‘মূর্খদের অশেষ দুঃখ,’ আমার ঠাকুমা বলতেন। কারণ মূর্খরা ভুল একবার করে না, করতেই থাকে, করতেই থাকে। উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ ফরমান দিয়েছেন, ‘বন্দেমাতরম’ স্কুলের প্রার্থনা সভাতে গাইতেই হবে। হ্যাঁ, এই দল আজও সাত সকালে উঠে সেই ১৯২৫ সাল থেকে ‘নমস্তে সদা বৎসলে’ গেয়ে এসছে। অন্তত ১৯৮০-তে বিজেপির প্রতিষ্ঠা দিবসেও খোঁজ নিয়ে দেখলাম ‘বন্দেমাতরম’ গাওয়া হয়নি, ‘জন গণ মন অধিনায়ক জয় হে’ জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়েছে। কিন্তু আজ ওনারা হঠাৎ ‘বন্দেমাতরম’ প্রেমী হয়ে উঠেছেন। এত প্রবল তাঁদের প্রেম যে, কেন কংগ্রেস ‘বন্দেমাতরম’ গানকে টুকরো করে দিল? কেন কেবল প্রথম দু’স্তবকই গাওয়া হচ্ছে? এসব প্রশ্ন নিয়ে আবার তাঁরা নেহেরুকে আক্রমণ করা শুরু করেছেন। এটাও সেই মূর্খামি। সমস্যা হল জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে যাঁদের ভূমিকা ছিল বিশ্বাসঘাতকের, তাঁরা আজ হঠাৎ এক দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে দু’বেলা ছড়াচ্ছেন।
আসল ইতিহাসটা ক’দিন আগেই এই কলকাতা টিভি চ্যানেলের চতুর্থ স্তম্ভ অনুষ্ঠানে বলেছি। আবার বলি, এই ‘বন্দেমাতরম’ গানের প্রথম সাত লাইন পর থেকে মূর্তিপুজোর প্রেক্ষিত নিয়ে সেমাটিক ধর্মের লোকজনদের স্বাভাবিক আপত্তি ছিল। সেই বিতর্ক কংগ্রেসেও ছিল। যদিও কংগ্রেসের মঞ্চে এই গান প্রথম গেয়েছিলেন রবি ঠাকুর নিজে, কলকাতা অধিবেশনে, ১৮৯৬-এ। বিতর্কের অবসানের জন্য নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু শেষ মতামত নেওয়ার জন্য রবি ঠাকুরের কাছে যান, আর তখন রবি ঠাকুরই গানটার প্রথম সাত লাইন বা দুটো স্তবক রাখার কথা বলেন। তখন থেকেই সেটাই রাখা হয়। কংগ্রেসের প্রায় প্রতি অধিবেশনে ঐ গান গাওয়া হত, আজও হয় আর কংগ্রেসীরা তাঁদের বক্তৃতা শেষ করেন ‘বন্দেমাতরম’ বলেন, সেই কবে থেকে আজও। কিন্তু নিজেদের ‘নমস্তে সদা বৎসলে’ চালানোর চেষ্টা করে হাঁফিয়ে যাওয়া আরএসএস, বিজেপি এখন ‘বন্দেমাতরম’কে নিজেদের বলে দাবী করা শুরু করেছেন। আর তাই ফরমান জারি হয়েছে উত্তরপ্রদেশের স্কুলের প্রার্থনাতে ‘বন্দেমাতরম’ গাওয়া বাধ্যতামূলক। সেটাই বিষয় আজকে, দেশের দুই রাজ্যে বাংলা গান স্কুলে গাওয়ার ফরমান।
আরও পড়ুন: Aajke | সাংবাদিক যদি নাগরিকত্বের প্রমাণ দেখতে চায়, গাছে বেঁধে রাখুন, পুলিশে খবর দিন
কেন বলছি এই ফরমান মুর্খামি? কারণ আমি নিশ্চিত ঐ যোগী আদিত্যনাথ নিজে ‘বন্দেমাতরম’ পুরোটা পড়েননি, জানেন না। উনি বলেছেন, ঐ ‘বন্দেমাতরম’ গানটা দু’টুকরো করার পর থেকেই নাকি দেশ বিভাজনের সূত্রপাত হয়েছে। তার মানে উনি ওনার রাজ্যে গানটা পুরোটাই চালু করবেন। সমস্যা হল, গানের বাকি অংশের বেশিটাই তো বাংলাতে। হ্যাঁ, ‘বন্দেমাতরম’ গানের পুরোটা অনেকেই পড়েননি একবার শুনে নিন।
বন্দে মাতরম্
সুজলাং সুফলাং
মলয়জশীতলাম্
শস্যশ্যামলাং
মাতরম্!
শুভ্র-জ্যোত্স্না-পুলকিত-যামিনীম্
ফুল্লকুসুমিত-দ্রুমদলশোভিনীম্
সুহাসিনীং সুমধুরভাষিণীম্
সুখদাং বরদাং মাতরম্৷৷
সপ্তকোটীকন্ঠ-কল-কল-নিনাদকরালে
দ্বিসপ্তকোটীভুজৈধৃতখরকরবালে
অবলা কেন মা এত বলে!
বহুবলধারিণীং
নমামি তরিণীং
রিপুদলবারিণীং
মাতরম্৷
তুমি বিদ্যা তুমি ধর্ম্ম
তুমি হৃদি তুমি মর্ম্ম
ত্বং হি প্রাণাঃ শরীরে৷
বাহুতে তুমি মা শক্তি
হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি
তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে৷
এই কদিন আগে এই মূর্খ বাহিনীর একজন হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেছিলেন বাংলাতে কথা বললে বোঝা যায় যে সে বাংলাদেশি, এবারে ইউপি-র স্কুলে স্কুলে গাওয়া হবে – ‘তুমি বিদ্যা তুমি ধর্ম, তুমি হৃদি তুমি কর্ম, তোমারি প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে’, স্পষ্ট সুন্দর বাংলাতে। আপত্তি কি থাকবে না? থাকবে বৈকি? যাঁরা পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করেন না, তাঁদের এই গান বাধ্যতামূলকভাবে গাইবার ফরমান বিতর্ক তো তৈরি করবেই। কিন্তু সেসবের পরেও গুচ্ছ গুচ্ছ হিন্দিভাষী বালক-বালিকা বাংলাতে গান গাইবে, সেটাও কি কম কথা? আরও একটা সম্ভাবনা হল, ঐ শুভেন্দু অধিকারী, শঙ্কুদেব পন্ডা বা শমীক ভট্টাচার্যকে ক’মাস ঐ উত্তরপ্রদেশে উচ্চারণ শেখানোর জন্যই কাটাতে হতে পারে, এ রাজ্যের শব্দদূষণ কিছুটা কমবে। সব মিলিয়ে সংখ্যালঘুরা আপত্তি জানাক, তাঁদের হাতে থাকবে রবি ঠাকুর নেতাজীর করা মন্তব্য, আলোচনার অংশ, আলোচনা হোক তা নিয়ে, আর ততদিন যোগী আদিত্যনাথ বাংলা শিখুন। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘বন্দেমাতরম’ গান উত্তরপ্রদেশের স্কুলের প্রার্থনা সভাতে গাওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আপনাদের মতামত কী?
আমাদের রাজ্য সরকার বহুদিন আগেই ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটাকে রাজ্য সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা করেছে। কিছুদিন আগে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়ে দেন পাহাড় ছাড়া রাজ্যের স্কুলে প্রার্থনা সভাতে এই গান গাওয়া বাধ্যতামূলক। ওদিকে উত্তরপ্রদেশে বাধ্যতামূলক করা হল ‘বন্দেমাতরম’ গানকে, যার শেষ অংশের অনেকটাই বাংলাতেই লেখা। কাজেই এক বাঙালি হিসেবে আমরা গর্ব করে বলতেই পারি যে দেশের অন্তত দু’টো রাজ্যের স্কুলের প্রার্থনা সভাতে বাংলা ভাষায় গান গাওয়া হচ্ছে।
দেখুন ভিডিও:








