এই জুন মাসের ১২ তারিখে ১৯৭৫, এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি জগমোহনলাল সিনহা ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন। রায়বেরিলি থেকে তাঁর নির্বাচনকেই বাতিল করে দিয়েছিলেন। কেবল এটাই নয়, ১৯৫০ থেকে বহুবার, বারবার সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট থেকে বহু রায় এসেছে সরকারের বিরুদ্ধে, মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে, সরকারি দফতরের বিরুদ্ধে। মানে এক স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার যে ছবি এঁকেছিলেন সংবিধান প্রণেতারা তা সাকার হয়েছিল। কিন্তু গত কিছু বছর ধরে এই ফ্রি ইনডিপেনডেন্ট জুডিশিয়ারি, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এমনকী বিচারকেরা, প্রাক্তন বিচারপতিরাও। এবং তারই সঙ্গে উঠে এসেছে এক ওভার অ্যাকটিভিজমের কথা। সরকার সিঁড়িতে চড়ে দোতলায় উঠবে না মইতে তা নিয়েও মামলা হচ্ছে এবং সেই মামলা চলছে তো চলছে তো চলছে। আমরা আগে কখনও শুনিনি বিচারকদের মুখে “ঢাকি সমেত বিসর্জন দিয়ে দেব”র মতো অসভ্য উচ্চারণ, আমরা আগে শুনিনি বিচারক পদত্যাগ করেই লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী হয়ে গেছেন, রায় দেওয়ার পরেই অবসর আর অবসরের ক’দিনের মধ্যে রাজ্যসভায় মনোনীত সাংসদ। না, আমরা এসব শুনিনি, এখন তা হচ্ছে। কাজেই এখন এক চলতি ধারণা হল দিল্লিতে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে মামলায় জিতবে মোদি সরকার, আর যেসব রাজ্যে বিরোধীরা ক্ষমতায় আছেন সেখানে হারবে রাজ্য সরকার, নিয়ম করে প্রতিটা মামলায়। পুলিশ জানিয়েছে, আপনি ওই এলাকাতে যাবেন না, গেলে আইন শৃঙ্খলার সমস্যা হতে পারে। তো লখিমপুর খেরিতে যেতে দেওয়া হল না রাহুল গান্ধীকে, আর মহেশতলায় যেতে পারলেন শুভেন্দু অধিকারী, আদালতের নির্দেশে। তো সেরকম এক আবহে হঠাৎই কলকাতা হাইকোর্টের এক রায় এসেছে যেখানে বলা হয়েছে, দুর্নীতি রুখতে রাজ্য সরকারকে যে কোনও শর্ত দিতে পারবে কেন্দ্র। তবে ১০০ দিনের কাজ আবার শুরু করতে হবে। সমগ্র প্রকল্পটিকে বন্ধ করে রাখা যাবে না। প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘এই সংক্রান্ত সমস্ত অভিযোগ ২০২২ সালের আগের। সেই সব নিয়ে আপনারা যা খুশি পদক্ষেপ করুন। কিন্তু এখন প্রকল্পের কাজ চালু করা হোক। সেটাই বিষয় আজকে, ১০০ দিনের কাজের বকেয়া টাকা সাধারণ মানুষ কবে পাবেন?
পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রের দেওয়া ১০০ দিনের কাজের টাকা নিয়ে বিস্তর দুর্নীতি হয়েছে। প্রকৃত সুবিধাভোগীদের বঞ্চিত করে ওই টাকা অন্যদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়েছে। এই যুক্তিতেই এ রাজ্যে ১০০ দিনের কাজের বরাদ্দ টাকা আটকে রেখেছিল কেন্দ্র। যে গাফিলতির কথা বলা হয়েছে সেই গাফিলতির জন্য উত্তরপ্রদেশে টাকা পাঠানো বন্ধ হয়নি, মধ্যপ্রদেশ বা বিহার টাকা পাঠানো বন্ধ হয়নি, বাংলার কৃষকরা যেন টাকা না পায়, সেটাই ছিল দিল্লিশ্বরের নির্দেশ। মানে খুব পরিষ্কার ভাতে মারো।
আরও পড়ুন: Aajke | জুতো মেরে গরু দান, চটি ছুড়ে ক্ষমা?
মনরেগার টাকা, কার বাবার? কার পিসির? দেশের মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় দেশের অত্যন্ত দরিদ্র মানুষেরা যাতে একেবারে না খেয়ে মরে তার জন্য এক সামাজিক ন্যায় প্রকল্প মনরেগা। এই মনরেগা নিয়ে মোদিজির দৃষ্টিভঙ্গি কী? আমাদের সব্বার মনে আছে ২০১৫ সালের বাজেট অধিবেশনে মোদিজির ভাষণ, ওই ক্রূর মুখ থেকে ঝরে পড়ছিল ব্যঙ্গ, অশিক্ষিত ব্যঙ্গ। বলছিলেন, আমি চাইলেই এই প্রকল্পকে স্ক্র্যাপ করে দিতে পারতাম, এ ধরনের ভিক্ষে দেওয়ার প্রকল্পকে বাতিল করাই উচিত। কিন্তু আমি কিছু টাকা দিয়ে এই প্রকল্পকে বাঁচিয়ে রাখব যাতে করে আগামী ভারতবর্ষের নাগরিকেরা জানতে পারে কংগ্রেসের এই বিফলতার ইতিহাস, যেখানে দেশের মানুষকে না খেতে দিয়ে কিছু ভিক্ষের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। হ্যাঁ ঠিক এই কথাগুলোই তিনি সেদিন বলেছিলেন। এক অশিক্ষিত মানুষের কাছে এটাই আশা করা যায়, কিন্তু মজার কথা হল সেই প্রকল্পকে তিনি আজও কেবল বাঁচিয়েই রেখেছেন তা নয়, বরাদ্দ টাকার অঙ্কও বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন, কারণ নিশ্চিতভাবেই আমলারা তাঁকে জানিয়েছেন এই প্রকল্প বন্ধ করলে এই কোটি কোটি মানুষ মারা যাবে। সেই প্রকল্পকেই হাতিয়ার বানিয়ে তিনি তা ব্যবহার করছেন বাংলার বিরুদ্ধে, ভাতে মারার চক্রান্ত করছেন। আজ হাইকোর্টের রায় অন্তত এটা তো সাফ বলে দিল যে এক ঘোর অন্যায় চলছিল। বাংলার কৃষক, গরিব মানুষজন কাজ করেছেন, তাঁরা সব্বাই তৃণমূল? কিন্তু যেহেতু ক্ষমতায় আছে তৃণমূল আর তাকে টাইট দিতে হবে তাই টাকা বন্ধ করে দাও। কাদের? গরিবস্য গরিবদের, এটাই রাজনীতি। আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে বাংলার গরিব মানুষের ১০০ দিনের কাজের সামান্য টাকাও যে সরকার অন্যায়ভাবে আটকে রাখে, সেই দল যখন এই রাজ্যের মানুষের ভোট চায় তখন তাদের ঠিক কী বলা উচিত? শুনুন মানুষজন কী বলছেন।
এদিকে এই রায়ের পরে বিপ্লবী সিপিএম দলের দাবি, তাদের জন্যই আজ বাংলার মানুষ তাদের হকের টাকা ফিরে পেল। হ্যাঁ, কথাটা খানিকটা তো সত্যিই, কারণ বিকাশ ভট্টাচার্য বা শামিম আহমেদরা এই মামলা শুরু করেছিলেন। কিন্তু একটা প্রশ্ন তো থেকেই যায় যে গান্ধীমূর্তির পাদদেশে এই টাকা দিতে হবে, দাবি জানিয়ে যে লড়াইয়ের সূচনা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যে উত্তর থেকে দক্ষিণ যাত্রা করেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, বা দিল্লিতে বারবার সমস্ত প্রয়োজনীয় নথিপত্র নিয়ে যে ধরনা দিয়েছিল তৃণমূল সাংসদেরা, সেগুলো মূল্যহীন? সেগুলোর কোনও দাম নেই? তাহলে সিপিএম সব ছেড়ে কিছু উকিলদের পলিটব্যুরো আর কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিয়ে নিন, আদালতে মামলা করেই দেশে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব আনার ব্যবস্থা করুন। বিজেপির এই হিংস্র ভাতে মারার চক্রান্তকে কেবল মামলা করে আটকানো যাবে না, তাকে পথে নেমেই মোকাবিলা করতে হবে।