কোথাও কি তাল কেটেছে, সুর গেছে ভোগে? কোথাও কি বেসুরো হচ্ছে গলা? এমনিতে আমাদের এই বঙ্গ বিজেপিতে সুকান্ত–দিলীপ–শুভেন্দু শিবিরের রগড়ানি, ঘষটানি খুব নতুন কিছুই নয়। দিল্লির নেতারা এর জটিলতা বুঝতেও পারবেন না আর পারলেও তার সমাধানের চাবিকাঠি তেনাদের হাতে নেই। বুঝতে হবে, দিলু ঘোষ আজন্ম আরএসএস, তিনি প্রচারকের দায়িত্ব সামলেছেন বহুকাল, ভার্জিনিটির খবর তো রাখা সম্ভব নয়, কিন্তু তিনি অবিবাহিত, হেক্কড়বাজ, মানে বুদ্ধিজীবীদেরও রগড়ে দেওয়ার কথা প্রকাশ্যেই বলতে পারেন আবার গরুর কুঁজে সোনা আছে গোত্রের কথাও অনায়াসে বলতে পারেন। সুকান্ত মজুমদার সেই অর্থে না আরএসএস না বিজেপি না হেক্কড়বাজ। অধ্যাপক মানুষ, বিজেপির রাজনীতিতে একেবারেই মানানসই নন, কিন্তু দিল্লির নেতাদের কাছে বাংলার ইন্টেলেকচুয়াল মুখ, আর উত্তরবঙ্গের বলেই এক আলাদা সমীহ আদায় করে নেন। কিন্তু শুভেন্দু অধিকারী? রাজ্যের অন্তত ৬০-৭০ শতাংশ বিজেপি কর্মী এনাকে তৃণমূলের সেই লাঠিয়াল বলেই চিনত যিনি দায়িত্ব নিয়ে বিজেপি কর্মীদের পিটিয়েছেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনে নমিনেশন দিতে দেননি। যিনি মাত্র ক’ বছর আগেই তৃণমূলের এক হোমড়া চোমড়া ছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন জেলে যাওয়ার ভয়ে এবং নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখেই ইনি বিজেপিতে এসেছেন। দিল্লির নেতারাও এ তথ্য জানেন কিন্তু তাঁদের লক্ষ্য তো বাংলার মসনদ কাজেই তাঁরা এনাকে ব্যবহার করার জন্যই দলে এনেছেন। কিন্তু সে তো ২০২১-এর স্ট্রাটেজি, যা কোনও কাজেই লাগেনি। ২০২৪-এও ডাহা ফেল করেছে, কাজে তো লাগেইনি বরং বাংলার বিজেপি সংগঠনে এক অদ্ভুত বিভাজন হয়েছে, আদি বিজেপি আর নব্য বিজেপি, তাদের লাগাতার দ্বন্দ্ব থামার কোনও লক্ষণ এখনও নেই। আর সেসব চলার মধ্যেই হঠাৎই শুভেন্দু ম্রিয়মাণ, তাঁকে না দেখা যাচ্ছে বৈঠকে, না দেখা যাচ্ছে রাস্তায়। এমনকী অতি ভদ্র বলে পরিচিত সুকান্ত মজুমদারও তাঁকে দলের সাংগঠনিক কাজে আনকমফর্টেবল বলে দাগিয়ে দিয়েছেন। সব মিলিয়ে তিনি আপাতত হোমে বা যজ্ঞে কোথাও নেই। তাই প্রশ্ন তো উঠছেই, দিল্লি থেকে কলকাতা, বেশ কিছু বিজেপির নেতাদের কপালে ভাঁজ পড়েছে, আর সেটাই বিষয় আজকে শুভেন্দুর মাথায় ঝুলছে খাঁড়া, দল ছাড়বেন নাকি?
কেন শুভেন্দু অনেকটাই বেসুরো? কেন তিনি প্রায় স্বভাববিরুদ্ধভাবেই সুকান্ত মজুমদারের কথায় মিডিয়ার সামনেও মাথা গরম করলেন, কেন তিনি দলের সাংগঠনিক বৈঠক এড়িয়ে যাচ্ছেন, কেন তিনি ইদানীং বহু প্রশ্নের জবাব দিতে চাইছেন না। কেন ইদানীং তাঁর মেজাজ তিরিক্ষি হয়েই আছে? এই এতগুলো কেন প্রশ্নের শুরুয়াত কিন্তু ওই কাঁথির সমবায় নির্বাচনের পর থেকে। নির্বাচনের ফলাফলের পরেই তাঁকে হতাশ দেখাচ্ছিল।
আরও পড়ুন: Aajke | দুয়ারে সরকার, আগামী দিনে প্রত্যেক সরকার নকল করবে
তো শোনা যাচ্ছে যে এই কাঁথির সমবায় ব্যাঙ্কের বেশ কিছু পুরনো হিসেব নিয়ে নাকি নাড়াঘাঁটা চলছে। কবেকার? সেই তখনকার যখন তিনি রাজ্য রাজনীতিতে এক বিরাট ব্যাপার, আর কাঁথির সমবায় বাঙ্কের মাথায় সেদিন এই কাঁথির অধিকারী পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্য। গল্পের শুরুয়াত নাকি সেইখান থেকে। নোটবন্দি হওয়ার পরে দেশের প্রত্যেক সমবায় ব্যাঙ্কের লেনদেন নিয়ে বহু ধোঁয়াশা রয়েছে, কারণ তার কিছুদিন পরেই এক সর্বভারতীয় সমীক্ষাতে বলা হয়েছিল, “Demonetization was used as an opportunity by this bank to make a quick buck through offer of money laundering services,” ডিমনিটাইজেশন, নোটবন্দিকে কাজে লাগিয়ে বেশ কিছু মানুষ বিরাট মূল্যের টাকা ব্যাকডেটে জমা করিয়েছেন, কালো টাকাকে অনায়াসে সাদা করিয়ে নিয়েছেন, এরমধ্যে গুজরাটের সমবায় ব্যাঙ্কগুলোর নাম এসেছে। কিন্তু রাজ্যে বিজেপি, কেন্দ্রে বিজেপি, সব মিলিয়ে সেই ঘাপলার তদন্ত হয়নি। কিন্তু কাঁথির বহু মানুষের অভিযোগ, ওই ক’দিনে কাঁথির সমবায় ব্যাঙ্কে নাকি কোটি কোটি টাকার এইরকমের ভুয়ো লেনদেন হয়েছে, জমা পড়েছে, কালো টাকা অনায়াসে সাদা হয়েছে। তো এইবারে নির্বাচনে জেতার পরে নাকি সেই সব হিসেবের খাতা বের করা হচ্ছে, এবং সেই কালো টাকা সাদা করার যাবতীয় তথ্যের বেশ কিছুটা নাকি হাতে এসেছে আর সেসব নাকি সিআইডির কাছেও যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এমনিতেই কাঁথির খোকাবাবুর সময় তো ভালো যাচ্ছিলই না, নির্বাচনে ম্যাজিক দেখানোর বদলে ফ্লপ শো হয়েছে, বিধায়করা সরে যাচ্ছেন, এমনকী বিধানসভাতেও তেমন বিরাট কোনও প্রতিরোধ তিনি গড়ে তুলতে পারেননি। তার উপরে গোদের উপর বিষফোঁড়া এই সমবায় ব্যাঙ্কের ঘাপলা। যদি যা শোনা যাচ্ছে, মানে যে টাকার অঙ্কের ঘাপলার কথা শোনা যাচ্ছে তার অর্ধেকটাও সত্যি হয়, তাহলে তা আগামী দিনে বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। আগামী নির্বাচনের আগেই এরকম অভিযোগ বাজারে এসে গেলে সামলাতে পারবেন আমাদের কাঁথির খোকাবাবু? আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, বেশ কিছুদিন ধরেই শুভেন্দু অধিকারীকে মাঝমাঠে দেখা যাচ্ছে না, কাঁথি সমবায় ব্যাঙ্কে হেরে যাওয়ার পরে শোনা যাচ্ছে তিনি নাকি নোটবন্দির সময়ে বিরাট অঙ্কের কালো টাকাকে সাদা করার কাজও করেছিলেন, সেসব সামলাতে কি তিনি আবার তৃণমূলমুখী হবেন? হতে পারেন? শুনুন মানুষজন কী বলছেন?
রাজনীতি এক সম্ভাবনার খেলা। কখন যে কে কোনদিকে যাবে, কে যে কখন দল ছাড়বে, কোন দল যে কখন কার সঙ্গে হাত মেলাবে, কোন মানুষ যে কখন পাল্টি খাবে আমাদের দেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি দেখলে তার ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভবই নয়। মনে আছে তো, আবার পাল্টি খাওয়ার একদিন আগে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের জবাবে বলেছিলেন লালু যাদব আমার বড় দাদার মতো আর তেজস্বীকে আমি স্নেহ করি, তাদের ছেড়ে আবার বিজেপিতে যাওয়ার কথা আপনারা, সাংবাদিকরা বলছেন যার কোনও ভিত্তি নেই। তার পরের দিন তিনি সোজা চলে গেলেন রাজ্যপালের কাছে, পদত্যাগ করলেন, আর বিজেপির সাহায্য নিয়ে আবার মুখ্যমন্ত্রী হলেন। তো আমাদের বাংলাতেও কি সেরকম এক উলটফের, সেরকম এক দলবদল দেখব আমরা? দেখতেই পারি, জেলে বসে চাক্কি পিসিং আর পিসিং কে চায় বলুন তো? আফটার অল জেল আর হুজ্জতি এড়াতেই তো বিরোধী দল থেকে লোকজন বিজেপিতে গিয়েছিল, দু’ একটা ব্যতিক্রম কি থাকবে না? দু’ এক জায়গাতে সেই জেলের ভাত না খেতে চাওয়া নেতারা কি বিরোধী দলে আসতে পারেন না?