জেফ্রি এপস্টিন। নামটা কি চেনা চেনা লাগছে আপনার? যাঁদের লাগছে না, তাঁদের জানাই, এই জেফ্রি এপস্টিনকে ঘিরে এই মুহূর্তে তুমুল বিতর্ক চলছে আমেরিকায়। একের পর এক বিপুল ক্ষমতাধর সব মানুষের ছবি পাওয়া গিয়েছে এপস্টিনের সঙ্গে। এখন আপনি বলতেই পারেন, কী হয়েছে তাতে? ওই তো আমাদের পাড়ার অমুকদা, কত না নেতার সাথে ছবি তুলেছে, ফিল্মস্টারদের সাথেও ছবি তুলেছে, কী বা হয়েছে তাতে? না, তাতে হয়তো বিশেষ কিছু হয়নি। কিন্তু এপস্টিনের ব্যাপারটা একটু আলাদা। কেন আলাদা বুঝতে হলে আপনাকে এপস্টিনের পেশার ব্যাপারে জানতে হবে।
কী করতেন জেফ্রি এপস্টিন? এপস্টিন ছিলেন এক কুখ্যাত অর্থলগ্নিকারী ও দণ্ডপ্রাপ্ত যৌন অপরাধী। তাঁর বিরুদ্ধে বহু নাবালিকা মেয়েকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ছিল। ২০১৯ সালে তিনি কারাগারে আত্মহত্যা করেন। আর খালি এটুকুই নয়, পাশাপাশি এও অভিযোগ যে, ক্ষমতাধরদের পার্টিতে নাবালিকা মেয়েদের সাপ্লাই করত এপস্টিন। বোঝাই যাচ্ছে এপস্টিনের সাথে ছবি থাকা মানে, হয়তো ওই নাবালিকা পাচার চক্রের সাথেও যোগ থাকতে পারে। এই নিয়েই গোলমাল, যার নাম ‘এপস্টিন ফাইলস’ বিতর্ক। কীরকম ব্যাপারটা? বেশ, খুলেই বলছি।
মোদ্দা কথাটা হলো, জেফ্রি এপস্টিনকে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহুচর্চিত ‘এপস্টিন ফাইলস’ বিতর্ক ২০২৬ সাল পর্যন্ত গড়াতে চলেছে। সব নথি প্রকাশের জন্য নির্ধারিত সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও এখনও বিপুল পরিমাণ নথি প্রকাশ বাকি রয়েছে। গত মাসে মার্কিন কংগ্রেস প্রায় সর্বসম্মতভাবে একটি আইন পাস করে। ওই আইনে বিচার মন্ত্রণালয়কে (ডিওজে) জেফ্রি এপস্টিন সংক্রান্ত সব নথি প্রকাশ করতে বলা হয়। এই তথাকথিত ‘এপস্টিন ফাইলস’-এ রয়েছে প্রায় ৩০০ গিগাবাইট তথ্য। এর মধ্যে আছে কাগজপত্র, ভিডিও, ছবি ও অডিও ফাইল। এসব নথি মূলত এফবিআই-এর ফ্লোরিডা ও নিউইয়র্কে চালানো তদন্ত থেকে এসেছে, যা কয়েক দশক ধরে চলেছে। নতুন আইনে ১৯ ডিসেম্বরের মধ্যে সব নথি প্রকাশের সময়সীমা ছিল। সেই অনুযায়ী বিচার মন্ত্রণালয় তাদের ওয়েবসাইটে একটি আলাদা পেজ খুলে নথি প্রকাশ শুরু করে। এই পেজের নাম দেওয়া হয়েছে ‘এপস্টিন লাইব্রেরি’।
এখনও পর্যন্ত যে নথিগুলি প্রকাশ করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে আদালতের রেকর্ড, তথ্যের অধিকার আইনে পাওয়া কাগজপত্র এবং হাউস ওভারসাইট কমিটির আগে প্রকাশ করা নথি। তবে বহু ভুক্তভোগী এবং দু’দলের আইনপ্রণেতারাই অভিযোগ করেছেন যে, প্রকাশিত নথিগুলি অসম্পূর্ণ এবং অতিরিক্তভাবে কালো করে দেওয়া হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও গোপনীয়তা ঠিকমতো রক্ষা না হওয়ায় একাধিক ভুক্তভোগীর পরিচয় প্রকাশ পাওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
১২ থেকে ১৪ বছর বয়সের নাবালিকা – মূলত এদেরই যোগানদার ছিল এপস্টিন। দেশে দেশে ছড়ানো ছিল এই চক্রের জাল। ইতালি, চেকরিপাবলিক থেকে শুরু করে ইউক্রেন, এরকম নানা দেশের নাবালিকাদের তুলে আনা হত। যদিও আমাদের কাছে এসব কোনও নতুন খবর নয়। মধ্যপ্রদেশে গত দেড় বছরে নাবালিকা ও প্রাপ্তবয়স্কা মিলিয়ে মোট ২৩ হাজার মহিলা স্রেফ গায়েব হয়ে গিয়েছে। কোথায় গেছে, কেন গেছে, কোনও হিসেব নেই এসবের। মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকারেরও তাতে বিশেষ কিছু এসে যায় না। আরে দাদা, আপনারাই তো স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’। এরকম মধ্যযুগীয় স্লোগান আপনাদের দিতে হয়ই বা কেন? জবাব নেই এসবেরও।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর এর নামে যা চলছে তা এক হাস্যকর তামাশা
এবার ফিরে আসি এপস্টিনের কথায়। ‘এপস্টিন ফাইলস’ নিয়ে সবচেয়ে বড় চমক আসে বড়দিনের ঠিক আগে। বিচার মন্ত্রণালয় জানায়, নিউইয়র্কের ফেডারেল দফতর এবং এফবিআই মিলিয়ে আরও ১০ লক্ষের বেশি নতুন নথি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, যা এপস্টিন মামলার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। এই নথিগুলি যাচাই ও সম্পাদনা করতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে বলে জানানো হয়েছে। এই ঘোষণার পর মার্কিন কংগ্রেসে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, আইন পাস হওয়ার এক মাস পরে এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের নির্দেশের বহু মাস পর এত বিপুল নথি কীভাবে হঠাৎ পাওয়া গেল? এপস্টিনের ভুক্তভোগীদের আইনজীবীরাও পুরো প্রক্রিয়াকে ব্যর্থ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, প্রশাসন শুরু থেকেই প্রতিশ্রুতি ভেঙেছে এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছে। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান—উভয় দলের সাংসদেরাই স্পষ্ট করেছেন, আইন অনুযায়ী সব নথি প্রকাশ না হলে বিচার মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তাদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। সব মিলিয়ে, ‘এপস্টিন ফাইলস’ নিয়ে বিতর্ক, ক্ষোভ ও প্রশ্ন আপাতত থামছে না। নতুন নথি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ২০২৬ সালেও এই ইস্যু মার্কিন রাজনীতি ও বিচার ব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিতে পারে।
এবার উল্টোদিকের ব্যাপারটাও দেখুন। কাদের কাদের দেখা যাচ্ছে এপস্টিনের সঙ্গে? নম চমস্কি থেকে বিল গেটস, বিল ক্লিনটন থেকে বৃটেনের রাজ পরিবারের লোকজন – সব বড় বড় ছক্কাপাঞ্জার লোকজন। হ্যাঁ, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নামও এসেছে এই তালিকায়। হইহই পড়ে গিয়েছে এই জন্য যে, এরপর কোন নেতা, কোন শিল্পপতিকে দেখা যেতে পারে এপস্টিনের পাশে? ভারতেও এই নিয়ে চর্চা চলছে। কিন্তু আসল কথা হল, মার্কিনী মিডিয়া কিন্তু থেমে নেই। তারা প্রশ্ন করছে, চমস্কি থেকে বিল গেটস, প্রতিক্রিয়া জানতে চাইছে তাঁদের। আর আমাদের এখানে? প্রত্যেকদিন চেপে ধরা হচ্ছে নিউজ মিডিয়াকে। নেতাদের মনের মতো কথা বলতে হবে। কেউ যদি না বলে, কেউ যদি সত্যের খোঁজ করে, কী হবে তাহলে? খুন হয়ে যেতে হবে গৌরী লঙ্কেশের মতো। এই দেখুন না, মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি এক নির্দেশ জারি করেছেন পুলিশকে। সেখানে বলা হয়েছে, কোন ইউটিউবার যদি ভুলভাল তথ্য দেয় তবে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। এখানে ভুলভাল মানে অবশ্যই যাকে বিজেপির নেতারা ভুল বলে মনে করেন। কিন্তু বিজেপি যখন মহাত্মা গান্ধী বা নেহেরুকে নিয়ে ভুলভাল বকবে, তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। আরে, এটা তো জানা কথা, যত বেশি ইউটিউবার যত বেশি খবর করবে, পয়সাখোর দালাল মিডিয়ারা তত বেশি প্রশ্নের মুখে পড়বে। বিজেপির মতো স্বৈরাচারী দল এসব ঝুঁকি নেয় না। তাই বন্ধ কর ইউটিউবারদের মুখ।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা কিন্তু বাকি থেকে গেল। সেটা প্রথমেই একবার জানিয়েছি, এখন আবার বলি দেখুন, ‘এপস্টিন ফাইলস’ বিতর্ক যতই ঘোরালো হোক না কেন, মার্কিন কংগ্রেস কিন্তু সর্বসম্মতভাবে আইন পাস করে, বিচার মন্ত্রণালয়কে জেফ্রি এপস্টিন সংক্রান্ত সব নথি প্রকাশ করতে নির্দেশ দিয়েছে। আর আমাদের এখানে, ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে সংসদের বিশেষ অধিবেশনের দাবিতে লাগাতার গলা ফাটালো বিরোধীরা। আর মোদিজি চুপচাপ দেখে গেলেন।
যাক গে সেসব। খালি মনে রাখবেন ২০১৯ থেকে ২০২১-এর মধ্যে ভারতে ১৩ লাখেরও বেশি মহিলা নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন। আর এটাও মনে রাখবেন, ভারতের স্বৈরাচার এতটাই মাথা ছাড়া দিয়েছে, সে গলা টিপে ধরতে চাইছে সাংবাদিকের, ভেঙে চুরমার করতে চাইছে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। মনে রাখবেন এই কথা। মনে রাখবেন সেই কবিতাটাও – ‘ওরা যখন আমার পাশের পাড়ার লোককে তুলে নিয়ে গেল, আমি চুপ করে ছিলাম। ওরা যখন আমার পাশের বাড়ির লোককে তুলে নিয়ে গেল, আমি চুপ করে ছিলাম। ওরা যখন আমাকে তুলে নিয়ে গেল, সবাই চুপ করে ছিল’।
দেখুন আরও খবর:







