আজ নয়, সেই কবেই আমেরিকা টের পেয়েছিল ইরান কোন ধাতুতে গড়া। যাঁরা ভুলে গেছেন তাঁদের মনে করয়ে দিই। ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খামেইনির নেতৃত্বে ইরানে ইসলামি বিপ্লব হয়েছিল। এই বিপ্লব আমেরিকার প্রায় পুতুল সরকার রেজা শাহ পাহলভির বহু দশকের শাসনের বা অপশাসনের মৃত্যুঘণ্টা ছিল। শাহ জমানায় মানুষের উপর অত্যাচার, পুলিশ, জেল, লাঠি, গুলি, গুমখুন করে এক দমনমূলক শাসনের জন্ম দিয়েছিল আর সেই শাহ রেজিম আমেরিকার সমর্থন পেত যা ইরানের মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয় আর সেই সময়ে আয়াতুল্লা খামেইনির নেতৃত্বে এক বিপ্লব শাহের জমানা বদলে নতুন জমানার সূত্রপাত করে। এদিকে বিপ্লবের পর শাহ চিকিৎসার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেন। স্বাভাবিকভাবেই ইরানের মানুষজন, সরকার এবং বিপ্লবীরা খেপে যায়, কারণ তারা শাহকে তাদের ‘শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করে দেশের মধ্যেই তাঁর বিচারের দাবি করছিল। তারা সঠিকভাবেই মনে করছিল, আমেরিকা শাহকে আশ্রয় দিয়ে ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। এই সময়ে ৪ নভেম্বর, ১৯৭৯, একদল ইরানি ছাত্র, যারা আয়াতুল্লাহ খামেইনির সমর্থক, তারা তেহরানে মার্কিন দূতাবাসে ঢুকে পড়ে আর দূতাবাসের ৬০ জনেরও বেশি কর্মীকে জিম্মি করে ফেলে। দাবি ছিল তাদের মুক্তির বদলে ক্ষমতাচ্যুত শাহকে আমেরিকাকে ইরানের কাছে ফেরত পাঠাতে হবে যাতে তার বিচার করা যায়। ওই জিম্মিরা ৪৪৪ দিন ধরে আটক ছিল।
সেই সময়কার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার প্রশাসন জিম্মিদের মুক্তির জন্য কূটনৈতিক চেষ্টা চালাতে চালাতেই হঠাৎ ১৯৮০ সালের এপ্রিলে, ‘অপারেশন ইগল ক্ল’ নামে এক সামরিক উদ্ধার অভিযান শুরু করে। কিন্তু এই অভিযান শুরুতেই থমকে যায়, মরুভূমিতে দুর্ঘটনার কারণে আটজন মার্কিন সামরিক কর্মী নিহত হন। এই ব্যর্থতা কার্টার প্রশাসনের কাছে বড়সড় এক ধাক্কা ছিল, হ্যাঁ তারপর মাথা নুইয়েছিল আমেরিকা, আলজেরিয়ার মধ্যস্থতায় ইরান ও আমেরিকার মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির শর্ত ছিল যে ইরান জিম্মিদের মুক্তি দেবে এবং বদলে আমেরিকা ইরানের যে সব সম্পদ দখল করেছিল, সব সম্পদ ফিরিয়ে দেবে আর সেই চুক্তিতেই বলা ছিল ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মার্কিন প্রশাসন হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু মার্কিনরা দুনিয়াতে কবে কোন প্রতিশ্রুতি পালন করেছে, নিজেদের স্বার্থরক্ষাই যাদের কাছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার তাদের কাছে প্রতিশ্রুতি কোনও ব্যাপারই নয়। এক্কেবারে এক চরিত্র ইজরায়েলের, হঠাৎ করে তারা খুঁজে বের করেছে ইশ্বরের প্রতিশ্রুতি, গডস প্রমিসড ল্যান্ড, তাদের ঈশ্বর তাদের বলে দিয়েছে ওটাই হল তোমাদের ভূখণ্ড, যাও দখল করো। খানিকটা বিজেপির রাম জন্মভূমির মতো, ওইখানেই আছে রামের আঁতুড়ঘর, ওইখানেই হবে মন্দির, মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে, সে মসজিদ ভেঙেও মন্দির করব, করলও। তেমনই ইজরায়েলিরা মনে করে তাদের ঈশ্বর তাদের জন্য এক ভূমি রেখে গেছেন, এতদিন সেখানে যারাই বাস করুক না কেন, তাদের ওই জমি চাই, এবং লড়াই শুরু, দখলদারির লড়াই, নির্লজ্জ অমানবিক, পাশবিক এক লড়াই। যা অন্যদিকেও জন্ম দিচ্ছে ঘৃণার, হিংসার। মধ্যপ্রাচ্যে এই ইজরায়েল হল আমেরিকার দারোয়ান, আমেরিকার যাবতীয় স্বার্থ তারা দেখরেখ করবে। বদলে তাদের পাশে দাঁড়াতে আমেরিকান বি টু স্টেলথ উড়োজাহাজ হানা দেবে মধ্যপ্রাচ্যের শহরে শহরে।
কেন? ট্রাম্প সাহেব জানিয়েছেন, শান্তি স্থাপনার জন্য, মানে শান্তি আনার জন্য তারা বোমারু প্লেন পাঠায়। একবার দেখুন মধ্যপ্রাচ্যে এই মুহূর্তে আমেরিকার যুদ্ধ প্রস্তুতিটা ঠিক কোন জায়গাতে দাঁড়িয়ে আছে। কেবল মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ৪০,০০০ থেকে ৫০,০০০ আমেরিকান সৈন্য মোতায়েন করা আছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা বা সেনা ঘাঁটি রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে। ১) বাহরিন: এখানে মার্কিন নৌবাহিনীর পঞ্চম নৌবহরের সদর দফতর। বাহরিনের গভীর সমুদ্রবন্দরে বড় মার্কিন সামরিক জাহাজ, যেমন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার রাখার, ব্যবহার করার ব্যবস্থা আছে। এখানে চারটে অ্যান্টি-মাইন ভেসেল এবং দুটি লজিস্টিক্যাল সাপোর্ট শিপের মতো নৌযানও মোতায়েন করা আছে। ২) কুয়েত: কুয়েতে অনেকগুলো মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, যার মধ্যে ক্যাম্প আরিফজান সবচেয়ে বড়। এটা CENTCOM-এর মার্কিন সেনাবাহিনীর ফরোয়ার্ড হেডকোয়ার্টার। আছে আলি আল-সালেম এয়ারবেস যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিমান পরিবহণ কেন্দ্র আর এখানে 386th Air Expeditionary Wing মোতায়েন রয়েছে। কুয়েতে MQ-9 রিপার-এর মতো ড্রোনও রয়েছে। ৩) কাতার: আল উদেদ এয়ারবেস কাতারে আর এটা CENTCOM-এর ফরোয়ার্ড কম্পোনেন্ট, তার সঙ্গে এর বিমান বাহিনী আর বিশেষ অপারেশন ফোর্সের ঘাঁটি। এটি রিভলভিং যুদ্ধ বিমান আর 379th Air Expeditionary Wing এর সদর দফতর, যেখানে এয়ারলিফট, এরিয়াল রিফুয়েলিং, ইন্টেলিজেন্স, নজরদারি এবং রিকনেসান্স করা হয়।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ইজরায়েল ধ্বংসের মুখে অথবা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ?
৪) সংযুক্ত আরব আমিরাশাহি, আল ধাফরা এয়ারবেস-এ 380th Air Expeditionary Wing মোতায়েন করা আছে, যা ১০টি স্কোয়াড্রন বিমান নিয়ে তৈরি আর MQ-9 রিপার সহ ড্রোনও এখানে রয়েছে। ৫) ইরাক: ইরাকে প্রায় ২,৫০০ মার্কিন সৈন্য মোতায়েন আছে, প্রাথমিকভাবে ISIS বিরোধী অপারেশন ইনহেরেন্ট রিজলভ-এর অংশ হিসেবে। আল-হারির আর আল-আসাদ এয়ারবেস সমেত বেশ কয়েকটা সামরিক ঘাঁটিতে মার্কিন উপস্থিতি রয়েছে। এই কিছুদিন আগে ইরাকি সরকার মার্কিন সামরিক উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, আলোচনা চেয়েছে, কিন্তু মার্কিন প্রশাসন কিংবা শান্তির ছেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনও কথা বলেননি। ৬) সিরিয়া: সিরিয়ার দক্ষিণে এবং পূর্বে প্রায় ১,৫০০ মার্কিন সৈন্য মোতায়েন করা আছে, যারা প্রধানত ISIS বিরোধী অভিযানের অংশ, স্থানীয় মানুষজনদের কাছে আতঙ্ক। যদিও এক পুতুল সরকার বসানোর পরে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া থেকে সেনা কমানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তবুও তাদের কিছু ঘাঁটি এখনও রয়েছে। ৭) জর্ডান: জর্ডানেও মার্কিন বাহিনীর ছোট ছোট ফাঁড়ি রয়েছে। এবং ৮) ইজরায়েল: ইজরায়েলে দুটি THAAD এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েন আছে, যা প্রায় ১০০ আমেরিকান সৈন্য দ্বারা পরিচালিত হয়। এছাড়াও, মধ্যপ্রাচ্যের চারপাশে সমুদ্রে মার্কিন নৌবাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে, যার মধ্যে বিমানবাহী রণতরী এবং ডেস্ট্রয়ার, যেমন USS Carl Vinson, USS Nimitz, USS The Sullivans, USS Arleigh Burke, USS Thomas Hudner আছে।
এই বিশাল সেনাঘাঁটি বা সেনাদের কাছে কী ধরনের অস্ত্র আছে? সেটাও জানা দরকার, কারণ আমেরিকা তো অস্ত্র দিয়েই শান্তি আনার কথা বলে। যুদ্ধবিমান আর ড্রোন: F-22 র্যাপ্টর স্টিলথ ফাইটার জেট, অন্যান্য যুদ্ধবিমান, এবং MQ-9 রিপার-এর মতো ড্রোন। বিমানবাহী রণতরী, ডেস্ট্রয়ার, অ্যান্টি-মাইন ভেসেল আর লজিস্টিক্যাল সাপোর্ট শিপ। বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অঙ্গ হিসেবে আছে প্যাট্রিয়ট সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল ব্যাটারি এবং Terminal High Altitude Area Defense এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। এছাড়াও আছে অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র যেমন হ্যান্ডগান, অ্যাসল্ট রাইফেল, মেশিন গান, স্নাইপার রাইফেল এবং গ্রেনেড লঞ্চার। এরপরে B-2 স্টিলথ বোমারু বিমানও এই অঞ্চলে মোতায়েন করা হতেই পারে। সেই আমেরিকা এবারে শান্তি প্রতিষ্ঠার নাম করে বোমা ফেলে এল ইরানে। এবার বিশ্বসুদ্ধু মানুষজনের চোখ ইরানের দিকে। ইরানের কাছে এই বোমাবর্ষণের প্রতিক্রিয়ায় তাহলে কী কী বিকল্প খোলা আছে? ইরান গত কয়েক দশক ধরে যে বহুস্তরীয় প্রতিরক্ষা মাল্টিলেয়ার্ড ডিফেন্স সিস্টেম এবং আক্রমণাত্মক সামরিক পরিকাঠামো তৈরি করেছে, তা এখন কেবল পুরোপুরি সক্রিয় হওয়ার অপেক্ষায়। ইরানের সামনে মূলত চারটি বড় দিক রয়েছে প্রতিক্রিয়ার জন্য, লাগাতার মিসাইল ও ড্রোন হামলা। ইরানের কাছে দূরপাল্লার মিসাইল আর সশস্ত্র ড্রোনের বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে, যা সরাসরি উপসাগরীয় দেশগুলোতে থাকা মার্কিন ঘাঁটি কিংবা ইজরায়েলের উপরে নিক্ষেপ করা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কুয়েত, বাহরিন, কাতার, ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে হাজার হাজার মার্কিনি সেনা বা বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকলেও, হঠাৎ হামলার ক্ষেত্রে পূর্ব সতর্কতা পাওয়ার সময় কম হবে।
দু’ নম্বর বিকল্প হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুমকি, যা এর মধ্যেই এসে গেছে, ইরানের পার্লামেন্ট এই বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে। বিশ্বের মোট ২০ শতাংশ তেল চলাচল করে এই হরমুজ প্রণালীর মাধ্যমে। ৩৩ কিলোমিটার চওড়া এই হরমুজ প্রণালীকে লক্ষ্য করে ইরান ছোট দ্রুতগতির নৌকা, সামুদ্রিক মাইন এবং উপকূলীয় ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। কিছু সময়ের জন্য হলেও, এই প্রণালীতে চলাচল বন্ধ হলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যাবে। আর একটা বিকল্প হল অঞ্চলজুড়ে ছায়াযুদ্ধ। ইরান তার ‘অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইরাক, ইয়েমেন, সিরিয়া ও লেবাননে সক্রিয় বহু মিলিশিয়া গোষ্ঠীকে সক্রিয় করতে পারে। বিশেষ করে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা ইতিমধ্যেই লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা শুরু করেছে আর আবার হামলা বাড়ানোর হুমকি দিয়েছে। এবং যেটা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তা হল পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে আসা, মার্কিন হামলার পর ইরান আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা (IAEA) এবং এনপিটি (Nuclear Non-Proliferation Treaty) থেকে ইরান সম্পূর্ণভাবে সরে আসতে পারে। এই পদক্ষেপ নিলে, ইরান উত্তর কোরিয়ার পথ অনুসরণ করে দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দিকে এগোবে এবং একবার সেই শক্তি হাতে পেলে তখন বকওয়াস ছাড়া আর কিছুই আমরা ওই নেতানিয়ানহু বা ট্রাম্পের মুখে শুনতে পাব না। কিন্তু এরফলে আঞ্চলিক বিপদের পরিণাম কী হতে পারে? সেটাও তো বোঝা দরকার। ইরান যদি সরাসরি মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালায় বা পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করে, তবে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্ব অর্থনীতিই বিপর্যস্ত হতে পারে। তেলের দাম বেড়ে গেলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুদ্রাস্ফীতি ভয়ঙ্কর চেহারা নেবে। আর তার পাশাপাশি, পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন আধিপত্যও প্রশ্নের মুখে পড়বে। ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সংঘাত এখন আর শুধু দু’টি দেশের ভেতরের সংঘাত নয়, বরং এর জের রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ, চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা বা দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে মার্কিন-চীন দ্বন্দ্বের মতো অন্যান্য ভূ-রাজনৈতিক সমস্যাগুলোকেও আরও অনেক জটিল করে তুলতে পারে। ইরান-আমেরিকা যুদ্ধ যদি বাস্তব রূপ নেয়, ছড়িয়ে পড়ে তাহলে সেটি শুধুমাত্র একটা আঞ্চলিক সংঘাত থাকবে না। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে এক ভয়াবহ সংকট তৈরি করবে, যার ফলে অনেকে বলছেন— এই উত্তেজনা যদি থামানো না যায়, তাহলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দরজাও খুলে যেতে পারে। বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে ইরানের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে— যেটি হয়তো আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ এবং বিশ্ব রাজনীতির গতি নির্ধারণ করে দেবে। কিন্তু সেসবের আগে একটা কথা বলাই যায়, এবারে আমেরিকা সম্ভবত একটু বেশি বেড়ে খেলেছে, তা খুব তাড়াতাড়িই তারা বুঝতে পারবে।