মানুষ আসলে কী নিয়ে বাঁচে? এর কোন চটজলদি উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। বধূ শুয়ে ছিল পাশে, শিশুটিও ছিল। তারপরেও পূর্ণিমা রাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন বুদ্ধদেব। কীসের সন্ধানে?
মানুষ মুখে যতই যুক্তির কথা বলুক না কেন, যতই দেখাক সে বাস্তবের মাটিতে দু’পা গেঁথে দাঁড়িয়ে আছে – আসলে কিন্তু তাঁর ২৪ ঘন্টার বেশিরভাগটাই কেটে যায় স্বপ্নের ভিতর। কখনো ঘুমিয়ে, কখনো বা জেগে, মানুষ স্বপ্ন দেখে চলে। জীবনান্দ দাশের কবিতা মনে করুন, ‘মরণের হাত ধরে স্বপ্ন ছাড়া কে বাঁচিতে পারে?’
এই যে স্বপ্ন, এর আরেক নামই হল কনসেপ্ট। যেমন ধরুন ‘এল ডোরাডো’। ‘এল ডোরাডো’ হল সেই উপকথার শহর, যার পুরোটাই সোনা দিয়ে বানানো। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, সবকিছু। উপকথার এই গল্পকে কিন্তু একটা সময় পর্যন্ত বহু মানুষ সত্যি বলেই মেনেছিল। ১৫৩০ থেকে ১৬৫০ সালের মধ্যে হাজার হাজার ইউরোপীয় অভিযাত্রী ‘এল ডোরাডো’র সন্ধানে দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গল, পর্বত এবং নদীগুলোতে অনুসন্ধান চালিয়েছিল। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিপুল সম্পদ অর্জন এবং নতুন বিশ্ব জয় করা। এই অনুসন্ধানের কারণে অনেক অভিযাত্রী তাঁদের জীবন হারিয়েছিল, যদিও তাঁদের মূল লক্ষ্য, সোনার শহর খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু এই অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে মাচুপিচু-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান আবিষ্কৃত হয়েছিল। সোনার শহরের স্বপ্ন দেখেছিল বলেই তো মাচুপিচু আবিষ্কার হল।
এখন কথা হল, মানুষ যে স্বপ্ন দেখে, একথা যেমন কবিরা জানেন, শিল্পীরা জানেন, তেমনি পলিটিশিয়ানরাও কিন্তু জানেন। হাতের কাছেই উদাহরণ নরেন্দ্র মোদি। মানুষের স্বপ্নের পালে হাওয়া লাগিয়েই তো মোদিজির বাড়বাড়ন্ত। আর সেই স্বপ্নের নাম ‘রামরাজত্ব’।
মোদিজির ‘রামরাজত্ব’ ঠিক কীরকম, সে নিয়ে একটু পরে কথা বলছি। তার আগে আসুন দেখে নিই, রাম রাজত্ব সম্পর্কে মহাত্মা গান্ধী ঠিক কী বলেছিলেন। গান্ধীজি বলেছিলেন, ‘BY RAMARAJYA, I do not mean Hindu Raj. I mean by Ramarajya Divine Raj, the Kingdom of God. For me Rama and Rahim are one and the same deity. I acknowledge no other God but the one God of truth and righteousness.’ সোজা বাংলায়, ‘রামরাজত্ব মানে আমি হিন্দুরাজ বোঝাতে চাইছি না। আমার কাছে রাম রাজত্ব মানে ঈশ্বরের রাজত্ব। রাম ও রহিম আমার কাছে একই’। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘রামায়ণে হিংসার থেকে ক্ষমা এবং গ্রহণের থেকে ত্যাগই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে’।
এখন বিষয় হল, এসব ভালো ভালো কথা নরেন্দ্র মোদিও দু’চারটে জানেন। ‘রামরাজত্ব’ নিয়ে ভাষণে তিনি তো বলেইছেন, ‘স কিন্তু অনেকটা এরকমই ত্যমেব জয়তে’। সত্যেরই জয় হয়, মিথ্যার জয় কখনও হয় না। আর এই সত্যের রাজত্বের নামই ‘রামরাজত্ব’।
এখন কথা হল বাংলায় ‘রামরাজত্ব’ শব্দটার একটা অন্য ব্যবহারও আছে। পুরো গোলমেলে অবস্থা, সেই অবস্থাটা বোঝাতে আমরা ‘রামরাজত্ব’ কথাটা ব্যবহার করে থাকি। আমরা বলি, এ কী অরাজকতা! এ যেন রাম রাজত্ব চলছে!
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদিজির সেই কালো-টাকা? জানা গেল, সেটাও এক বিশাল মিথ্যে
শ্রী নরেন্দ্র মোদির ‘রামরাজত্ব’ও কিন্তু অনেকটা এরকমই। রাম রাজত্বের জায়গায় ভারতে এখন চলছে কর্পোরেট রাজ। ‘এল ডোরাডো’ বা সোনার শহরের অনুসন্ধানকারীরা খুঁজে বার করেছিলেন প্রাচীন শহর মাচু পিচুকে। আর মোদিজি রাম রাজত্ব খুঁজতে গিয়ে, খুঁজে পেয়েছেন আদানি আর আম্বানিকে।
আসব সে কথায়। তার আগে একটা চেনা তথ্য আবার বলা যাক। আমাদের দেশে কর্পোরেটরা লোন নিয়ে টাকা শোধ দেন না, এ তো জানা কথা। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট বলছে, এয়ারসেল কোম্পানির ফাউন্ডার, সি শিবশঙ্করণ রতন টাটার ভিলা বাড়ি কিনতে আগ্রহী, যার দাম ৫৫ কোটি টাকা। মজা হচ্ছে এই শিবসংকরণ কিছুদিন আগেই নিজেকে দেউলিয়া বলে ঘোষণা করেছেন। ৫৫ কোটি টাকা দিয়ে ভিলা কিনছেন একজন দেউলিয়া! এ বোধ হয় ভারতেই সম্ভব। সত্য সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ!
আদানির ব্যাপারটাও দেখুন। এর আগে যখন আমেরিকাতে আদানির বিরুদ্ধে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছিল, যখন আদানির আমেরিকায় লোন পেতে অসুবিধা হচ্ছিল, তখন থেকেই কিন্তু আদানির সঙ্গে এলআইসি-কে জুড়ে দেওয়া হল। আমেরিকার ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ কিছুদিন আগেই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যাতে বলা হয়েছে, আদানি গোষ্ঠীতে টাকা ঢালার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে LIC-কে। সেই মতো চলতি বছরের মে মাসে সরকারি আধিকারিকরা পরিকল্পনাও পেশ করেন। সব মিলিয়ে আদানি গোষ্ঠীতে ৩৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
এসব তো নতুন কিছু নয়! আদানি বা আম্বানির ব্যাপারে এলআইসি বরাবরই দিলদরাজ। বাজাজ ফিনান্স বা করোম্যান্ডেলের মত কোম্পানিগুলোকে কেন তারা পাত্তাই দিতে চায় না, এ নিয়েও তো প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু এবারের প্রশ্ন একটু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। LIC কি আদানি ও রিলায়েন্সকে আলাদা সুবিধা দিচ্ছে? মিন্ট–এর তদন্তে এই নিয়ে তোলা হল বেশ ভারী সব প্রশ্ন। আসুন, ব্যাপারটা একটু দেখে নেওয়া যাক।
ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত বীমা সংস্থা লাইফ ইনশিওরেন্স কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া (LIC) গত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ (RIL) ও আদানি গ্রুপ–এর শেয়ারহোল্ডার বৈঠকে আনা একাধিক প্রস্তাবে নিরন্তর সমর্থন দিয়ে এসেছে এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল কখনওই বিরোধিতা করেনি। এই তথ্য উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যম Mint–এর এক টানা তদন্তে, যেখানে ১ এপ্রিল ২০২২ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রায় ৯,০০০ ভোটিংয়ে এই নিয়ে সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করা হয়েছে। তদন্তে দেখা গিয়েছে, একই ধরনের প্রস্তাব আনা অন্য বহু বড় কোম্পানিতে LIC প্রত্যাখ্যান করেছে বা অবস্থান বদলেছে, কিন্তু রিলায়েন্স বা আদানি গ্রুপে তা করেনি। এতে LIC–এর ভোটিং নীতির সামঞ্জস্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এবার পরিসংখ্যানে একটু চোখ বোলানো যাক – মোট প্রায় ৯,০০০ ভোটিং সিদ্ধান্তের মধ্যে ৯২ শতাংশ ক্ষেত্রে LIC সমর্থন দিয়েছে, ৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ভোট দেয়নি, ২ শতাংশ ক্ষেত্রে বিরোধিতা করেছে। আদানি গ্রুপের ক্ষেত্রে ৩৬৮ প্রস্তাবের মধ্যে ৩৫১টি প্রস্তাব LIC সমর্থন করেছে। বাকি সমস্ত ক্ষেত্রে অ্যাবস্টেইন। আদানিদের আনা একটি প্রস্তাবেও বিরোধিতা নেই। একই ঘটনা ঘটেছে রিলায়েন্স ও জিও ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের ক্ষেত্রে। রিলায়েন্সের আনা ৬৩টি প্রস্তাবেই LIC–র পূর্ণ সমর্থন। কিন্তু অন্য কোম্পানির, যেমন টিভিএস মোটর, এদের আনা একই ধরনের প্রস্তাবে LIC না বলেছে বা অ্যাবস্টেইন করেছে অর্থাৎ ভোট দেয়নি।
Mint–এর উদ্ধৃত কর্পোরেট গভর্ন্যান্স বিশেষজ্ঞদের মতে, LIC দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠিত বিনিয়োগকারী। তাই তার ভোটিং প্যাটার্ন স্বচ্ছ, একই মানদণ্ডভিত্তিক এবং সব কোম্পানির ক্ষেত্রেই সমান হওয়া উচিত। রিলায়েন্স বা আদানির কাছে এক রকম মানদণ্ড এবং অন্য কোম্পানির কাছে অন্য রকম মানদণ্ড তৈরি হলে বড় ঝুঁকি তৈরি হয়। এত বিশাল সম্পদ পরিচালনাকারী একটি প্রতিষ্ঠানের অনিয়মিত বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ ভোটিং পুরো বাজারেই প্রশ্ন তোলে। এর সঙ্গে আপনাদের এও জানিয়ে রাখি, আইএমএফ কিন্তু ভারতের জিডিপি ‘সি’ পজিশনে আছে বলে মন্তব্য করেছে। ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’ – এই তিনটে গ্রেডের ভেতর ভারত আছে একেবারে শেষে।
এই হল শ্রী নরেন্দ্র মোদির ‘রামরাজত্ব’, যেখানে সাধারণ মানুষের টাকা খাটানো সরকারি সংস্থা, যাবতীয় সম্পদ তুলে দেয় কর্পোরেটদের হাতে। এই নিয়ে কোনও অভাব অভিযোগেই মোদিজি কান দেন না। কেনই বা দেবেন? রাম রাজত্বে কারও আবার নালিশ থাকে নাকি? আছে মোদিজি, আছে। সাধারণ মানুষের নালিশ জমতে জমতে পাহাড় হয়েছে। এই পাহাড় কিন্তু আপনাদের মাথার উপর যে কোনদিন ভেঙে পড়তে পারে।
দেখুন ভিডিও:







