গাধারা জল ঘোলা করেই খেতে ভালোবাসে, এমনটা আমরা জানতাম। কিন্তু বড় হয়ে জানলাম, গাধা ছাড়াও শয়তানেরাও ওই জল ঘোলা করে খেতে ভালোবাসে। দেশের লোক খুব সোজা একটা স্লোগানে একমত হয়েছিল আমাদের নরু ওরফে নরেন’দা। শেয়ানা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে, ‘অচ্ছে দিন লায়েঙ্গে’, ‘আপনাদের জন্য একটা সুন্দর দিন এনে দেব’। এক দীর্ঘ কংগ্রেস শাসনের দুর্নীতি, এক বংশানুক্রমিক শাসন দেখে ক্ষুব্ধ মানুষজন শেয়ানা প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন, মনে করেছিলেন বিজেপির শাসনে এক অন্য ভারত দেখব আমরা। কিন্তু আসা ইস্তক গাধায়, থুড়ি শয়তানেরা জল ঘোলা করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে। আদতে সমস্ত সমস্যাগুলো গিয়েছে চুলোর দোরে; রামমন্দির, গোমাংস, গীতাপাঠ, ঘর মে ঘুসকে মারেঙ্গে, বিশ্বগুরু, মাদার অফ ডেমোক্রাসি, ৪ ট্রিলিয়নের অর্থনীতি, জিডিপি বাড়ছে ইত্যাদি ঢপবাজির মধ্যে আটকে পড়েছে, সবটাই এখন ‘এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার’-এর ‘একস্ট্রা টু এ বি’র মতো। এক কানাগলির মধ্যে ঘুরছে ভারত, শাসক দলের নেতারা তিন মিনিট কথা বললে তার মধ্যে নিশ্চিতভাবেই পাবেন হিন্দুত্ব, রামমন্দির, পাকিস্তান, মন্দির, মসজিদ। সেই আবহে হঠাৎ করে চলে এল ‘বন্দেমাতরম’ প্রসঙ্গ। লিখেছেন কে? বঙ্কিমদা। সমস্যা হল বঙ্কিমচন্দ্র জন্মের পরে হঠাৎ ১৮৭৫ এ এই বন্দেমাতরম লিখেই ১৮৯৪-এ মারা গিয়েছিলেন এমন তো নয়, তিনি কেবল ‘আনন্দ মঠ’ই লিখেছিলেন, তেমনও নয়। আরও অনেক অনেক লিখেছিলেন। আর শেষের দিকের লেখাগুলো তো সাংঘাতিক! তিনি তখন নভেল ছেড়ে প্রবন্ধে মনোযোগ দিয়েছেন, অসাধারণ বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। কিন্তু নরেনদা বঙ্কিমদার ঐ লেখাগুলো তো পড়েননি, ওনার তো ‘চোলা চোলায় বাজলু জোয়ের ভেড়ি’ পর্যন্তই জানা, আর সেও যদি টেলিপ্রম্পটার কাজ করে। ভারতের ১৮তম প্রধানমন্ত্রীকে সারা পৃথিবীতে কেউ জ্ঞানী পন্ডিত বলে মনে করেন, এমন তো নয়, তিনি খুব পড়াশুনো করেন, এমনটা তাঁর শত্রুরাও বলে না। তো তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের আর একটাও নভেল বা প্রবন্ধ পড়েছেন বলে তো মনে হয় না। ওসব ছেড়েই দিন, আনন্দমঠও পড়েছেন কি? আমার তো মনে হয় যে, সেটাও তিনি পড়েননি। কেবল জল ঘোলা করার জন্যই ‘বন্দেমাতরম’ নিয়ে বিতর্কে নেমেছিলেন।
সমস্যা হল ওনার এই বিতর্কে নামার আগে জানাই ছিল না যে, এটা ঘটনা যে ১৯৩৭ সালে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি—যেখানে মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের মতো শীর্ষ নেতৃত্ব উপস্থিত ছিলেন—তাঁরা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেন যে, গানটার কেবল প্রথম দু’টো স্তবকই অধিবেশনে গাওয়া হবে। কিন্তু আদতে এই সিদ্ধান্ত ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, জওহরলাল নেহেরু, সুভাষচন্দ্র বসু সিদ্ধান্তে না আসতে পেরেই রবি ঠাকুরের স্মরণাপন্ন হয়েছিলেন, এবং রবি ঠাকুর দ্ব্যর্থহীন ভাষাতেই জানিয়ে দেন প্রথম দু’টো স্তবকই গাওয়া যায়। কাজেই আজ কেন ‘বন্দেমাতরম’-এর শেষ কিছু লাইন বাদ দেওয়া হয়েছে বলে প্রশ্ন উঠলে আসলে চ্যালেঞ্জ করা হয় রবি ঠাকুরের মেধা মনন আর চেতনাকে। অত্যন্ত মুর্খও সে কাজ করবে না। কিন্তু সবাই জানে যে, মূর্খের অশেষ দুর্গতি। না জেনেই এই বিতর্কে পা দিয়ে নরেন’দা সেই ভুলটা করে ফেলেছেন। কিন্তু আসলে তিনি চেয়েছিলেন কী? বা বিজেপির মত এক দল এই ‘বন্দেমাতরম’ বিতর্ক থেকে চেয়েছিলটা কী? চেয়েছিল এটাই বোঝাতে যে, অর্থনীতি, পেটের চিন্তা ইত্যাদি জাগতিক ব্যাপারের থেকে ধর্ম অনেক বড়, আর সেই ধর্মই যখন বিপদে তখন হিন্দুরা এক হও, এই মেসেজটা হিন্দু সমাজে ছড়িয়ে দিতে। কারা তোমার মা দুর্গা, মা লক্ষ্মীকে কেড়ে নিয়েছেন? কারা আসলে মুসলমান তোষণ করছেন? কারা আপনার মঙ্গলসূত্র কেড়ে নেবেন? কারা আপনার গীতাপাঠের আসরে চিকেন প্যাটিস খাইয়ে আপনার ধর্মকে মারতে চাইছে? হ্যাঁ, এই সমস্ত তথ্যগুলো আপনাকে একতাই ন্যারেটিভের দিকে নিয়ে যাবে – হিন্দু খতরে মে হ্যায়, কাজেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়ান। বাকি খুচরো ন্যারেটিভ হল গোমাংস, আমিষ-নিরামিষ, রামমন্দির ইত্যাদি ইত্যাদি। সেসব নিয়ে আলোচনা তো চলবে। কিন্তু আসুন দেখে নেওয়া যাক, এই ধর্ম নিয়ে বা আমিষ-নিরামিষ বিতর্ক নিয়ে নরেন’দার বঙ্কিমদা কী কী লিখে গিয়েছেন। অন্ধভক্তের দল যদি পারেন ওনার এই লেখাগুলোর অনুবাদ করে নরেন’দাকে পড়াবেন, কিন্তু পড়ানোর আগে সরবিট্রেট খাইয়ে নেবেন, হৃদয় দৌর্বল্য থাকলে বিপদ অনিবার্য। ধর্ম প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের মত খানিকটা মার্ক্সের মতো ছিল।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদি-আদানি-LIC, প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তর তো জানা
হ্যাঁ, মার্ক্স বলেছিলেন, ‘ধর্ম হল আফিম, শোষিত মানুষের দীর্ঘশ্বাস’। বঙ্কিমচন্দ্র কী বলছেন শুনুন। আগে দু’লাইনে কোথায় বলছেন সেটা বলে নিই – বিড়াল নামে এক রম্যরচনাতে কমলাকান্ত আফিম খেয়ে আধঘুমন্ত অবস্থায় আছেন, সেই সময়ে এক বেড়াল ঢুকে পুরো দুধটা খেয়ে নেয়। এবার সেই আফিমের নেশায় ঢুলুঢুলু কমলাকান্তের সঙ্গে ঐ মার্জারের কথা শুরু হয়। তার একজায়গাতে ওই বেড়াল বলছে, ‘দরিদ্র চোর হয়? পাঁচ শত দরিদ্রকে বঞ্চিত করিয়া একজনে পাঁচশত লোকের আহার্য সংগ্রহ করিবে কেন? যদি করিল, তবে সে খাইয়া তাহার যাহা বাহিয়া পড়ে, তাহা দরিদ্রকে দিবে না কেন? যদি না দেয়, তবে দরিদ্র অবশ্য তাহার নিকট হইতে চুরি করিবে; কেন-না, অনাহারে মরিয়া যাইবার জন্য এ পৃথিবীতে কেহ আইসে নাই’৷ কমলাকান্ত জবাবে বলছে, ‘আমি আর সহ্য করিতে না পরিয়া বলিলাম, “থামো! থামো মার্জারপণ্ডিত! তোমার কথাগুলি ভারি সোশিয়ালিস্টিক! সমাজবিশৃঙ্খলার মূল! যদি যাহার যত ক্ষমতা, সে যদি তত ধন সঞ্চয় করিতে না পায়, অথবা সঞ্চয় করিয়া চোরের জ্বালায় নির্বিঘ্নে ভোগ করিতে না পায়, তবে কেহ আর ধন সঞ্চয়ে যত্ন করিবে না। তাহাতে সমাজের ধনবৃদ্ধি হইবে না”। মার্জার বলিল, “না হইল তো আমার কী? সমাজের ধনবৃদ্ধির অর্থ ধনীর ধন বৃদ্ধি। ধনীর ধনবৃদ্ধি না হইলে দরিদ্রের কী ক্ষতি?” আমি বুঝাইয়া বলিলাম যে, “সামাজিক ধন বৃদ্ধি ব্যতীত সমাজের উন্নতি নাই।” বিড়াল রাগ করিয়া বলিল যে, “আমি যদি খাইতে না পাইলাম, তবে সমাজের উন্নতি লইয়া কী করিব?” বিড়ালকে বুঝানো দায় হইল। যে বিচারক বা নৈয়ায়িক, কস্মিনকালে কেহ তাহাকে কিছু বুঝাইতে পারে না। এ মার্জার সুবিচারক, এবং সুতার্কিকও বটে, সুতরাং না বুঝিবার পক্ষে ইহার অধিকার আছে। অতএব ইহার উপর রাগ না করিয়া বলিলাম, “সমাজের উন্নতিতে দরিদ্রের প্রয়োজন না থাকিলে না থাকিতে পারে, কিন্তু ধনীদিগের বিশেষ প্রয়োজন, অতএব চোরের দণ্ডবিধান কর্তব্য।” মার্জারি মহাশয়া বলিলেন, “চোরকে ফাঁসি দাও, তাহাতে আমার আপত্তি নাই, কিন্তু তাহার সঙ্গে আর একটি নিয়ম করো। যে বিচারক চোরকে সাজা দিবেন, তিনি আগে তিন দিবস উপবাস করিবেন। তাহাতে যদি তাঁর চুরি করিয়া খাইতে ইচ্ছা না করে, তবে তিনি স্বচ্ছন্দে চোরকে ফাঁসি দিবেন। তুমি আমাকে মারিতে লাঠি তুলিয়াছিলে, তুমি অদ্য হইতে তিন দিবস উপবাস করিয়া দেখো। তুমি যদি ইতিমধ্যে নসীরামবাবুর ভাণ্ডারঘরে ধরা না পড়, তবে আমাকে ঠ্যাঙাইয়া মারিয়ো, আমি আপত্তি করিব না।” বিজ্ঞ লোকের মত এই যে, যখন বিচারে পরাস্ত হইবে, তখন গম্ভীরভাবে উপদেশ প্রদান করিবে। আমি সেই প্রথানুসারে মার্জারকে বলিলাম যে, “এ সকল অতি নীতিবিরুদ্ধ কথা, ইহার আন্দোলনেও পাপ আছে। তুমি এ সকল দুশ্চিন্তা পরিত্যাগ করিয়া ধর্মাচরণে মন দাও। তুমি যদি চাহ, তবে পাঠার্থে তোমাকে আমি নিউম্যান ও পার্কারের গ্রন্থ দিতে পারি। আর কমলাকান্তের দফতর পড়িলেও কিছু উপকার হইতে পারে আর কিছু হউক বা না হউক, আফিমের অসীম মহিমা বুঝিতে পারিবে। এক্ষণে স্বস্থানে গমন করো, প্রসন্ন কাল কিছু ছানা দিবে বলিয়াছে, জলযোগের সময় আসিয়ো, উভয়ে ভাগ করিয়া খাইব। অদ্য আর কাহারও হাঁড়ি খাইয়ো না; বরং ক্ষুধায় যদি নিতান্ত অধীরা হও, তবে পুনর্বার আসিয়ো, এক সরিসাভোর আফিম দিব।” মার্জার বলিল, “আফিমের বিশেষ প্রয়োজন নাই, তবে হাঁড়ি খাওয়ার কথা, ক্ষুধানুসারে বিবেচনা করা যাইবে।”
হ্যাঁ, বঙ্কিমচন্দ্র ধর্মকে আফিমের সঙ্গেই তুলনা করেছেন। ১৮৭৫ সালে তিনি ‘বন্দেমাতরম’ লিখেছিলেন, সেই ১৮৭৫ এই ‘কমলাকান্তের দফতর’ প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানেই এই বিড়াল রম্য রচনাতে বঙ্কিমচন্দ্র ধর্মকে আফিম বলেছেন কেবল তাই নয়, সমাজে শোষিতদের অবস্থান আর ধনীদের শোষণ করার কথাও লিখে গিয়েছেন। আর নিরামিষ-আমিষ নিয়ে ভেতো বাঙালির জন্য যা লিখে গিয়েছেন, তা শুনলে তো বঙ্গের ঐ বীর পুঙ্গবেরা ঝটকা খাবে। উনি লিখছেন, “অনেকে মোটামুটি বলেন যে, জলসিক্ত তাপযুক্ত বায়ু অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর, তন্নিবন্ধন বাঙ্গালিরা নিত্য রুগ্ন, এবং তাহাই বাঙ্গালির দুর্ব্বলতার কারণ। অনেকে বলেন, অম্লই অনর্থের মূল। এ দেশের ভূমির প্রধান উৎপাদ্য চাউল, এবং এ দেশের লোকের খাদ্য ভাত। ভাত অতি অসার খাদ্য, তাহাতেই বাঙ্গালির শরীর গঠে না। এজন্য ‘ভেতো বাঙ্গালি’ বলিয়া বাঙ্গালির কলঙ্ক হইয়াছে। শারীরতত্ত্ববিদেরা বলেন যে, খাদ্যের রাসায়নিক বিশ্লেষণ সম্পাদন করিলে দেখা যায় যে, তাহাতে ষ্টার্চ্চ, গ্লুটেন প্রভৃতি কয়েকটি সামগ্রী আছে। গ্লুটেন নাইট্রজেন-প্রধান সামগ্রী। তাহাতেই শরীরের পুষ্টি। মাংসপেশী প্রভৃতির পুষ্টির জন্য এই সামগ্রীর বিশেষ প্রয়োজন। ভাতে ইহা অতি অল্প পরিমাণে থাকে। মাংসে বা গমে ইহা অধিক পরিমাণে থাকে। এই জন্য মাংসভোজী এবং গোধূমভোজীদিগের শরীর অধিক বলবান্—‘ভেতো’ জাতির শরীর দুর্ব্বল।” ময়দায় গ্লুটেন শতভাগে দশভাগ থাকে; মাংসে (Fibrin বা Musculine) ১৯ ভাগ; এবং ভাতে ৭ কি ৮ ভাগ মাত্র থাকে। সুতরাং বাঙ্গালি দুর্ব্বল হইবে বৈ কি! হ্যাঁ, উনিও বুঝেছিলেন কেবল নয়, বলেছিলেন বাঙালিকে বলবান হতে হলে ময়দা আর মাংস খেতে হবে, আজ উনি বেঁচে থাকলে বলতেন গীতা পাঠ করুন আর তার সঙ্গে ঐ ময়দা আর মাংস দিয়ে তৈরি চিকেন প্যাটিস খান। ওহে গন্ডমূর্খের দল, বঙ্কিমচন্দ্র হজম করা সহজ নয়, বেশ কঠিন। হ্যাঁ, আমাদের হেড স্যার প্রায়শই বলতেন। আমরা আমাদের নরেন’দা কে দেখেই বুঝতে পারছি, নিশ্চিতভাবেই ওনার বদহজম হয়েছে।
দেখুন ভিডিও:







