গুহায় বা বলে থাকা মানুষ বাজ পড়লে ভয় পেয়েছে, আগুন কে এক গুপ্তধন মনে করেছে। কিন্তু সমাজ তো সেখানে থেমে থাকেনি। সমাজ এগিয়েছে, তার বিশ্বাস বদলেছে। সে জেনেছে বাজ কেন পড়ে, সে শিখেছে আগুন ধরাতে, তার ব্যবহার শিখেছে। সে শিখেছে আর তার সঙ্গে সঙ্গেই তার বিশ্বাস কে বদলে ফেলেছে। জ্ঞান বিজ্ঞান এর উন্মেষ তার বিশ্বাসকে রোজ বদলে দেবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই দক্ষিণ এশিয়ার ভূভাগ জুড়ে বা বলা ভাল পৃথিবী জুড়েই এক মধ্যযুগ এসে হাজির হল, যখন এক উলটোরথ চলা শুরু হল। ধরুন ইউরোপে জোয়ান অফ আর্ক, কেবল তার নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাসের কথা বলার পরে চার্চ পাদরিরা মিলে তাঁকে সেই ১৪৩১ সালে জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরে ফেললো। কিন্তু তার পরে? ইউরোপের নবজাগরণ, তারপর থেকে একটাও তেমন ঘটনা ঘটেছে? না, সাড়ে ছ শো বছর পার করে গেছে, মানুষের জ্ঞান বিজ্ঞান, তথ্য সবকিছু এসে তার বিশ্বাসকে বদলে দিয়েছে, সেই মধ্যযুগের ধারনা কে নিয়ে সেখানে কেউ বাঁচেনা। আমাদের দেশে ১৯৮৭ সালে রূপ কানওয়ার সতী হয়েছেন, জ্যান্ত পুড়ে মরেছেন, মানুষ দাঁড়িয়ে তা দেখেছেন, আজও রূপ কানওয়ারের মূর্তি আছে, মন্দির আছে, রাজস্থান বেড়াতে গেলে জয়সালমীরে গড়িসাগর লেকের ধারে সন্ধ্যেতে যে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড প্রোগ্রাম হয়, সেখানে এখনও সেই সতীর নামগান করা হয়। হ্যাঁ ভারতের নবজাগরণ ঘটেছিল এই বাংলা থেকে, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে সেই নবজাগরণ এই বাংলাতেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। উত্তর ভারতের মনুবাদী সংগঠন আর এস এস বা রাজনৈতিক দল বিজেপি এই নবজাগরণের প্রতিটা বিষয়ের বিরোধী। সেই সময়ের নবজাগরণের প্রধান হোতা রামমোহন রায় কে পাষন্ড, ম্লেচ্ছ, কাপটিক, বক ধূর্ত বলেছিল এই বাংলার উচ্চবর্ণ আর ধনী সমাজের রাধাকান্ত দেব, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা রামকমল সেনের দল। বিদ্যাসাগরকে মূর্খ পন্ডিত, ম্লেচ্ছদের চাকর বলেছিল এই উচ্চ বর্ণের দল। কিন্তু নবজাগরণ এসেছিল বাংলার সমাজে আজও সেই নবজাগরণের হোতাদের একজনকেও সহ্য করতে পারেনা আর এস এস – বিজেপি। সেটাই বিষয় আজকে, রবীন্দ্রনাথ, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ বিরোধী বিজেপি বাংলাতে অচল পয়সার থেকেও খারাপ।
আরও পড়ুন: Aajke | ঠিক যে কারণে নীতীশ জিতলেন, সেই কারণেই আগামী নির্বাচনে বাংলাতে মমতা জিতবেন
কেবল রামমোহনকে ইংরেজের দালাল বলাই নয়, মানে এই বলাতা এক বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনাই নয়। খেয়াল করে দেখুন মাত্র কদিন আগেই আর এস এস সরসংঘচালক মোহন ভাগবৎ বলেছেন নিরামিষ খাওয়াকে আত্মস্থ করতে হবে, মানুষের কাছে নিরামিষ খাবারের প্রচার বারাতে হবে। কতটা অবৈজ্ঞানিক এই কথা? যেদেশে শিশুরা এখনও ম্যাল নিট্রিশনে ভোগে, তাদের স্কুলে ডিম বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এই মূর্খের দল এমনকি বিবেকানন্দ যে কথা বলেছেন সেটাও জানে না। তিনি স্পষ্ট বলেছিলেন যে নিরামিষাশী হওয়ার জন্য দরিদ্র ও দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করা মানুষের ওপর জোর করা তাদের ক্ষতির কারণ। তাঁর মতে, যারা দুর্বল, তাদের শক্তিশালী হতে মাংস খাওয়া দরকার। তিনি বলেছেন, “এখন তোমাদের রাজসিক গুণই দরকার! সুতরাং, আমি বলি, তোমরা প্রচুর পরিমাণে মাছ-মাংস খাও।” তিনি বলতেন সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শক্তিশালী শরীর প্রয়োজন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে বর্তমানে যে রাজসিক সক্রিয় য়ার উদ্যমী জীবনযাপন করতে হয়, তার জন্য আমিষ আহার প্রয়োজন। আপনাদের সব্বার নিশ্চই মনে আছে এই কলকাতাতেই এই বিজেপি ল্যুম্পেনের দল বিদ্যাসগরের মূর্তি ভেঙেছিলেন অমিত শাহের মিছিলের দিনে। হ্যাঁ শিক্ষাকে এক সর্বজনীন করে তোলার কাজ সেদিন ব্রাহ্মণদের খারাপ লেগেছিল, হিন্দু ধর্মের বিধবা বিবাহ প্রথার বিরোধিতা খারাপ লেগেছিল, আজ বিজেপি তার মুর্তি ভাঙবে এতা স্বাভাবিক। কদিন আগেই এই বাংলার এক ক্ষুরবাজ বিজেপি নেতা আমার সোনার বাংলা গাইলে বাংলাদেশে পাঠানোর নিদান দিয়েছিলেন, হিমন্ত বিশ্ব শর্মা অসমের মুখ্যমন্ত্রী আমার সোনার বাংলা গাইলে দেশদ্রোহীতার অভিযোগে ইউএপিএ ধারায় গ্রেফতার জেলে পোরার আদেশ দিয়েছিলেন। এরা রবীন্দ্রনাথের বন্দেমাতরম নিয়ে সুচিন্তিত মতামত কে চ্যালেঞ্জ করার ধৃষ্টতাও রাখে। এবং শেষ ঘটনা এঁদের এক মন্ত্রী মশাই বলেছেন রামমোহন রায় নাকি ইংরেজদের দালাল ছিল। আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে জিজ্ঞেষ করেছিলাম, আজ এটা পরিস্কার যে বাংলা নবজাগরণের প্রধান পুরুষ রামমোহন রায়, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ বা রবিঠাকুর, কাউকেই বিজেপি সহ্য করতে পারেনা, পারেনা কারণ এই নবজাগরণের মহাপুরুষেরা বাঙালি ছিলেন আর তাঁরা মানবতার কথা বলেছিলেন। এ নিয়ে আপনাদের মতামত কী? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
আসলে কোথায় লেগেছে ভাই? আসুন একটু বুঝে নিই। “তুহফাত-উল-মুওয়াহ্হিদীন” মানে হল একেশ্বরবাদীদের জন্য একটি উপহার, এটা হলো রাজা রামমোহন রায়ের লেখা একটা ফার্সি বই, তাতে লিখে গিয়েছেন, “জগতে চার শ্রেণির মানুষ আছে-(ক) প্রতারক, (খ) প্রতারিত, (গ) প্রতারক ও প্রতারিত, (ঘ) প্রতারক নয়, প্রতারিতও নয়। প্রথম দল নিজেদের ইচ্ছেমতো ধর্মীয় তত্ত্ব ও মত উদ্ভাবন করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা ও বিরোধ সৃষ্টি করে। দ্বিতীয় দল কোনওরকম বুদ্ধি বিবেচনা ছাড়াই প্রথম দলের অনুগামী হয়। তৃতীয় দল অপরের কথায় বিশ্বাস করে এবং সেই বিশ্বাসে বাকি সবাই বিশ্বাসী হোক, এমনটা চায়। আর চতুর্থ দল প্রতারক নয়, প্রতারিতও নয়। এরা হল মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। আর এস এস – বিজেপি হল সেই প্রথম দলের প্রতারক, তারা যে কোনও মুক্তবুদ্ধির বিরুদ্ধে লড়বে এটাই তো স্বাভাবিক, তাই তাদের কাছে রামমোহন রায় ব্রিটিশদের দালালই তো হবে। তারা তো চায় দেশ আর সমাজকে এক মধ্যযুগে টেনে নিয়ে যেতে। আসলে নবজাগরণের আলো এই সরীসৃপ দের বেঁচে থাকার পক্ষে অনুকূল নয়, নয় বলেই তারা নবজাগরণের প্রত্যেকটা বিশ্বাস, প্রত্যেক মহাপুরুষদের বিরোধিতা করে। সেই তালিকাতে বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগর, রামমোহন, রবিঠাকুরও আছেন।







