ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের। একজন সাংসদ ভালোরকম আহত, অন্যজনের বাঁহাতে চোট কিন্তু ডান হাতে প্লাস্টার নিয়ে সমাজ মাধ্যমে হাসাহাসি, কিন্তু কেউ খেয়াল করলেন না, কমরেড সেলিম তো দেখলেও বুঝবেন না, একদা কমরেড শঙ্কর ঘোষ এখন তাঁর সেই চে গুয়েভারার ট্যাটু কিন্তু মুছে ফেলেছেন, সেসব জায়গাতে এখন অন্য নানান আঁকিবুকি আছে, শিব থাকতে পারে, এক বাচ্চার ছবি তো দেখতেই পেলাম। কিন্তু বিরোধী দলের নেতা এম পি এম এল এ কে মারধর করাটা কি সুস্থ গণতন্ত্রের লক্ষণ? এর রাজনৈতিক প্রভাব আছে আর সেটা জেনেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তড়িঘড়ি দেখতে গেলেন খগেন মুর্মুকে। অন্তত এই ঘটনা থেকে সরকারকে সরানোর একটা অপটিকস তৈরি হল। দুজন গ্রেফতারও হয়েছে। এবং এই ঘটনা নিয়ে বিজেপি রাজ্যে প্রচার করবে, করাটাই স্বাভাবিক, যদিও সেই মুহুর্তেই তাৎক্ষণিক কিছু মৌখিক প্রতিবাদের পরেই তাঁরা ফিরে গেছেন সেই পুরনো ধামাধরা রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবিতে, বেতন পান রাজ্যপাল, কাজেই তিনি যে আহত আর ক্রুদ্ধ তা বলাই বাহুল্য, কিন্তু তিনিও এক ডাক হরকরা মাত্র, সাদা বাংলাতে পিওন, রাষ্ট্রপতির আদেশে কাজ করবেন আর রাষ্ট্রপতি কোথা থেকে সেই আদেশ উপদেশ পাবেন তাও তো সবার জানা। এই পর্যন্ত সবটাই কপিবুক স্টাইল, যদিও এর মধ্যে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন তো উঠেছে যে ডেকে নিয়ে গিয়ে পেটানো হল না তো? কিন্তু এবার তা নিয়ে গোটা দেশে প্রচার শুরুর তোড়জোড় করছে রাজ্য বিজেপি কেবল নয়, বিজেপির জাতীয় নেতারাও। খগেন মুর্মুর রক্তাক্ত মুখ, শঙ্কর ঘোষের হাতের প্লাস্টার, জংগল রাজ, এম এল এ এম পি রাও বাদ যাচ্ছেনা। কিন্তু ওনারা ভুলে যাচ্ছেন যে এই একটা ছবি গত ১৪ বছরের সব ছবিগুলোকে বার করে আনবে। সেই অগুনতি লাশ, পিটিয়ে মারার ঘটনা, গণধর্ষণের ছবি বেরিয়ে আসবে হু হু করে। এখানে শুনলাম সেই ছবি ডাউনলোড করে একজিবিশনের ব্যবস্থা করছেন তৃণমূল নেতারা। এ এক অদ্ভুত অবস্থা, এক নিশ্চিত সেম সাইড গোলের দিকে এগোচ্ছে বঙ্গ বিজেপি। সেটাই বিষয় আজকে দেখুন কীভাবে রাজ্য বিজেপি এবারে সেম সাইড গোল খাবে।
ওই রক্তাক্ত ছবিকে এ বার ‘রাজনৈতিক হাতিয়ার’ করে তুলতে চাইছে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই, দেশ জুড়ে বিভিন্ন জনজাতি প্রধান এলাকায় জনজাতি সাংসদের রক্তাক্ত মুখের ছবি বড় করে দেখানোর পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। লক্ষ্য একা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তৃণমূল নয়। লক্ষ্য কংগ্রেস-সহ গোটা ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে ‘জনজাতি বিরোধী’ হিসাবে চিহ্নিত করা। নাগরাকাটায় গত সোমবার দুপুর ১টা নাগাদ খগেন মুর্মু বা শঙ্কর ঘোষের ওপরে যারা হামলা চালিয়েছিল, তারা যে সব্বাই মুসলমান, তা জানিয়ে সমাজ মাধ্যমে পোস্ট করেছেন শুভেন্দু অধিকারী। এবার সেই বিষকে সারা দেশে ছড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামছে বিজেপি আই টি সেল। কিন্তু সমস্যা আছে, আর সেই সমস্যাটার কথা সন্তান দল বহু আগেই কলকাতার দেওয়ালে দেওয়ালে লিখে বেড়াতো। লেখা থাকত, চুলকাইয়া ঘা করিবেন না। হ্যাঁ ডাক্তারবাবুরাও এই কথাই বলেন, চুলকোলে একতা কিছু মলম ইত্যাদি দিতে পারেন, চুলকাবেন না, ঘা হবে সেটা সারানো যাবে না। ভাবুন তো গোধরার সেই ছবিগুলোর কথা, জ্যান্ত মানুষের পোড়া লাশের কথা, একজন প্রাক্তন সাংসদকে জ্যান্ত পোড়ানো হয়েছিল।
আরও পড়ুন: Aajke | জলদাপাড়ার গন্ডারেরাও ঘরে ফিরল, বিজেপির ভাগ্য ফিরল না
প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ এহসান জাফরি তাঁর পরিবার নিয়ে থাকতেন গুলবার্গ সোশ্যাইটিতে, চারিদিক থেকে ঘিরে যখন আগুন জ্বালানোর চেষ্টা চলছে তখন উনি পুলিশ কমিশনারকে ফোন করেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর পি এ কে ফোন করেছেন, মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করেছেন, আহমেদাবাদ শহরের মধ্যেই এক হাউজিং কমপ্লেক্স এ আগুন লাগানো হল, এহসান জাফরি সমেত ৬৯ জন পুড়ে মারা গেল। সেই ছবি আনা হবে না মানুষের সামনে? বেস্ট বেকারির ছবি আসবে না সামনে, পয়লা মার্চ ২০০২ এ জ্যান্ত পোড়ানো হল ওই বেকারির মালিক সমেত ১১ জন মুসলমান আর তিন জন হিন্দু কর্মচারীকে। সেই পোড়া, আধপোড়া দেহের ছবি তো আছেই, সেগুলো আনা হবে না সামনে? আদিবাসী মুখের ছবি? মণিপুরের সেই মহিলা, কার্গিল যোদ্ধার স্ত্রী, গণধর্ষণের পরে নগ্ন করে প্যারেড করানো হয়েছিল, সেই জাতিদাঙ্গার আগুন এখনও জ্বলছে। সেই সব ছবি আসবে না? আসবে না উন্নাও, কাঠুয়া, হাথরসের ধর্ষিতাদের ছবি যাদের ধর্ষকদের বাঁচানোর দাবিতে বিজেপি কর্মীরা মিছিল করেছিল? আসবে না পহলু খানের রক্তাক্ত ছবি? প্যান্ডোরার বাক্স খুলছেন বিজেপির নেতারা। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেষ করেছিলাম, দুই সাংসদ আর বিধায়কের মার খাবার ছবি নিয়ে পথে নামছে বিজেপি, কিন্তু তার পালটা সেই গোধরা রায়টের পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া মৃতদেহ আর বাড়ির ছবি, মণিপুরের ধর্ষিতাদের নগ্ন করে প্যারেড করানোর ছবি সামনে এলে বিজেপি কী জবাব দেবে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
বালক ব্রহ্মচারীই কি এই কথাটা বলেছিলেন, যেই বলে থাকুক, কাজের কথা, চুলকাইয়া ঘা করিও না। পেছনে অজস্র ছ্যাঁদা নিয়ে সূঁচ এর ছিদ্র বার করতে যাওয়া অবোধের মত কাজ করছে বিজেপি। এই ঘটনা অগণতান্ত্রিক, এই ঘটনা নিন্দনীয়, এই ঘটনার প্রতিবাদ তো হওয়াই উচিত, কিন্তু তা এই রাজ্যের মধ্যেই রাখলে কিছু প্রভাব তো পড়তো। এখনও বহু মানুষ আছেন যাঁরা এক নিরুপদ্রব শান্তি শৃঙ্খলাকে ১ নম্বরে রাখেন, তাঁদের কাছে একটা মেসেজ যেতো, কিন্তু যেই এটাকে সর্বভারতীয় করে তোলা হবে, অমনি তার প্রতিক্রিয়ায় বহু এমন ছবি বের হয়ে আসবে যা সোচ্চারে বিজেপি নেতাদের জানিয়েই দেবে চুলকাইয়া ঘা করিবেন না।
অন্য খবর দেখুন