Wednesday, November 19, 2025
HomeScrollFourth Pillar | বাংলা দখলের খেলায় নেমে পড়া সোশ্যাল মিডিয়ার হনুমান বাহিনীকে...
Fourth Pillar

Fourth Pillar | বাংলা দখলের খেলায় নেমে পড়া সোশ্যাল মিডিয়ার হনুমান বাহিনীকে কীভাবে আটকাবেন?

এলাকা ভাগ করে, টার্গেট ভাগ করে এক আইটি বাহিনী তৈরি করেছে বিজেপি!

Written By
অনিকেত চট্টোপাধ্যায়

বিজেপির সামনে এই মুহুর্তে তিনটে রাজ্যের নির্বাচন, ‘টোয়েন্টি ফোর ইন্টু থ্রি সিক্সটি ফাইভ ডেজ ইলেকশন মোড’-এ থাকা বিজেপি এবার আরও সক্রিয়। দক্ষিণে তাদের প্রথম অসুবিধে হল ভাষা, দ্বিতীয় অসুবিধে হল ঐ কড়া হিন্দুত্বের ডোজ দক্ষিণে অচল, সেই কবেই পেরিয়ার সাহেব ‘সে গুড়ে গ্যামাক্সিন’ ঢেলে দিয়ে গিয়েছেন। যাকে বিজেপি সনাতন বলে, সেই সনাতনীদের শঙ্করাচার্য যে দক্ষিণের মঠ থেকে সারা ভারতে ছড়ালেন তাঁর জ্ঞান, সেই দক্ষিণেই বিজেপি চেষ্টার কমতি রাখেনি। কেরালাতে আজ আরএসএস-এর সবচেয়ে বেশি শাখা, কিন্তু এক দুর্ভেদ্য এলাকা, অন্তত ২০২৬-এই কিছু একটা করা যাবে এমনটা বিজেপিও মনে করে না, তাদের হিসেবের খাতায় সেটা এখনও দশ কি ১৫ বছর পরে। তারা খোঁজে আছেন মিরজাফরের, খোঁজে আছেন রায়দুর্লভের, যাদের বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া দক্ষিণে তারা ঢুকতে পারছে না, একটা নিতীশ কুমার তাদের জুটছে না। তাই তাদের লক্ষ্যভেদে মাছের চোখ হল এই বাংলা। সাম, দান, দন্ড, ভেদ – সব নিয়েই তারা মাঠে নেমেছে। এসআইআর চলছে, চেষ্টা চলছে একটা সাইজেবল মুসলমান ভোটারকে যদি বাদ দেওয়া যায়, অন্তত ডাউটফুল ভোটার তালিকাতে রেখে দিলেও তো ভোট পার করে দেওয়া যাবে। মানুষ আশঙ্কায়, মানুষ আত্মহত্যা করছে, কেরালা, তামিলনাড়ুতে বিএলও, শিক্ষক আত্মহত্যা করছে। কিন্তু এসআইআর কেবল চলবে না, তাকে বন্ধ করার কোনও কথাই সম্মিলিত বিরোধীদের নেই, বরং বিকাশ ভট্টাচার্য, যিনি সেই কবে থেকেই বিজেপির জন্য থালায় করে ইস্যু বার করে পাত পেড়ে বসিয়ে খাওয়ান, তিনি বলেছেন কেন এক মাসের মধ্যে করা সম্ভব নয়? কেন এই আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে? কোন আতঙ্কে একজন মাস্টারমশাই কেরালাতে আত্মহত্যা করলেন, উনি কী জানার চেষ্টা করেছেন?

এই ক’দিনের মধ্যেই যে ১৫ থেকে ১৬ জন মানুষ এই রাজ্যে এই আতঙ্কেই হয় মারা গিয়েছেন, না হলে আত্মহত্যা করেছেন। নাকি নিয়ম আর রীতি অনুযায়ীই শুভেন্দু যা বলছেন, এগুলো সব বানানো, এই কথার সঙ্গেই একমত? কেবল এসআইআর নয়, যাবতীয় পুরানো ইস্যু সামনে আসছে আবার, বিভিন্ন জায়গাতে এতদিন ধরে পুষে রাখা গদ্দারেরা মুখ খুলছে, আবার শুরু হয়েছে সেইসব ব্যবসায়ীদের বাড়ি দফতরে রেইড, যারা তৃণমূলকে সামান্যতম আর্থিক সাহায্য করেছে। এগুলো হচ্ছে এক জায়াগা থেকে আসা নির্দেশ মত, এক গ্রান্ড প্ল্যানের অংশ হিসেবেই। হ্যাঁ, বাংলা বিজেপির চাই। আর ঠিক সেই সময়ে খেয়াল করে দেখুন, চুড়ান্ত সক্রিয় হয়েছে বিজেপির আইটি সেল। যে ট্রোল বাহিনী এতদিন একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল, তাঁরা আজ অ্যাডভান্স রেমুনারেশন পেয়ে উঠে পড়ে বসেছে। আর তাই সামান্যতম বিজেপির বিরোধিতা, সঙ্গে সঙ্গে কুৎসিত কদর্য ভাষায় গালাগালি। এবং খেয়াল করলে দেখবেন, এর একটা প্যাটার্ন আছে, এটা এলোমেলো নয়, খুব সুচিন্তিতভাবেই এই কাজ চলছে। সমাজ মাধ্যমের এই প্যাটার্নটা আসুন একটু বুঝে নিই। এই আইটি বাহিনী, যারা কোনও পোস্টের উপর তাঁদের প্রতিক্রিয়া দেন, তাঁদের চারটে অংশ আছে। এলাকা ভাগ করে, টার্গেট ভাগ করে, এক বাহিনী তৈরি করেছে বিজেপি আইটি সেল, যার চারটে স্তর আছে।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar |ভোট লুঠ আর নির্বাচন কমিশনের সাহায্যেই কি নিতীশ কুমার ফিরলেন মসনদে?

প্রথম স্তর হল স্পটার, মানে এনাদের কাজ চিহ্নিত করে দেওয়া। এই স্পটাররা আপাতভাবে নানান বিষয় নিয়ে পোস্ট দেন, মাঝে মধ্যে সামান্য বিজেপি টিল্ট, বিজেপির দিকে ঝুঁকে পড়া থাকলেও এনারা এমনিতে সুভদ্র, কোনও খারাপ শব্দ উচ্চারণও করেন না। সেদিনের সোনাঝরা সন্ধ্যায়, সূর্যাস্তের ছবি, আমি আর আমার বন্ধুরা পার্ক স্ট্রিট বা চীনেপাড়ার রেস্তঁরার ছবি, আজ ভগৎ সিং-এর জন্মদিন, মোদিজি বলেছে – জাত পাতের উর্ধে এক নতুন ভারত নির্মাণ করতে হবে, আসুন না এই বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। এই ধরণের পোস্ট দেন, অনায়াসে এনারা আপনার বন্ধু তালিকাতে ঢুকে পড়তে পারেন, এনাদের প্রোফাইল খোলা, লকড নয়, এনারা জেনুইন, অনেকের ঐ ‘নীল টিক’ও আছে। কিন্তু এরা স্পটার, এনাদের কাজ হল – আপনার কোন পোস্টটাকে নিয়ে ট্রোল করা শুরু হবে, কোন পোস্টটা বিজেপির পক্ষে খুব খারাপ, কোন পোস্টের জবাব দেওয়া উচিত – সেগুলোকে চিহ্নিত করা। ব্যস, এখানে তাঁদের কাজ কিন্তু শেষ, ওনারা কোনও জবাব দেবেন না, লাইক বা কমেন্ট করবেন না, কেবল শেয়ার করে দেবেন কিছু গ্রুপে, আর এনারা যে শেয়ার করছেন সেটা দেখা গেলেও কাকে শেয়ার করলেন, সেটা দেখা যাবে না। এনাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়, এনারা একটু খুঁজলে দেখতে পাবেন বিভিন্ন কমিটির মেম্বার, টেলিফোন, রেল যাত্রী সেবা এরকম নানান কমিটি, মাস গেলে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা নিশ্চিন্ত আয়। এঁরা আপনার ফেসবুক বন্ধু তালিকাতেই আছেন, এঁদের অনেকে আরএসএস-এর শাখা সদস্য। এরপরে আসবে দ্বিতীয় গ্রুপ, যাঁদের কাজ ওই পোস্টগুলোর বিরুদ্ধে জবাব লেখা, রিসার্চ করা, আর সেই পোস্টদাতাকে একটা স্ট্যাম্প মারা – আপনি তো চটি চাটেন, আপনি তো বিমানে করে আলিমুদ্দিন যান, আপনি তো নকু, আপনি তো ওপার বাংলার কুসলমান, ইত্যাদি, ইত্যাদি। তৃতীয় দল সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো আপনার লেখার পরে পোস্ট করতে থাকবেন, প্রায় একই ভাষা, প্রায় একই বক্তব্য। এঁদের অধিকাংশের খেয়াল করবেন প্রোফাইল লকড। এরপরের খেলা চতুর্থ বাহিনীর। দুটো ক্ষেত্রে চতুর্থ দলেরা নামবে বা তাঁদের নামার সিগন্যাল দেবেন ওই দু’নম্বর গ্রুপের কর্তারা। (১) যদি আপনি পালটা যুক্তি দিতে থাকেন, যদি আপনি তাঁদের লেখাগুলোকে কাউন্টার করে সত্যিটা বলার চেষ্টা করেন। (২) যদি আপনি ইগনোর করেন। তোরা যা লিখবি লেখ, আমি আমার কথা বলেছি। হ্যাঁ, তাহলে নামানো হবে চতুর্থ বাহিনীকে। এঁরা হলেন সেই ফুট-সোলজার, যাঁরা জানেন না কেন লড়ছেন, কার বিরুদ্ধে লড়ছেন, কী জন্য লড়ছেন। আপনি রাজা রামমোহন রায় নিয়ে লিখেছেন, ইনি সম্ভবত রামমোহন রায়ের নামও শোনেননি, ইনি আপনার পোস্ট পড়েও দেখেননি, আপনি কংগ্রেস না সিপিএম না নকশাল নাকি কিছুই নয়, সে নিয়ে ওনাদের মাথা ব্যাথা নেই, এনারা ফুট-সোলজার, গুলি চালাতে বলেছে, গুলি চালাচ্ছেন। কী রকম গুলি? কদর্য ভাষায় গালিগালাজ, কদর্যতম ভাষায় গালিগালাজ, মা-বাপ তুলে, যা খুশি, যা মুখে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনার পোস্টের তলায় ২০ থেকে ৩০ থেকে ৪০টা এরকম পোস্ট, যেগুলো কেবল নোংরা গালিগালাজ। আপনি কী করবেন? ইগনোর করবেন, তাইতো? পরের পোস্টে আবার, তার পরের পোস্টে আবার। সাইবার ক্রাইমে খবর দিন, ওনারা প্রথমেই যে সুসমাচারটি আপনাকে দেবেন তা হল, আপনার সমাজ মাধ্যমকে পাবলিক থেকে কেবল বন্ধুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখুন। আপনি সেই কেবল বন্ধু মোডে চলে গেলেন, আবার পোস্ট দিলেন, এবারে আর কোনও ঝামেলা নেই। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখবেন আপনার পোস্টে সেই ৩৬টা কি ৭২টা লাইক আর ১৫টা কি ২০টা কমেন্টস, সবই আপনার সেই বন্ধুবান্ধব যাঁরা আপনি যা বলেন, বলতে চান তার সঙ্গে একমত। মানে সেটা আর সমাজ মাধ্যম থাকল না, আপনার বৈঠকখানা হয়ে গেল, আপনি সীমাবদ্ধ হয়ে গেলেন।

হ্যাঁ, এটাই তো চায় ওই আইটি সেল, আপনি পড়াশুনো করে, বই ঘেঁটে রিসার্চ করে ওই বিশ্বাসঘাতক, ওই মিথ্যেবাদী, ওই জোচ্চরদের মুখোশ খোলার চেষ্টা বন্ধ করে নিজের বৃত্তে বকম-বকম করে যান। নিজেরাই নিজেদের লেখা পড়ে চমৎকৃত হন। হ্যাঁ, এই জন্যেই চার সারির বাহিনী তৈরি করেছে এই বিজেপি আইটি সেল। দেখুন ঠিক এই মুহুর্তে তারা ভয়ঙ্কর রকমের সক্রিয়। তাহলে উপায়? তাহলে একটাই উপায় – সম্মিলিত প্রতিরোধ। এই ট্রোলারদের খুঁজে বার করুন, একটাকে ধরলে দশটার নাম পাওয়া যাবে, তারপর তাঁদের বাড়িতে যান, তাঁদের বাবা-মা-ভাই-বোনেদের দেখান কারা এরা? কোন কদর্য ভাষায় কথা বলছে, পুলিশে খবর দিন, দু’চারটে পর পর অ্যারেস্ট হোক, তারপর মাথাগুলোর নাম বার করা হোক, এক্সপোজ করা হোক সেই জানোয়ারদের, এবং শেষে ঐ সাংঘাতিক মুখোশ এঁটে বসে থাকা আসল নাটের গুরুদের দু’একটাকে বাবুঘাটে নিয়ে গিয়ে গঙ্গা দর্শন করানো হোক। বন্ধ হবে এই বাঁদরামি। এই বাঁদরামি বন্ধ হলে তবেই আপনি আপনার মতামত দিতে পারবেন। হ্যাঁ, সে মতামত যার পক্ষেই হোক না কেন, কিন্তু সেই মতামত প্রকাশের সামনের দেওয়ালটাকে রেখে দিয়ে নিজেই বোরখার আড়ালে চলে যাওয়ার তো কোনও মানে হয় না। আগামী এক মাস এটাই হোক আমাদের একমাত্র কাজ। লিখুন, মন খুলে লিখুন, আর বার করুন এই হনুমানের দলের ঠিকানা, নাম, কুষ্টি আর গুষ্টির খবর।

দেখুন ভিডিও:

Read More

Latest News