‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’, বিজেপির স্লোগান। শুনলেই মনে হয় এখনও যেন মধ্যযুগে পড়ে আছি। সেই ভয়াবহ মধ্যযুগ, যেখানে মহামারী আটকানোর জন্য প্রেমিক প্রেমিকাদের পুড়িয়ে মেরে ভাবা হচ্ছে, এবার হয়তো নিরাপদ হওয়া গেল। সেই ভয়াবহ মধ্যযুগ, যখন কন্যা সন্তান জন্মালে তাঁকে অভিশাপ মনে করা হচ্ছে। ভাবতে লজ্জা লাগে, ইন্টারনেটের এই খোলা দুনিয়ায় পৃথিবী যখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে, যখন দুনিয়ার কোনায় কোনায় কী ঘটছে, তার খবর পাওয়া যাচ্ছে এক নিমেষে, তখনও আমাদের দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিজেপির স্লোগান হচ্ছে ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’।
সোজা কথায় বিজেপি বোধ হয় বলতে চায়, মেয়েরা খুবই পিছিয়ে আছে, দয়া করে কন্যা ভ্রূণ নষ্ট করবেন না। দয়া করে মেয়েদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করুন। এসবই কিন্তু নিজের দলের চরম পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবে হাওয়া দেওয়া। ওই যারা মসজিদ ভাঙে, ক্রিশ্চান পাদ্রী গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টেইন্স এবং তার দুই সন্তানকে বিধর্মী বলে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারে, তাঁরা মহিলাদের ঠিক কী চোখে দেখে, বিজেপি জানে। কিন্তু কেন দেখে এইভাবে? এর একটা সোজা উত্তর তো এই যে, আমাদের দেশে মহিলাদের আর্থিক স্বাধীনতা খুবই কম, নগণ্যই বলা যায়।
এটা নিয়েই কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভেবেছিলেন। মমতা নিজে গরিবের মেয়ে, ফলত গরিব ঘরের মেয়েদের সমস্যা তিনি ভালো করেই জানেন। আর এটা তো ঘটনা, ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ আর ‘কন্যাশ্রী’, এরকম সব প্রকল্পের ফলে বাংলার মহিলারা হাত পাততে হয়নি, নিজেদের মতো করে দুটো পয়সা খরচা করতে পেরেছে, কারও কাছে হাত পাততে হয়নি। এও সত্যি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলেই এটুকু স্বাধীনতা বাংলার মহিলারা উপভোগ করেছেন। এবং গোটা দুনিয়ার কাছে সেটা কিন্তু একটা মডেল হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছে।
এখন কেউ যদি বলেন, মমতার সরকার ভোটের দিকে তাকিয়েই এসব প্রকল্প চালু করেছেন, তাহলে তাকে বিনীতভাবে এটুকুই বলার, না আপনার ভুল হচ্ছে। ভোটের দিকে তাকিয়ে মহিলাদের কথা ভাবা, এসব বিহারে হয়। আরেকটু স্পেসিফিক করে বললে, নীতীশ কুমারের বিহারে, এনডিএ-র বিহারে। নীতীশ কুমার, ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ। তা না হলে এত বছর মুখ্যমন্ত্রীর পদে থাকতেই পারতেন না।
বিহারে তাঁর আরেক নাম পাল্টুরাম। মুখ্যমন্ত্রীর পদের টিকে থাকার জন্য, বারবার পাল্টি খেয়েছেন নীতীশ। এমনকি এবারের বিহার নির্বাচনে, ভালো ফল করা সত্ত্বেও বিজেপি কিন্তু পাল্টুরামকে ঘাঁটায়নি, মুখ্যমন্ত্রীর কুরসি নীতীশকে ছেড়ে দিয়েছে। এর কারণ হল, বিহারের মানুষের ‘দিল কা ধড়কন’ নীতীশ খুব ভালো করেই জানেন।
হ্যাঁ, নীতীশ খুব ভালো করেই জানেন, বিহারের মানুষ, বিশেষ করে মহিলাদের কাছে ওই ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ এসব স্লোগান ততটা মানে রাখে না। নীতীশ খুব ভালো করেই জানেন, বিহারে গত দেড় দশকের নির্বাচন আসলে মহিলা ভোটাররাই নিয়ন্ত্রণ করেছেন। যে কারণে এই মহিলা ভোটারদের খুশি করার জন্যই কিন্তু মদ বন্ধ করেছিলেন নীতীশ। পড়াশুনা পরে হবে। আগে তো ঘরের শান্তি ফিরুক – এরকমটাই কি ভেবেছিলেন বিহারের মহিলা ভোটারেরা? তা না হলে মদ বন্ধ করার জন্য নীতীশকে দু’হাত তুলে ভোট দিলেন কেন তাঁরা?
আরও পড়ুন: Aajke | বনশলে বানচাল বিজেপির ভোট?
উল্টোদিকে এবারের নির্বাচনে তেজস্বী যাদবের কথা ভাবুন। কি বলেছিলেন তেজস্বী? মদ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা হবে বলেছিলেন। তেজস্বীর যুক্তি কিছু ভুল ছিল না। কালোবাজারে মদ বিক্রি হচ্ছে এবং সরকার তার প্রাপ্য ট্যাক্স পাচ্ছে না। তাই গোটা বিষয়টাকে ফিরে দেখতে হবে। কিন্তু বিহারের মহিলা ভোটাররা এই কথা যে খুব ভালোভাবে নেননি, তা তো বিহার নির্বাচনের ফলাফলেই দেখা গিয়েছে।
এর সঙ্গেই ছিল নীতীশের মাস্টারস্ট্রোক। বিহারের মহিলাদের অ্যাকাউন্টে ১০,০০০ করে টাকা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল ভোটের আগে। ফল তো দেখাই গেল। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জিতল এনডিএ জোট। কিন্তু তারপর কী হচ্ছে? ফুটপাতে বসা গরিব ব্যবসায়ীদের দোকান তাদের ঠেলাগাড়ি ভাঙচুর হচ্ছে, বিহারের গরীব দোকানদারদের দু’মুঠো ভাতের যোগান গুঁড়িয়ে দিচ্ছে সরকারি বুলডোজার। আশ্চর্যের কিছু নেই, বিজেপি এমনটাই তো করে। ভোটের আগে গরিব মানুষদের বুকে টেনে নেয়, আর ভোট হয়ে যাওয়ার পরে, আচ্ছা থ্যাংক ইউ, আসতে পারেন এবার।
এই ঘটনা বিজেপি বারবার ঘটিয়েছে। গরিব ভোটারদের সঙ্গে এই আচরণ হয়েছে মধ্যপ্রদেশে, মহারাষ্ট্রে, হয়েছে রাজস্থানে। আর এখন হচ্ছে বিহারে। বিহারের মানুষ, বিশেষ করে মহিলা ভোটাররা বুঝতে পারছেন, ভোটের আগে বিজেপি যে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিল, তার উসুল কিভাবে করতে হয়, সেটাও বিজেপি খুব ভালো করে জানে।
পশ্চিমবঙ্গে ২০০৬-এর নির্বাচনেও কিন্তু বিজেপি এই টাকার থলি দেখাচ্ছে। বিজেপির বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল বলেছেন, লক্ষীর ভাণ্ডারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ১,০০০ টাকা করে দেয়, আমরা ৩,০০০ টাকা দেব। মমতা যা দিচ্ছেন, কম হোক বেশি হোক দিয়েই যাচ্ছেন একটানা, দিনের পর দিন। বিজেপি ভোটের আগে হয়তো তিন হাজার টাকা বাংলার মহিলাদের একাউন্টে ঢুকিয়ে দেবে। কিন্তু ভোট মিটে গেলে, ভোটে জিতে গেলে, আর এক পয়সাও দেবে কি? ভারতের বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্য গুলোর দিকে তাকালে কিন্তু সে কথা মনে হয় না।
আর পশ্চিমবঙ্গের মহিলারা, যারা এতদিন ধরে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ পেয়েছেন, ‘কন্যাশ্রী’ পেয়েছেন, তাঁরা কি আদৌ বিশ্বাস করবে ভোটের আগে বিজেপির এই তিন হাজার টাকা দান খয়রাতের কথা? মানুষ কি বিজেপির এই প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করছেন? আসুন দেখা যাক কী বলছেন তাঁরা।
একটা পুরনো গল্প বলি। একজনের একটা রাজহাঁস ছিল, সেই রাজহাঁস প্রত্যেকদিন একটা করে সোনার ডিম পাড়ত। লোভী লোকটা আর অপেক্ষা করতে না পেরে একদিন হাঁসের পেট কেটে সব ডিম একসাথে বার করে নিতে চাইল। মরে গেল হাঁস, আর তার লোভী মালিকের কপালে জুটল লবডঙ্কা। বিজেপি লোভ দেখায়। বলে হাঁসের পেট কেটে ফেলো, সব সোনার ডিম বার করে নাও। কিন্তু পশ্চিম বাংলার মানুষ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ছেড়ে অগ্নিমিত্রা পালের কথায় বিশ্বাস করার মতো বোকামো তাঁরা কি করবেন? মনে তো হয় না।
দেখুন ভিডিও:







