একটা সহজ কথা দিয়ে শুরু করি। ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ। আর গণতন্ত্র কাকে বলে সে তো ক্লাস এইটের সিলেবাসেই লেখা আছে– জনগণের জন্য, জনগণের মধ্যে থেকে এবং জনগণের দ্বারা নির্বাচিত শাসনব্যবস্থা। এখন ভারতের যে গণতন্ত্র, যার সম্মান দেশ-বিদেশে, বহুবার টলমল করেও যে গণতন্ত্র আজও দাঁড়িয়ে আছে, সেই গণতন্ত্র আজ কিন্তু বিপন্ন। কেন বিপন্ন? তার কারণ সর্ষের ভিতরেই ভূত। গণতন্ত্রের অন্যতম হাতিয়ার ভোটাধিকার। কিন্তু মানুষের সেই ভোট দেওয়ার অধিকারকেই আজ এই দেশে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া হচ্ছে। সোজা কথায়, গণতন্ত্রের মুখোশ পরে স্বৈরতন্ত্র থাবা বাড়াচ্ছে ভারতের সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতির দিকে। আসব সেই কথায়। কিন্তু তার আগে, চলুন, ঘড়ির কাঁটাকে একটু পিছনের দিকে ঘোরানো যাক।
সাহেবরা এরকম বলেন যে, যিশুক্রিস্টের জন্মের আগে, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে গ্রিসের নগর রাষ্ট্রে বিশেষ করে এথেন্সে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু ছিল। প্রথম দিকে, গণতান্ত্রিক নাগরিকত্বের সুবিধা পেতেন শুধু অভিজাতরাই। পরবর্তী সময়ে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের হাতে এই অধিকার তুলে দেওয়া হয়। আর শুধু গ্রিসই বা কেন? রোমের সেনেট ব্যবস্থাতেও এই গণতন্ত্রের ছায়া দেখা যায়। কিন্তু এ তো গেল সাহেবদের কথা। আমাদের দেশে বুদ্ধদেব যখন তাঁর স্বধর্মের প্রচার করছেন, তখনও লিচ্ছবি দেশে গণতন্ত্র চালু ছিল। তার নাম ছিল লিচ্ছবি গণতন্ত্র। কাজেই সেদিক থেকে দেখলে, আমাদের দেশে গণতন্ত্র আগেও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু, পরেও থাকবে কি? সেটাই কিন্তু প্রশ্ন।
আমরা জানি, ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন নিয়ে গোটা দেশের রাজনৈতিক হাওয়া গরম হয়ে উঠছে। বিরোধী বনাম ইলেকশন কমিশনের লড়াই তুঙ্গে উঠেছে। কিন্তু কেন? ভোটার লিস্টের সংশোধন নিয়ে বিরোধীদের এই মাথাব্যথা কেন? এমন তো হয়েই থাকে। যারা মারা গিয়েছেন বা বিদেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন, ভোটার লিস্ট থেকে তাঁদের নাম বাদ দিয়ে সেই তালিকা সংশোধন করাই তো উচিত। না হলে, এই সুযোগ নিয়ে ভোটচুরি করতে পারে যে কেউ। ফল্স ভোটারের ভিড় লাগিয়ে, বুথ জ্যাম করে অন্যায়ভাবে জেতাতে পারে যে কোনও প্রার্থীকে। ইলেকশন কমিশন যদি এটা আটকাতে চায়, তাতে অসুবিধে কোথায়? অসুবিধে এই যে, ইলেকশন কমিশন ঠিক এই উদ্দেশ্যে ভোটার তালিকার সংশোধন করছে না বা বলা ভালো তাদেরকে করতে দেওয়া হচ্ছে না। হ্যাঁ, এটাই বিরোধীদের আসল অভিযোগ। আপনি, যিনি এই অনুষ্ঠান দেখছেন, তার এই মূহূর্তে মনে হতেই পারে ষে, এবার ঝেড়ে কাশুন তো দেখি। খোলাখুলি বলুন তো কী বলতে চান?
বেশ তবে সরাসরিই বলছি, আদতে কথাটা এই, বিজেপি নিজের পছন্দসই ভোটার ছাড়া আর কাউকেই রাখতে চাইছে না। বিজেপিকে যারা গদিতে বসিয়ে রাখতে পারে তারা ছাড়া বাতিল বাকি সবাই। শুধু ভোটার লিস্ট থেকেই নয়, বিজেপি তাদেরকে ছেঁটে ফেলতে চাইছে দেশ থেকেই। অনুপ্রবেশকারীর তকমা লাগিয়ে লাথি মেরে বের করে দিতে চাইছে দেশের বাইরে। কী করে বোঝা গেল? এই কিছুদিন আগে, রাহুল গান্ধী যখন ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনী নিয়ে মোদি সরকারকে তীব্র আক্রমণ করলেন, তার পরপরই কিন্তু ইলেকশন কমিশন চলে এল দেশের মানুষের নজরে। নাগরিকেরা ভোটার লিস্ট খুঁটিয়ে দেখা শুরু করলেন আর যা দেখা গেল তা কিন্তু চমকে দেওয়ার মতোই। কেরালার ত্রিশূরে প্রসন্না, যিনি তার বাড়ির একমাত্র ভোটার, খুঁজে পেলেন তাঁর বাড়ির ঠিকানায় নাম উঠেছে এমন ন’জন ভোটারের, যাদের তিনি চেনেনই না। এ তো ছোট একটা ঘটনা। মৃতদের নাম জ্বলজ্বল করছে ভোটার লিস্টে। একশো দশ, একশো পনেরো, একশো চব্বিশ বছর বয়সি ভোটাররা গণতন্ত্রের ভূতের মতো ঢুকে পড়েছেন ভোটার লিস্টে। এ কী ধরনের নিবিড় সংশোধনী?
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদিজি ঘরে বাইরে খুব দ্রুত তাঁর গুরুত্ব হারাচ্ছেন
বিষয়টা কিন্তু এমন ছিল না। ভারতীয় গণতন্ত্রের এক গর্বের জায়গা ছিল নির্বাচন কমিশন। ১৯৬০-এর শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনকে কিন্তু কড়া রেফারির মতো শক্ত হাতে ভোটের খেলা চালাতে হয়নি। কংগ্রেস তখনও বিপুল শক্তি ধরে রেখেছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের আবেগ দখিনা বাতাস জুগিয়েছিল কংগ্রেসের পালে। কিন্তু, ইলেকশন কমিশনের আসল পরীক্ষা শুরু হল জরুরি অবস্থার পরের নির্বাচন। ১৯৭৭-এর জানুয়ারিতে জয়প্রকাশ নারায়ণকে লেখা একটি চিঠিতে চরণ সিং উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন এই বলে- ‘ইন্দিরাজী ভোট করার কথা ভাবছেন। কিন্তু আমি একে নির্বাচন বলব না, নাটক বলব। কারণ, দেশে এই মুহূর্তে মুক্ত ও নিরপেক্ষ ভোটের কোনও জায়গাই নেই। সত্যিটা হল, ইন্দিরা জমানা ভারতীয় গণতন্ত্রের উপর এমন এক কালো ছায়া নামিয়ে এনেছিল, যাতে করে চরণ সিংয়ের মতো নেতাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো যথেষ্ট কারণ ছিল। কিন্তু সেই অন্ধকারের ভিতরও আলো হয়ে দেখা দিয়েছিল ইলেকশন কমিশন। নির্বাচনী প্রচারে সেন্সরশিপ, সরকারি দমননীতি, ইন্দিরার দখলদারি এই সবকিছু থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন ১৯৭৭-এর ভোটকে মুক্ত আর নিরপেক্ষ বলে প্রমাণ করতে পেরেছিল। যার ফল হল, জনতা পার্টি ঝড়ের মতো জিতে নিল ২৯৫টি আসন। দেশের মানুষ অন্য চোখে দেখতে শুরু করল নির্বাচন কমিশনকে। তারা পেয়েছে এমন একটি ব্যবস্থাকে, ভয়ঙ্কর চাপের মুখেও যে ব্যবস্থা গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।
কিন্তু মাত্র এক দশক পরেই সেই আস্থা নষ্ট হয়ে গেল। ১৯৮৭ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা ভোট নির্বাচন কমিশনের উজ্জ্বল রেকর্ডে কালি ছিটিয়ে দিল। অভিযোগ উঠল, বুথ দখল, ভয় দেখিয়ে ভোটার তাড়ানো, ব্যাপক কারচুপি আর নির্বাচন কমিশনের চোখ বন্ধ রাখা নিয়ে। ভূস্বর্গে ৮৭-র এই ভোট ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছিল কংগ্রেস-ন্যাশনাল কনফারেন্সকে। কিন্তু অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞই একথা মনে করেন ষে ৮৭-র ভোটের পর থেকেই বহু কাশ্মীরির কাছে ব্যালটের মানে হারিয়ে গেল।
১৯৯০-এ কিন্তু ছবিটা পাল্টাতে শুরু করে আবার। নয়ের দশক ভারতীয় রাজনীতিতে সেই গুরুত্বপূর্ণ সময় যখন জোট রাজনীতি শুরু হল দিল্লিতে। আর নির্বাচন কমিশনও সুযোগ পেল তার স্বাধীনতা ধরে রাখার। কমিশন দেখা দিল গণতন্ত্রের সত্যিকারের রক্ষক হিসেবে। যার মুখ হয়ে উঠলেন টি এন সেশন। ১৯৯১-এ তাঁর তত্ত্বাবধানে নজিরবিহীন কিছু কাজ করেছিল ইলেকশন কমিশন। এই প্রথম কমিশন খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে নাগরিকদের অভিযোগ জানাতে ডাক দিল। প্রমাণ করে দিল, আমলাতন্ত্র নয়, নির্বাচন কমিশন আছে মানুষের পাশেই। গোটা ঘটনাটা সে সময় এমন সাড়া ফেলেছিল যে লোকে বলত, রাজনীতিবিদরা ভয় পায় মাত্র দুজনকে, ভগবান আর টিএন সেশন।
কিন্তু পিছনে ফেলে আসা এক দশক নির্বাচন কমিশনের জন্য কঠিন সময় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরকম কথা উঠতে শুরু করেছে যে, নিরপেক্ষ রেফারি হিসেবে কমিশন তার মর্যাদা হারাচ্ছে। শুধু দেশেই নয়, এই কথা উঠেছে বিদেশেও। মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ফ্রিডম হাউস এক রিপোর্টে বলেছিল, ভারতে ২০১৪ থেকে রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা খারাপ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছিল, ২০১৯ থেকে সেই পতন আরও বেড়ে উঠেছে। আরও আছে। ২০২০ সালে, অশোক লাভাসা, সেই নির্বাচন কমিশনার যিনি ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস দেখিয়েছিলেন, পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। লাভাসা বলেছিলেন, সততার পথ যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠছে। সেই সময় এই অভিযোগ উঠেছিল, মোদি ও অমিত শাহের ভাষণে যখন সাম্প্রদায়িক ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য থাকত, তখন জেলা প্রশাসকেরা সেসব নিয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘনের রিপোর্ট পাঠালেও কমিশন কিন্তু সেসব উড়িয়ে দিত। এই উড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্তই ঘিরে ধরে ছিল অশোক লাভাসাকে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হওয়ার সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন যিনি, তাঁকে শেষ পর্যন্ত নির্বাসন বেছে নিতে হল। ছবিটা পরিষ্কার। নির্বাচন কমিশনে ক্ষমতাবানদের বিরোধী মতামতকে শুধু উপেক্ষাই করা হয় না, দমনও করা হয়।
আর এই ২০২৪ এ নির্বাচন কমিশন আর কোনও গণতন্ত্রের প্রহরী নয়। চোখ, কান সম্ভবত বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার। খেলা চলছে খেলার মতো, রেফারি মাঠের বাইরে। তার ফলে যা হওয়ার ছিল তাই হচ্ছে বিহারে। ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন পর্বে ৬৫ লক্ষ নাম বাদ গেছে খসড়া তালিকা থেকে। এর মধ্যে মৃত ২২ লক্ষ। মজা এই, সেরকমই কয়েকজন মৃত ভোটার সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গিয়েছিলেন।
বোঝা যাচ্ছে, কেন তেজস্বী যাদব দরকারে ভোট বয়কট করতে হবে বলেছিলেন। রাহুল গান্ধী যে ভোট চুরি নিয়ে এমনি এমনি একটানা প্রতিবাদ করছেন না, তাও বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এদিন তো আসারই কথা ছিল। ২০২১ সালে সিটিজেনস কমিশন অন ইলেকশনস এক রিপোর্টে স্পষ্ট বলেছিল যে, নির্বাচন কমিশন তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। ভোটার তালিকা থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাদ পড়া, ইলেকটোরাল বন্ডের গোপনীয়তা, আর নির্বাচনী প্রচারে মুঠোমুঠো টাকার খেলা একথাই বলছে. ভারত কিন্তু নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগোচ্ছে।
হ্যাঁ, নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র। কথাটা মাথায় রাখবেন। মানে উপর উপর একটা গণতন্ত্রের নাটক চলছে। একটা আইওয়াশ। দেখানো হচ্ছে এই তো সবাই দিব্বি ভোট দিচ্ছে, স্বাধীন মতপ্রকাশ করছে। কিন্তু আসল কথাটা এই, ইভিএমে চাপ দেওয়া প্রতিটি আঙুলই নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে স্বৈরাচারী। মহারাষ্ট্রের পালঘরের সুষমা গুপ্তা, তাঁর লিস্টে নাম উঠেছে ছ’বার, প্রত্যেকবার আলাদা আলাদা ইপিআইসি আইডি নিয়ে। আর এর পাশাপাশি নিঃশব্দে মুছে দেওয়া হয়েছে হাজার হাজার নাম। টার্গেট করা হচ্ছে সংখ্যলঘুদের।
এরপর আর একটাই কথা বাকি থাকে। নির্বাচনী গণতন্ত্র যদি ধ্বংস হয়ে যায় তবে ভারতের ভবিষ্যত কী? গণতন্ত্রের জননী বলা হয় যাকে, সেই ভারত কি শেষমেশ এরকম একটা দেশ হয়ে যাবে, যেখানে ভোটের ঘোমটার আড়ালে খ্যামটা নাচবে স্বৈরাচারী? না, পুরো আশা এখনও শেষ হয়নি। ভারতে এখনও বিরোধীরা আছেন, আছেন জেগে থাকা মানুষেরা, আছে সংবিধান। দুঃসময় নামছে আমরা জানি। নামুক। ভোরের আলো ফোটার আগেই তো অন্ধকার সব থেকে ঘন হয়।







