বোঝার আগেই পাল্টি খেয়ে যান পালটুকুমার নীতীশ বাবু। তো সেরকম দুজনের কথা আজ। প্রথমেই আমাদের দেশের প্রধান সেবকের কথা, তিনি তো দেশ সেবার কথা বলতে বলতে ঘুম থেকে ওঠেন আর একই কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েন, সেই তিনি আমেরিকা যাচ্ছেন। কী নিয়ে কথা হবে? পিছমোড়া করে পাঠানো হচ্ছে ভারতীয়দের, হোক না অবৈধ অভিবাসন, তা বলে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হবে? আমরা ভেবেছিলাম মোদিজি সেটা নিয়ে কথা বলবেন, কারণ তাঁর ছাতি ৫৬ ইঞ্চির। আমাদের দেশ কেন এত শুল্ক বসায়? কেন এই আমদানি শুল্ক দিতে হবে? এসব প্রশ্ন সেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য যাঁর জন্য তিনি স্লোগান দিয়েছিলেন, আব কি বার ট্রাম্প সরকার। তো সেসব প্রশ্নের জবাবে কি বলেছেন যে কেন আমাদের দেশের ব্যবসার এই সংরক্ষণ দরকার আছে? বলতে পেরেছেন? বলেননি। আসলে ওই আমেরিকা যাত্রা ছিল দেশের সঙ্গে চুক্তির, দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের, দেশের বিজ্ঞান প্রযুক্তির জন্য এমনটা বলা হলেও আসল লক্ষ্য তো ছিল আলাদা। এবং দেখুন এমনকী আমদের ওষূধ রফতানির উপরে ২৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে আমেরিকা, তারপরেও ওই ৫৬ ইঞ্চির মুখে কোনও কথা নেই। নেই কারণ আসল লক্ষ্য ছিল আদানির জেল খালাস। হ্যাঁ সেই কাজটা কিন্তু ট্রাম্প সাহেব করে দিয়েছেন, জানিয়েই দিয়েছেন যে ওই করাপ্ট প্রাকটিসেস আইন আপাতত স্থগিত থাকল। মুখে বুকনি যাই থাকুক না কেন, আদতে লক্ষ্য এক্কেবারে সাফ বোঝাই যাচ্ছে, আসল যে কারণে যাওয়া তাতে এক্কেবারে দশে দশ। আদানি সাহেব আরও একটা নিউজ চ্যানেল কিনে উপহার দেওয়ার জন্য বসে আছেন, নিশ্চিত জেল আর জরিমানার বদলে বেকসুর খালাস, কারণ আইনই স্থগিত। একেই বলে কহি পে নিগাহে, কহি পে নিশানা।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | যে লড়তে চায়, সে যেন আগে যুদ্ধ করার মাসুলটা গুনে নেয়!
এবারে আসুন আমাদের দেশের মধ্যেই ওই কহি পে নিগাহে, কহি পে নিশানা কথাটা একটু নেড়েচেড়ে দেখা যাক। মনে আছে সেই ২০১৬ রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন, তখন কৈলাস বিজয়বর্গীয় ছিলেন এ রাজ্যে বিজেপির পথপ্রদর্শক। মনে আছে বিজেপির রাজ্য দফতর মুরলীধর লেনে সাংবাদিকদের বসিয়ে ভিডিওতে দেখানো হয়েছিল তৃণমূল নেতাদের টাকা নেওয়ার ছবি, প্রায় প্রতিটা জনসভাতে কৈলাস বিজয়বর্গীয় এবং অন্যরা চিৎকার করত ভাগ শুভেন্দু ভাআআআআগ, ভাগ মুকুউউউল ভাগ।
তারপর ক্রমশ ইডি আর সিবিআই-এর হাত বাড়ানো শুরু হল, এবং নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা দুই মিলিয়ে আমাদের কাঁথির খোকাবাবু দল বদলিয়ে হঠাৎই এক কট্টর হিন্দু হয়ে পড়লেন। সেই কহি পে নিগাহে, কহি পে নিশানা। তারপর মন্দ নয়, মুখ্যমন্ত্রী নয় তো বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা, কম কী? কিন্তু এরই মধ্যে আবার কেলো, সিবিআই-এর চাকরি ঘুষের তালিকাতে ভাইয়ের নাম, আবার সেই নাম নিয়ে খিল্লি করছে জগা, জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়। কাজেই ওনার নাকি মাইনে করা অনুগামী ইউটিউবারেরা নেমে পড়ল মাঠে, জগার কেলেঙ্কারি সব বাইরে। কিন্তু তা তো কেবল জগার কেলেঙ্কারি ছিল না, তা তো বিজেপির কেলেঙ্কারিও ছিল, আবার ওই মাধ্যম কমিউনিকেশন যেখানে টাকা গিয়েছিল তার সঙ্গে নাকি আরএসএস-এরও আবার দারুণ সম্পর্ক কাজেই ওই ইউটিউবারদের দেওয়া তথ্যে কাদা ছড়াল সর্বত্র। সেই একই কেস, কহি পে নিগাহে, কহি পে নিশানা। কাজেই দিল্লিতেও শোরগোল পড়ে গেছে, এমনিতেই ২০২১-এই রাজপাট এনে দেব বলেই মাঠে নেমে ধেড়িয়েছেন, তারপরে ২০২৪-এ ১৮ থেকে সাংসদ সংখ্যা কমে ১২, কাজেই কাঁথির এই খোকাবাবুকে নিয়ে বেশ অস্বস্তিতেই আছেন দিল্লির নেতারা, তাঁরাই জরুরি তলব করে এসেছিলেন। দুষ্টু লোকে বলছে উনি ঠিক এই জন্যেই খানিক কাদা ছোড়াছুড়িতে নেমেছিলেন, সব্বাই ভাবছিল ওই একদা সাংবাদিক জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় ওনার লক্ষ্য। তো জানা গেল এক্কেবারেই না, উনি নাকি ওনার ভাইয়ের জন্য রক্ষাকবচের দাবিতেই গিয়েছিলেন দিল্লি। রক্ষাকবচ মিলল না মেলেনি, তা অবশ্য ক’দিন পরেই জানা যাবে। ওনার সেই নাকি পয়সাতে চলা ইউটিউবারেরা অবশ্য আপাতত এক্কেবারে চুপ মেরে গেছেন। কাজেই শুভেন্দুবাবুর দিল্লি যাত্রা আর মোদিজির আমেরিকা যাত্রার মূল সুরটা কিন্তু এক, ভাই-বেরাদরকে বাঁচানোর জন্য আবেদন নিবেদন করাই ছিল আসল লক্ষ্য, মোদিজি আপাতত সফল, শুভেন্দু সফল কি না তা বলবে সময়।