চন্দ্রকোনা: পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার (West Midnapore) চন্দ্রকোনা ১ নম্বর ব্লকের জাড়া গ্রামের জমিদার বাড়ির রায়বাবুদের পরিবার ‘বধিষ্ণু পরিবার’ হিসাবে আজও পরিচিত। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মহানায়ক উত্তমকুমারের স্মৃতি বিজড়িত জাড়ার জমিদার বাড়ি। এবছর জাড়া জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো ২২৬ তম বর্ষে পদার্পন করবে। তাই পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে জোরকদমে। দালান বাড়িতেই বংশপরম্পরা মৃৎশিল্পী গড়ে তুলছেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশের মূর্তি। প্রতিমা গড়ার কাজও চলছে জোরকদমে। পুজোর আগে সেজে উঠছে চন্দ্রকোনার স্মৃতি বিজড়িত জাড়া গ্রামের জমিদার বাড়ি।
রাজা রামমোহন রায়ের বন্ধু ছিলেন জমিদার রাজীবলোচন রায়। তাই জাড়া গ্রামে নিত্য যাতায়াত ছিল রাজা রামমোহন রায়ের। আবার জাড়া জমিদার বাড়ির সঙ্গে সখ্যতা ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। জমিদার পরিবারের আমন্ত্রণে জাড়া স্কুলের স্থাপনা করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তৎকালীন সময়ে জমিদার বাড়িতে বেশ কয়েকবার এসেছিলেন বিদ্যাসাগর। এমনটাই জানিয়েছেন জাড়া জমিদার বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা। এমনকি জাড়া জমিদার বাড়িতে মহানায়ক উত্তমকুমার তাঁর ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবির শুটিং করেছিলেন। যার উল্লেখ রয়েছে ছবির একটি গানে। গানটি হল, ‘কি করে বললি জগা জাড়ার গোলক বৃন্দাবন, যেখানে বামুন রাজা চাষী প্রজা, চারিদিকে তার বাঁশের বন।’
আরও পড়ুন: শুরু হচ্ছে জিএসটি কাউন্সিল বৈঠক, কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা?
এই জাড়ার জমিদার বাড়িতে কবি গানের আসর বসত। বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রা নাকি এই গান বেঁধেছিলেন যা ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবিতেও তুলে ধরা হয়। স্মৃতি বিজড়িত জাড়া জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোও মহাসমারোহে পালিত হত। তবে শুধু শারদ উৎসব নয়, দুর্গাপুজোর পাশাপাশি কালী, বিষ্ণুদেবতা, শিব সহ একাধিক দেবদেবীর মূর্তি ও মন্দির রয়েছে। এখনও তিনবেলা ভোগ চড়িয়ে নিত্যসেবা করা হয়।
উল্লেখ্য, ১১৫৫ বঙ্গাব্দে(১৭৪৮ খ্রীস্টাব্দ) জাড়া জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাম গোপাল রায়। পরবর্তী সময়ে তাঁর ছেলে রাজা রাজীবলোচন রায় বর্ধমান রাজার থেকে ‘রাজা’ উপাধি লাভ করেছিলেন। তারপর থেকে জমিদারি আরও বিস্তারলাভ করে এবং তিনিই জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজোর সূচনা করেছিলেন। তৎকালীন সময়ে পুজোতে বহু মনীষী আমন্ত্রিত হিসাবে আসতেন বলে জানান জমিদার বাড়ির বর্তমান সদস্যরা।
জানা গিয়েছে, আগে পুজোর সময় ৬-৭ দিন কবি গানের আসর, যাত্রাপালা, নঙ্গর খানা চলত। পাশাপাশি, ১০-১৫ টি গ্রামের মানুষ ভিড় জমাতেন পুজোয়। চলত নরনারায়ণ সেবা। রুপোর পালকিতে করে গ্রামের একটি পুকুরে শোভাযাত্রা করে নবপত্রিকা স্নান করানো হত। বর্তমানে জমিদারিত্ব নেই। তবে রয়ে গিয়েছে জমিদার বাড়ির বিশাল প্রাসাদ। যা এখন ভগ্নপ্রায়। আগাছায় ঢাকা। জমিদার বাড়ির ২১টি পরিবার এখনও বসবাস করেন। কিন্তু তাঁদের অধিকাংশই এখন কর্মসূত্রে ভিনরাজ্য বা ভিনদেশে থাকেন। তবে পুজোর সময় অনেকেই হাজির হয় জমিদার বাড়ির দুর্গা পুজোয়। এবছর জাড়া জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো আনুমানিক ২২৬ তম বর্ষে পদার্পন করবে। পুজোয় আগের মতো জৌলুস না থাকলেও এখনও সমস্ত রীতিনীতি মেনেই পুজোর আয়োজন করা হয়। বৈষ্ণব মতে জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজো হওয়ায় কোনও বলি হয় না।
জানা গিয়েছে, নবপত্রিকা স্নান করাতে শোভাযাত্রা করে যাওয়া হয়। বিসর্জনের দিন পরিবারের সকল সদস্য মিলে বিসাদের সুরে গান গেয়ে মাকে গ্রামের পুকুরে বিসর্জন দেন। জমিদার বাড়িতে পুজোর দিনগুলিতে মায়ের জন্য ভোগ রান্না থেকে নাড়ু তৈরি একমাত্র অগ্রাধিকার পান পরিবারের মহিলারই। দুরদুরান্তের গ্রামের বহু মানুষ ভিড় জমায় পুজোর কদিন। তাঁদের জন্য খিচুড়ি প্রসাদের আয়োজন থাকে। এছাড়াও নরনারায়ণ সেবারও ব্যাবস্থা করা হয় পুজোয়।
দেখুন অন্য খবর