যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন।
ইতিমধ্যেই জেনে ফেলেছেন যে ‘যে লড়তে চায়, সে যেন আগে যুদ্ধ করার মাসুলটা গুনে নেয়!’ এই কথাটি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর এক্স, সাবেক টুইটার অ্যাকাউন্টে লিখেছেন এবং তারপর থেকে এর বিটুইন দ্য লাইনস নিয়ে এক্কেবারে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। কেন চলবে না? তিনি এখনও তৃণমূল দলের অঘোষিত নম্বর ২, তিনি এখনও সংসদে বা দিল্লিতে জাতীয় মঞ্চে তৃণমূলের প্রথম মুখ, তিনি এখনও দলের সর্বভারতীয় সম্পাদক। এবং সবচেয়ে বড় কথা হল বেশ কিছুদিন ধরেই এক খবর হাওয়ায় ভাসছে, পিসি-ভাইপোর নাকি মস্ত ঝামেলা লেগেছে। আসলে মিডিয়ার সনসনিখেজ, অত্যন্ত রোমাঞ্চকর কিছু না হলে চলে না, টিআরপি তুলতে হবে, কেন? কারণ তাই দেখেই আসে বিজ্ঞাপন, আর সেই বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভর করে চ্যানেলের আমদানি, অতএব টিআরপি না তুলতে পারলে মাইনেতে কোপ পড়বে, পাপি পেট কা সওয়াল হ্যায়। কাজেই সদ্য কন্যা হারানো মাকে অনায়াসে একঝাঁক সাংবাদিক ঘিরে ধরে প্রশ্ন করতেই পারেন, আপনার মেয়ের এই দুর্ঘটনার জন্য আপনি কাকে দায়ী করছেন? উনি যদি বলেন রাজ্য সরকারকে, তাহলে কেল্লা ফতে সেই চ্যানেলের যারা তারপর থেকে ৫ দিন নাওয়া খাওয়া ছেড়ে কেন মমতা ব্যানার্জিকে গ্রেফতার করা হবে না সেই আলোচনাতে ডেকে আনবেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপককে যিনি পাঞ্চজন্য থেকে পাঁচফোড়ন সব বিষয়েই মতামত দিয়ে থাকেন। বা যদি সেই সন্তানহারা মা বলেন যে আমি তো কিছুই জানি না, আমাকে তো কেউ কিছুই জানায়নি, তাহলেও চলবে, দেখেছেন দেখুন সন্তান হারা মাকে অন্ধকারে রেখেই শবদেহের সৎকার হয়ে গেল। নিদেনপক্ষে সেই মায়ের চোখ দিয়ে খানিক অশ্রুপাত হলেও চলবে, এই বাংলার মায়েদের চোখের জল শুকোচ্ছে না। এ এক অদ্ভুত অবস্থা। সেই মিডিয়া, সংবাদমাধ্যম পেয়ে গেছে এক কোটেশন, ‘যে লড়তে চায়, সে যেন আগে যুদ্ধ করার মাসুলটা গুনে নেয়!’ তাহলে তো পিসি-ভাইপোর লেগে যা লেগে যা নারদ নারদ, কাজেই আসুন বুঝে নিই অভিষেক কীভাবে মমতার বিরুদ্ধে তাঁর অস্ত্র শানাচ্ছেন, এটাই শীর্ষ আলোচনা। প্রাইম টাইমে কলতলায় একজন আধা তৃণমূল, বাকিরা আর যাই হন না কেন, তৃণমূল বিরোধী তো বটেই। ঘণ্টা বাজে, শেষ হয় কলতলার আলোচনা। জানা কী যায়? অভিষেক কেন এই কথা বলেছেন? জানা যায় না। অতঃপর দর্শক শ্রোতার ক্লান্ত মন আরও এক চ্যানেলের কলতলায় গিয়ে বসে, আসলি খবর যদি মিলে যায়। তার মানে কী? তার মানে মোদ্দা কথা হল অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক এটাই চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন ধোঁয়াশা তৈরি হোক, তাঁকে নিয়ে আলোচনা হোক, হচ্ছে, এবং এক কেন দুই কেন পাঁচ ঘণ্টা আলোচনা করেও যে এর তল পাওয়া যাবে না সেটাও তো সব্বার জানা।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | কারাতের কথা সেলিমের জবাব
এবারে আসুন অন্যদিক থেকে বিষয়টাকে একটু বোঝা যাক। চীনের এক আর্মি জেনারেল সান জু জন্মেছিলেন ৫৪৪ ক্রিস্টপূর্বাব্দে, ৪৭-৪৮ বছর বেঁচেছিলেন আর তার লেখা দ্য আর্ট অফ ওয়ার ছিল মাও সে তুংয়ের প্রিয় বই, তিনি নিজেকে সান জুর ছাত্র বলতেন। হ্যাঁ, মাওয়ের নেতৃত্বে চীন বিপ্লবের প্রতিটা পদক্ষেপে সান জুর দ্য আর্ট অফ ওয়ারকে অনুসরণ করা হয়েছে। তো সেই হেন মাওয়ের গুরু সান জু-র বেশ কিছু কথার একটা ছোট্ট লাইন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় পোস্ট করেছেন। কেন করেছেন তা তো উনি জানেন, কিন্তু আসুন ওই কোটেশনের পুরোটা জেনে নিই, অন্তত সান জু কেন এই কথাগুলো বলেছিলেন তা জানার চেষ্টা করি যা সম্ভবত অভিষেক ব্যানার্জির চিন্তাভাবনার কিছু খোঁজখবর দিতে পারবে।
সান জু বলছেন, ১) দ্রুত গতি রথ আর বড় রথ, তার উপরে যোদ্ধা, অস্ত্র টুকিটাকি নিয়ে সে এক বিরাট খরচ, সেই জমানার হিসেবে এক আউন্স রুপো, প্রতিদিন, তবে ১ লক্ষ যোদ্ধার এক টিম তৈরি হবে। এরপর বলছেন, ২) যদি বিজয় অনেক দূরে হয়, মানে জিততে গেলে অনেক সময় লাগে তাহলে অস্ত্রে জং ধরবে, জয়ের আকাঙ্ক্ষা কমে যাবে, যদি অবরোধ চলতে থাকে তাহলে শক্তি ক্ষয় হবে। এরপরে তাঁর কথা ৩) এই যুদ্ধ যদি চলতেই থাকে তাহলে ঢাকের দায়ে মনসা বিকোবে। এবং ৪) যদি তোমার অস্ত্রে জং ধরে, তোমার উৎসাহে ভাটা পড়ে, তোমার শক্তিক্ষয় হয়, অর্থ ব্যয় হয়, তাহলে তোমার অন্য সেনাপতিরা সু্যোগের সুবিধে নিতে এগোবে এবং তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি রুখে দেওয়া অসম্ভব। অতএব ৫) কাজেই আমরা শুনেছি যুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে বোকারা কিন্তু যুদ্ধ জয়ের জন্য প্রচুর সময় নষ্ট করাটাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এবং সানজু শেষ করছেন এই বলে যে, এইসব কথা মেনে যে লড়তে চায়, সে যেন আগে যুদ্ধ করার মাসুলটা গুনে নেয়! এবার বাকিটা নিয়ে আপনারা মাথা ঘামান।