একটা পুরানো খবর দিয়ে শুরু করা যাক। খবরটা হল এই, বাংলায় বিজেপি কিন্তু তার সংগঠনকে সাজিয়ে নিতে চেয়েছিল। পঞ্চায়েত ভোটের আগে দলীয় সংগঠনের কোথায় কী অবস্থা, তা জানতে এক সার্কুলার জারি করা হয়েছিল বঙ্গ বিজেপির তরফে। এই সার্কুলার পাঠানো হয় সব জেলা সভাপতিকে। মূলত সংগঠনের হাল হকিকত জানতেই এই সার্কুলার। কেন্দ্রীয় সংগঠনের নির্দেশেই এই সার্কুলার পাঠানো হয়, যেখানে বলা হয়েছিল, দলের চাহিদামতো সব তথ্য না দিতে পারলে সেই জেলাকে দুর্বল সংগঠন হিসাবে ধরা হবে। তারপর কেটে গিয়েছে বেশ কিছুদিন। ২৬-এর বিধানসভা নির্বাচন কড়া নাড়ছে বাংলার দোরগোড়ায়। কিন্তু বিজেপির সাংগঠনিক দুর্বলতা কি কেটেছে?
একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখবেন, ‘শুভ-শুকু-শমী’, অর্থাৎ শুভেন্দু, সুকান্ত, শমীক, বিজেপির এই ‘ত্রিদেব’, এর আগে যত নাচানাচি করছিলেন, এখন কিন্তু ততটা করছেন না। সত্যিটা হল – ভোট যত আসছে, নাচ তত কমছে। তাইতো হওয়ার কথা! বঙ্গ বিজেপির একটা বড় আশা ছিল এসআইআর। এসআইআর-এর খেলা ব্যুমেরাং-এর ঠেলা হয়ে আছড়ে পড়েছে বঙ্গ বিজেপির রাজনীতিতে। এসআইআর লাগু হওয়ার সময় থেকে যেভাবে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে চলেছে, যে মৃত্যু মিছিল থেকে সাধারণ মানুষ বা বিএলও বাদ পড়ছেন না কেউই, তাকে কিভাবে সামলানো যাবে বঙ্গ বিজেপি বুঝতে পারছে না। যে কারণে বিজেপির রাজ্য সভাপতি বেফালতু জ্ঞানেশ কুমারকে চাট্টি বাজে কথা বলে দিলেন। জ্ঞানেশ কুমারকে নাকি দিল্লির ঠান্ডা ঘর ছেড়ে বাংলায় জিরো গ্রাউন্ডে নেমে এখানকার অবস্থা দেখতে হবে। যারা একটু আধটুও রাজনীতি বোঝেন, তাদের মনে হতেই পারে এ যেন ছোট ছেলের আবদার। কেন না শমীক বললেই তো আর জ্ঞানেশকুমার বাংলায় আসছেন না। কেনই বা আসবেন? বঙ্গ বিজেপির নেতাদের কাজ নাই থাকতে পারে, কিন্তু জ্ঞানেশ কুমারের তো আছে।
কিন্তু বঙ্গ বিজেপির নেতাদের কাজ নেই কেন? তার কারণ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির কোনও সংগঠনই নেই। না, দু’চারটে পতাকা লাগানোর লোকের কথা বলছি না। বলতে চাইছি বুথ স্তরের সংগঠনের কথা, যে সংগঠন ছাড়া আর যাই হোক ভোটে জেতা যায় না। বিজেপি দাবি করে তারা নাকি রেজিমেন্টেড পার্টি, ক্যাডার ভিত্তিক পার্টি। তাদের ক্যাডাররা বিজেপির জন্য জান লড়িয়ে দিতে পারে। অন্য রাজ্যের কথা বলব না, কিন্তু বাংলায় কি বিজেপির এরকম ক্যাডার আছে, যারা বিজেপির জন্য লড়বে এবং দরকারে মরবে?
সিপিএমের দিকে দেখুন। কিছুই নেই। পশ্চিমবঙ্গের শূন্য থেকে মহাশূন্যে পৌঁছতে চলেছে এক সময়কার দাপুটে সিপিএম। কিন্তু এত নেইয়ের ভিতরেও যেটা আছে তা হল, দলের প্রতি আনুগত্য। খুব কম সংখ্যক ক্যাডার, কিন্তু দরকারে তারা সিপিএমের জন্য জান লড়িয়ে দেবে।
দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, পশ্চিমবাংলায় বিজেপির কিন্তু এরকম কোন ক্যাডার বাহিনী নেই। রামনবমীর মিছিলে অস্ত্র হাতে লাফালাফি করা এক, আর ভোট করা আরেক কথা। বিজেপির নেতারাও কিন্তু একথা জানেন। তাই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সার্কুলার পাঠিয়ে যখন এখানকার সংগঠনের অবস্থা জানতে চায়, তখন বিজেপির নেতারা কিন্তু তাঁদের মিথ্যে বলেছিলেন। মনে করুন বঙ্গ বিজেপির নেতাদের সেই ঐতিহাসিক উক্তি – বুথে বুথে সৈন্য প্রস্তুত। কিন্তু কি হল? মহাদেবের জটা ধরে টান মারতেই বেরিয়ে পড়ল ঠকবাজ ক্যাবলা। দেখা গেল সৈন্যরা জানেই না, তাঁরা সৈন্য। দু’এক জায়গায় তো তৃণমূলের লোকেদেরও বিজেপির সৈন্য বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুন: Aajke | লক্ষ্মীর ভাণ্ডার vs অন্নপূর্ণা ভাণ্ডার, পদ্ম পাতায় জল?
এই অবস্থাটা খুব পাল্টেছে কি? একেবারেই না। উল্টে মতুয়াদের সমস্যা এসে গোটা বিষয়টাকে আরো জট পাকিয়েছে। বিজেপি নেতাদেরও দোষ কম নয়। সিএএ শিবির খুলেছিলেন, যেখানে টাকা নিয়ে নাগরিকত্ব পাইয়ে দেওয়ার কথা হয়েছিল। তারপর গোলমাল, বিরোধীদের চিৎকার এবং বিজেপিকে কী করতে হল? বড় বড় করে নোটিসে লিখে দিতে হল যে, টাকা লাগবে না। ভাবুন একবার, টাকা লাগবে না লিখে না দিলে কেউ বিশ্বাস করবে না। এইতো হল বঙ্গ বিজেপির অবস্থা। মাঝখান থেকে বিজেপি যাকে নিজের ভোটব্যাঙ্ক বলত, সেই মতুয়ারা আগেও মমতার সঙ্গে ছিল, আর এখন আরও বেশি করে মমতার দিকে ঝুঁকছেন। কেন না তাঁরা বুঝে গিয়েছেন, পাশে থাকলে ওই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই থাকবেন।
বঙ্গ বিজেপির নেতারা তবে কী করছেন? শুভেন্দু দু’চারটে সভা করছেন, সেখানে অন্য কোনও বিষয়ের থেকে বাংলাদেশে কারা পালাচ্ছে, সেই নিয়েই তাঁর উৎসাহ বেশি। কংস যেমন শ্রীকৃষ্ণের ভয়ে দিনরাত কৃষ্ণ কৃষ্ণ করত, ঠিক সেভাবেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে শত্রু রূপে ভজনা করছেন সুকান্ত মজুমদার। আর রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য আবার বাড়িতে ঢুকে গিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা পড়তে শুরু করেছেন। কত চেষ্টা করলেন, এমনকি দিল্লিও চলে গেলেন, তবু কিছুতেই পশ্চিমবঙ্গে এখনও রাজ্য কমিটি ঘোষণা হল না।
কিন্তু ২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনকে ঘিরে ইতিমধ্যেই রাস্তায় নেমেছে সিপিএম। এসআইআর সহযোগিতা দিয়ে তারা পৌঁছতে চাইছেন মানুষের কাছে। আর অন্যদিকে একের পর এক ময়দান দখল করছে তৃণমূল। ভিড় উপচে পড়ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভায়। দক্ষিণবঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গ ছুটে ফিরছেন মমতা।
বোঝাই যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। কিন্তু এছাড়াও অন্য গন্ডগোলেও পড়েছে তারা। খুলে বললে শুভেন্দু অধিকারী ও নব্য বিজেপিরা, যাদেরকে তৎকাল বিজেপিও বলা হচ্ছে, সেইসব নব্য বিজেপিরা এমন একটা হাবভাব করছিলেন, যাতে মনে হচ্ছিল বিজেপি পার্টির প্রতিষ্ঠা তাঁরাই করেছেন। আরে এসব ভাবলে হবে? পশ্চিমবঙ্গের যার হাত ধরে বিজেপি মাটি পেয়েছে, পরিচিতি পেয়েছে তিনি সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলায় বিজেপিকে মমতাই রেখেছেন, আর মমতাই মারবেন।
এখন শুভেন্দু অধিকারীর এসব লাফালাফির ফলে কি হল? রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে, বঙ্গ বিজেপিতে ‘তৎকাল’ নেতাদের বাড়বাড়ন্তে কি বিরক্ত আরএসএস? বিজেপির রাশ যেভাবে নব্য নেতাদের হাতে চলে যাচ্ছে, এবং পুরানো কর্মীদের উপেক্ষা করার যে অভিযোগ উঠছে, তাতে কিন্তু সংঘের ক্ষুব্ধ হওয়ার ইঙ্গিত মিলেছে। আরএসএস-এর ইংরাজি মুখপাত্র ‘অর্গানাইজার’-এর এক নিবন্ধে নাম না করে শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদারদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, বঙ্গ বিজেপির আজকের যে সাংগঠনিক শক্তি সেটার কৃতিত্ব কিন্তু কখনওই শুধু নব্য বিজেপি নেতাদের নয়। এর ভিত স্থাপন হয়েছে সেই জনসংঘের আমলে এবং আরএসএস-এর হাত ধরেই।
ক্যাডার ভিত্তিক পার্টি, চাঙ্গা সংগঠন, এসব কথা শুনতে ভালো, কিন্তু বিনা দামে পাওয়া যায় না। আর বঙ্গ বিজেপি যেভাবে ঘরে বাইরে কেন্দ্রে রাজ্যে গোলমালে জড়িয়ে পড়ছে, তাতে এই প্রশ্ন উঠতেই পারে, এত কোন্দল করে কি ভোটে জেতা যায়? আসুক দেখে নিই মানুষ কি বলছেন?
২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে বাংলায় যে বিজেপি জিতবে না, একথা বিজেপিই সবার চেয়ে ভালো করে জানে। বঙ্গ বিজেপির নেতাদের দেখলেই সে কথা বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। নিজেদের কোনো কারিশমা নেই। তাঁরা তাকিয়ে আছেন কবে মোদিজি পশ্চিমবঙ্গে এসে সভা করবেন। সব কাজ ফেলে প্রধানমন্ত্রীকে যদি নিজে এসে ভোটে জেতাতে হয়, সুকান্ত, শুভেন্দু, শমীক তাহলে এতদিন কী করলেন?
দেখুন ভিডিও:







