পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী (West Bengal Assembly Election 2026) ইতিহাসে ২০২৫ সালের শেষ কটা দিন এক অদ্ভুত, নজিরবিহীন পরিস্থিতির সাক্ষী হয়ে রয়ে গেল। যে সময়টা সাধারণত নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তুতির সময়, সেখানে আস্ত একটা রাজ্যের সাধারণ মানুষ এখন ব্যতিব্যস্ত নিজেদের নাগরিকত্ব আর ভোটার তালিকায় নাম টিকিয়ে রাখার এক অসম লড়াইয়ে। রাজ্যের প্রায় এক কোটি ভোটার জানেনই না তাঁরা ভোটার কি না। কেন? রাজ্যে চলছে নতুন যাত্রাপালা ভারতের নির্বাচন কমিশন নির্দেশিত ‘স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন’ বা এসআইআর (SIR)। এই এস আই প্রক্রিয়া যে কত বড় বিপর্যয়ের রূপ নিতে পারে, তা এখন পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম থেকে শহর— সর্বত্রই পরিষ্কার। নির্বাচন কমিশন এই এস আই আর নিয়ে ঠিক কী করবে, তা এখন তারা নিজেরাও ভেবে উঠতে পারছে না। পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে, তারা প্রথমে প্রায় ৩১ লক্ষ মানুষকে ঢালাওভাবে শুনানির নোটিশ পাঠিয়ে দিল, আর তারপর চারপাশ থেকে আসা প্রবল চাপে এবং নিজেদের নানান ভুল ভ্রান্তি ধরা পড়ায় সেই নোটিশ আবার স্থগিতও করে দিলো, বা বলা ভালো স্থগিত করতে বাধ্য হল। এই গোটা প্রক্রিয়ার মধ্যে এক চূড়ান্ত নৈরাজ্য চলছে, এক হবুচন্দ্র গবুচন্দ্রের তামাশা। যে তালিকায় নাম আছে কি নেই তা নিয়ে এত বিতর্ক, সেই তালিকার ভিত্তি করা হয়েছে ২০০২ সালের ভোটার তালিকাকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, নিখোঁজ বা ‘আনম্যাপড’ বলে দেগে দেওয়া বহু ভোটারের নিজের নাম কিংবা তাদের বাবা-মায়ের নাম সশরীরে ২০০২ সালের ওই পুরোনো তালিকাতে দিব্যি মজুত আছে । অথচ কম্পিউটারের যান্ত্রিক হিসেবে তারা ব্রাত্য। আবার এই যে শুনানি বা হিয়ারিং হবে, তা করার আইনি এক্তিয়ার বা ক্ষমতা কার আছে— ইআরও (ERO) না এএআরও (AERO), নাকি সবটাই হবে দিল্লির সেন্ট্রাল পোর্টাল থেকে যান্ত্রিক উপায়ে— তা নিয়েও প্রশাসনিক স্তরে চলছে প্রবল দড়ি টানাটানি । এই বিশৃঙ্খলার বলি হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অসুস্থ, অতি বৃদ্ধ, প্রখ্যাত চিকিৎসক থেকে শুরু করে পাঁচ-পাঁচটি পাসপোর্ট আছে এমন স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নাগরিক— কাউকেই রেহাই দেওয়া হয়নি। এমনকি সামান্য একটা বানান ভুলের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার চলছে এমন মুমূর্ষু রোগীকেও অ্যাম্বুলেন্সে করে হিয়ারিং সেন্টারে নিয়ে আসতে হচ্ছে। বাংলার সাধারণ মানুষের এই চরম ভোগান্তি আর নির্বাচন কমিশনের এই দিশেহারা অবস্থা নিয়েই মঞ্চ থেকে বিদেয় নিচ্ছে ২০২৫, আসছে ২০২৬।
পশ্চিমবঙ্গে ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন (Election Commission) যখন এই বিশেষ ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ শুরু করে, তখন উদ্দেশ্য ছিল একটা নির্ভুল তালিকা তৈরি করা, অন্তত মুখে তেমনটাই বলা হয়েছিল। সাধারণত প্রতি বছর যে সংশোধন হয়, তাকে বলা হয় ‘সামারি রিভিশন’। কিন্তু এবার যা হচ্ছে, তা হলো ‘ইনটেনসিভ রিভিশন’, যার মানে হল বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রত্যেক ভোটারের তথ্য যাচাই করা এবং তাদের আঙুলের ছাপ, ছবি ও প্রামাণ্য নথি সংগ্রহ করা । কমিশন ঠিক করেছিল যে, যারা বর্তমানে ভোটার আছেন, তাদের অবশ্যই ২০০২ সালের ভোটার তালিকার সঙ্গে নিজেদের বা তাদের পরিবারের কোনো সদস্যের যোগসূত্র বা ‘ম্যাপিং’ দেখাতে হবে । তো ওনারা প্রথমেই ২০০২ সালের ভোটার তালিকাকে ডিজিটাইজ করে আপলোড করে দিতে পারতেন। এবারে যাঁদের নাম নেই তাঁরা বি এল ওর কাছে গিয়ে তাঁদের আবেদন জমা দিতে পারতেন, ২০০২ এর স্থানান্তরিত বা মৃত ভোটারদের বাদ দিয়ে সেই আবেদন দেখে ভোতার তালিকা শুদ্ধ করা যেত। কিন্তু ওনারা জল ঘুলিয়ে খেতে অভ্যস্থ। তাই পা জুতো দিয়ে না ঢেকে, পৃথিবীর ওপরে চামড়া পরানোর কাজে হাত দিলেন। কিন্তু এই মহান, মহৎ পরিকল্পনাই এখন এক বিশাল প্রশাসনিক জটে পরিণত হয়েছে। গত ১৬ ডিসেম্বর যখন খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হলো, তখন দেখা গেল এক ধাক্কায় রাজ্য থেকে প্রায় ৫৮ লক্ষ ভোটারের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে । এই বিপুল সংখ্যক মানুষ তালিকা থেকে বাদ পড়ায় সারা রাজ্যে এক আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হল। মৃত বা স্থানান্তরিত ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া স্বাভাবিক হলেও, অভিযোগ তো উঠেছেও যে বহু জীবিত এবং একই জায়গায় কয়েক দশক ধরে আছেন, এমন মানুষের নামও কেটে দেওয়া হয়েছে । এরপরই শুরু হয় ‘আনম্যাপড’ ভোটারদের পালা। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে প্রায় ৩১ থেকে ৩২ লক্ষ মানুষকে এমন এক তালিকায় রাখা হয়, যাদের সাথে ২০০২ সালের তালিকার কোনও সরাসরি যোগসূত্র সফটওয়্যার খুঁজে পায়নি । এই ৩১ লক্ষ মানুষকে যখন তড়িঘড়ি শুনানির নোটিশ পাঠানো শুরু হলো, তখন থেকেই আসল বিশৃঙ্খলা দানা বাঁধতে শুরু করে। কোনও আগাম সতর্কতা বা পর্যালোচনার সুযোগ না দিয়েই যান্ত্রিকভাবে তৈরি এই নোটিশগুলো মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়। ফলে ডিসেম্বরের হাড়কাঁপানো শীতে হাজার হাজার মানুষ লাইন দিতে শুরু করেন বিভিন্ন নির্বাচনী কেন্দ্রে। যারা ২০-৩০ বছর ধরে ভোট দিচ্ছেন, যাদের কাছে ২০০২ সালের তালিকার কপি আছে, তারাও যখন শুনানির নোটিশ পেলেন, আজ প্রশাসনের অযোগ্যতা আর যান্ত্রিক ভ্রান্তি দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। কমিশন কেন ২০০২ সালের তালিকাকে ভিত্তি হিসেবে বেছে নিল, তার পেছনেও একটা যুক্তি ছিল।
আরও পড়ুন: নির্বাচন কমিশন মানুষ নিয়ে কাটাকুটির খেলা খেলছে
অনেকের বক্তব্য ২০০২ সালেই শেষবার পশ্চিমবঙ্গে এমন ইনটেনসিভ রিভিশন বা নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধন হয়েছিল । বাস্তবে দেশজুড়ে এস আই আর এই প্রথম, কোনও রাজ্য জুড়েও তা কখনওই হয় নি। তো যাই হোক আমাদের এই মহান কমিশনের ধারণা ছিল, সেই সময়কার ডেটাবেসের সাথে বর্তমান ভোটারদের মিলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে কারা প্রকৃত বাসিন্দা এবং কারা অনুপ্রবেশকারী বা ভুয়ো ভোটার। কিন্তু সমস্যাটা হল প্রয়োগের ক্ষেত্রে। ২০০২ সালের সেই বিশাল তথ্যভাণ্ডার ঠিকমতো ডিজিটাইজ বা কম্পিউটারাইজড করা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই সেই তালিকার পিডিএফ ফাইলগুলো পুরোপুরি সিএসভি বা প্লেইন টেক্সট ফরম্যাটে রূপান্তরিত করা সম্ভব হয়নি । এর ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। যখনই কোনো ভোটার বর্তমান ফর্ম জমা দিচ্ছেন, তখন সফটওয়্যার বা কম্পিউটার সিস্টেম সেই নামটাকে ২০০২ সালের অস্পষ্ট বা অসম্পূর্ণ ডেটাবেসের সঙ্গে মেলাতে পারছে না। একেই বলা হচ্ছে ‘আনম্যাপড’ বা অচিহ্নিত ভোটার । মজার ব্যাপার হলো, অনেক মানুষের কাছে ২০০২ সালের সেই ভোটার তালিকার হার্ড কপি বা ছাপানো কাগজ বাড়িতেই রাখা আছে। তারা সেখানে নিজেদের নাম দেখাতে পারছেন, কিন্তু কমিশনের যান্ত্রিক যাঁতা কলে পড়ে তারা আজ সন্দেহভাজন, ডাউটফুল ভোটার। আর এই প্রযুক্তিগত ব্যর্থতার কারণেই নির্বাচন কমিশন ৩১ লক্ষ মানুষকে নোটিশ পাঠিয়েও পরে তা আবার স্থগিত করে দিতে বাধ্য হল। অতিরিক্ত মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (ACEO) এক চিঠিতে জেলা নির্বাচনী আধিকারিকদের জানিয়েছেন যে, সিস্টেম থেকে নোটিশ জেনারেট হয়ে থাকলেও এখনই অনেককে শুনানিতে ডাকার প্রয়োজন নেই । বিশেষ করে যাদের নাম বা বাবা-মায়ের নাম ২০০২ সালের হার্ড কপি বা ছাপানো তালিকায় স্পষ্ট আছে, তাদের হিয়ারিং সেন্টার পর্যন্ত দৌড় করানোর কোনো মানে হয় না। এই যে একবার নোটিশ পাঠানো আর তারপর আবার তা স্থগিত করা— এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন বুঝিয়ে দিল যে তারা এই গোটা বিষয়টা সামাল দিতে গিয়ে পুরোপুরি অথৈ জলে পড়েছে। এই এস আই আর প্রক্রিয়ার মধ্যে কেবল সাধারণ মানুষ নন, সরকারি আধিকারিকরাও চরম বিরক্ত , আটারলি কনফিউজড, বিভ্রান্ত। জনপ্রতিনিধিত্ব আইন ১৯৫০ অনুযায়ী, কোনো ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া বা সংশোধনের পূর্ণ আইনি ক্ষমতা থাকে ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসার বা ইআরও-দের হাতে । কিন্তু এবারের এস আই আর-এর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, অনেক সিদ্ধান্তই সরাসরি সেন্ট্রাল পোর্টাল বা দিল্লির নির্বাচন কমিশনের সফটওয়্যার থেকে নেওয়া হচ্ছে। ইআরও-রা জানতেও পারছেন না যে তাদের এলাকার কার নাম বাদ যাচ্ছে বা কাকে কেন শুনানির নোটিশ পাঠানো হচ্ছে । যার ফলে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপছে। যান্ত্রিক উপায়ে মানে ঐ এ আই টুল দিয়ে গণহারে নাম বাদ দেওয়া System-driven deletion আসলে আইনের পরিপন্থী।
আইনের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো মানুষের নাম কাটার আগে তাকে সশরীরে কথা বলার বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হয় । কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে যে, তথ্য যাচাইয়ের ফর্ম বা এনুমারেশন ফর্ম ঠিকমতো জমা না পড়লেই সফটওয়্যার স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই ভোটারকে মৃত বা স্থানান্তরিত বলে দাগিয়ে দিচ্ছে। আধিকারিকদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে যদি কোনো সাধারণ মানুষ আদালতে যান, তবে তার দায়ভার শেষ পর্যন্ত এই ইআরও বা আধিকারিকদের ওপরেই বর্তাবে, অথচ দোষটা আসলে যান্ত্রিক ত্রুটি আর কমিশনের ভুল নির্দেশনার । এই এক্তিয়ার বা ক্ষমতা নিয়ে টানাপোড়েনের ফলে মাঠ পর্যায়ের বিএলও (BLO) থেকে শুরু করে বড় অফিসারদের মধ্যে এক অদ্ভুত গা-ছাড়া ভাব ও ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই গোটা ঘটনার সবথেকে যন্ত্রণাদায়ক অংশ হলো সাধারণ মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। কমিশনের নির্দেশ ছিল যে ৮০ বা ৮৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে আধিকারিকরা বাড়িতে গিয়ে তথ্য যাচাই করবেন । কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। বহু এলাকায় দেখা গেছে, যান্ত্রিকভাবে পাঠানো নোটিশের ভয় এতটাই যে মানুষ মরণাপন্ন অবস্থায় হিয়ারিং সেন্টারে হাজির হয়েছেন। সবথেকে ভয়াবহ দৃশ্যগুলো, অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগানো রোগী কিংবা মুমূর্ষু বৃদ্ধকে অ্যাম্বুলেন্সে করে শুনানির জন্য আনা হয়েছে। অনেকের অপরাধ কী? তাদের নামের বানানে সামান্য ভুল আছে কিংবা তাদের পূর্বপুরুষের নামের কোনো একটা অংশ ২০০২ সালের তালিকার অস্পষ্ট ডেটার সাথে মেলেনি । এই যে এক অমানুষিক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, তাকে ‘নৈরাজ্য’ ছাড়া আর কী বা বলা যায়! নির্বাচন কমিশন বারবার বলছে যে, কোনো বৈধ ভোটারের নাম তারা তালিকা থেকে বাদ দেবে না । কিন্তু তাদের কথা আর কাজের মধ্যে বিস্তর ফারাক দেখা যাচ্ছে। একদিকে তারা তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে চাইছে, অন্যদিকে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো বা প্রশিক্ষিত কর্মী তাদের হাতে নেই। বিএলও-রা অভিযোগ করছেন যে, তাদের যে অ্যাপ বা সফটওয়্যার ব্যবহার করতে বলা হয়েছে, তা অনেক সময় ঠিকমতো কাজ করে না । গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেটের সমস্যার কারণে তথ্য আপলোড করা সম্ভব হয় না, আর তার ফলে সাধারণ ভোটাররা ভোগান্তির মুখে পড়ছেন। বাংলার মানুষ এখন তাকিয়ে আছে কমিশনের পরের পদক্ষেপগুলোর দিকে— তারা কি সত্যিই এই নৈরাজ্য কাটিয়ে উঠতে পারবে, নাকি এস আই আর-এর এই গোলকধাঁধায় পড়ে পশ্চিম বঙ্গের নির্বাচনী ব্যবস্থাটাই একটা প্রশ্নের মুখে দাঁড়াবে? প্রশ্নটা তো সহজ কিন্তু উত্তরটা জানা নেই, কেবল জানা আছে এই মুহুর্তে নির্বাচন কমিশন এক সম্পূর্ণ দিশেহারা, পথভোলা পথিক।







