একটা গুলিতে চারটে পাখি শিকারের কথা, পাঁচটা বাঘকে ঘায়েল করার কথা, জমিদারবাবুরা বলতেন, আর মোসায়েবরা “আহা, আহা” বলে সাবাশি দিতেন। কিন্তু এক ঢিলে দুটো পাখি বাস্তবে মারা যায় না, রাজনীতিতে তো নয়ই। কেন? রাজনীতিতে নয় কেন? তার এক নম্বর কারণ হল, আপনি কেবল ঢিল মারার অনুরোধ করতে পারেন, বোঝাতে পারেন, ঢিল তো ছুঁড়বে পাবলিক। তারা এত বোকা নয় যে, আপনি যা বলবেন তাই মেনে নেবে, আপনি জমিদারবাবু নন, আর পাবলিক মোসায়েব নয়। যখন সেলিম, মানে আমাদের রাজ্য সম্পাদক কমরেড সেলিম সাহেব একইসঙ্গে এ রাজ্যে বিজেপি আর মমতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলেন, তখন মানুষ তা বুঝতে পারে না। যার ফলে পাবলিকের ঢিল গিয়ে পড়ে হয় মমতার দিকে, না হলে বিজেপির দিকে। বিহার ভোটের ফলাফল তখনও পুরো হাতেই আসেনি, অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে এনডিএ, সঙ্গে সঙ্গেই গিরিরাজ সিং বলেছেন, “বিহার হমারি হ্যায়, অব মমতা দিদি কি বারি হ্যায়”। ওদিকে দিল্লি সদর দফতরে বিজয় উল্লাস মিটিংয়ে নরেন্দ্র মোদি মোদ্দা কথাটা বলেছেন, “এবারে টার্গেট বাংলা”। গত তিন মাস ধরে এ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গাতে আরএসএস প্রচারকেরা কাজ শুরু করেছেন, আর ক’দিনের মধ্যে এক হাই পিচ ব্যাটলের নেতৃত্ব দিতে আসবেন অমিত শাহ। তুমুল প্রচার শুরু হবে, তৃণমূলের নেতা নেত্রীরা নামবেন, সামনে মমতা। মানুষ শুনবে কটুবাক্য, কিছুক্ষেত্রে মাত্রাছাড়া নোংরা গালিগালাজ, একজন গদি ধরে রাখতে চায়, একজন গদি দখল করতে চায়, এক কুরুক্ষেত্র! কিন্তু কমরেড সেলিমের মতে এসবই সাজানো, এসবই গট-আপ, এসবই আসলে সেটিং। দু’দলের সেটিং। এবং উনি মনে করেন, কী করে মনে করেন জানি না যে, মানুষ ওনার এই সেটিং তত্ত্বে বিশ্বাস করবে। সেটাই বিষয় আজকে, বিজেপি না মমতা? টার্গেট ঠিক করুন বামেরা।
‘বামেদের পুনর্জাগরণ’ এরকম একটা জরুরি আলোচনায় গিয়েছিলেন এ রাজ্যে বামেদের এখনও সবচেয়ে বড় সংগঠনের নেতা। মোদ্দা কথা হচ্ছে, বিজেপিও খারাপ, তৃণমূলও খারাপ। বেশ মেনে নিলাম। কিন্তু এরপরেই সেই একই কথা শুরু হল, এটাই নাকি আরএসএস-এর নতুন ল্যাবরেটরি, যেখানে আসলে আরএসএস-এর দর্শনের চাষ হয়, কাজেই এদের এই ল্যাবরেটরিটাকেই ভাঙতে হবে। এবং ওনার বক্তব্যের স্বপক্ষে উদাহরণও দিলেন, কীভাবে বেড়ে উঠেছে আরএসএস–বিজেপি, এই আমলেই তার উদাহরণ দিলেন। একবারও বললেন না যে, ২০১৪-তেও ২৯.৯ শতাংশ ভোট কীভাবে ২০১৯-এ ৬ শতাংশ হয়ে গেল, কীভাবে ১৭ শতাংশ বিজেপির ভোট ৪০.৬৪ শতাংশ হয়ে গেল। কীভাবে বামের ভোট রামে গিয়ে বিজেপির উথ্বানকে নিশ্চিত করল, কীভাবে সেই চলে যাওয়া ভোটকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা যায়, তা নিয়ে একটা কথাও বললেন না। আসলে এ যাবৎ কালের সবথেকে নিম্ন মেধার সিপিএম রাজ্য সম্পাদক এখন মিথ্যে ছাড়া সত্যি বলতেই ভুলে গিয়েছেন। বাম আমলে শিশু হাসপাতালের ঘর দখল করে ছিলেন, উত্তর কলকাতায় হেরে রায়গঞ্জ, সেখানে হেরে চন্ডিতলা, সেখানে জামিন খুইয়ে মুর্শিদাবাদ। এক চুড়ান্ত সুবিধেবাদী মানুষ যখন বামপন্থার পুনর্জাগরণের কথা বলেন, তখন খুব পরিস্কার বোঝা যায়, বামদের পুনর্জাগরণ কোথায় আটকে আছে।
আরও পড়ুন: Aajke | বিহারে করলে লীলা, আর বাংলায় করলে বিলা?
বামেদের বুঝতে হবে যে, মূল টার্গেট বিজেপি, তার মানে কি তৃণমূলকে ছাড় দেওয়া? এক্কেবারেই নয়, আসুক তাদের দুর্নীতি বা অপশাসনের কথা। কিন্তু মূল টার্গেট, মূল স্লোগান বিজেপি হাটাও, যদি বাম কর্মীরা মনে করেন যে, হ্যাঁ একটা ভায়াবল অলটারনেটিভ হয়ে উঠতে হবে, তাহলে তাদের বিজেপিতে চলে যাওয়া ভোটকে ফেরাতে হবে। খুব সোজা হিসেবে বিজেপি কমলে বামেরা বাড়বে, বিজেপি যত বাড়বে বামেরা তত কমবে। তার প্রধান কারণ গত ২০১১ পালাবদলের পর থেকে তৃণমূল তার ভোট বাড়িয়েছে, আর তা ঐ ৪৪ থেকে ৪৫ শতাংশ এসে ঠেকেছে, কমেনি। কমছে বিজেপির ভোট, তা আরও কমাতে পারলেই বামেদের জন্য একটা স্পেস পাওয়া যাবে। কিন্তু এই মহম্মদ সেলিমের মতো নেতা থাকলে তা হবে না। রাজনীতির এক মজা হল, আপনার কথা বলার, স্লোগান দেওয়ার উপরে কোনও বাধা নিষেধ নেই, কিন্তু পাবলিকের একটা ছাঁকনি আছে, পাবলিক সব জানতি হ্যায়, তাকে বোকা ভাবলে পুনর্জাগরণ তো দুরের কথা, শীতঘুমে চলে যেতে হবে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, বামেরা বিশেষ করে সিপিএম কথায় কথায় তৃণমূল আর বিজেপির সেটিং, এক গট-আপ গেমের কথা বলেন, আপনাদের কি মনে হয় যে এই বাংলাতে তৃণমূল আর বিজেপি সেটিং করেই চলছে?
ফেসবুক বা সমাজ মাধ্যম খুলে দেখুন, সিপিএম সমর্থকেরা সেখানে দারুণ অ্যাকটিভ। যাঁরা সারা বছর রাস্তায় দাঁড়িয়ে লড়াই করেন না, যাঁরা মানুষের পাশে থাকেন না, সেই তাঁরাই সমাজ মাধ্যম জুড়ে মমতা বিদ্বেষ ছড়াতেই থাকেন। বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা এলেই এক আজব সেটিং তত্ত্ব তুলে ধরে বিষয়টাকে এড়িয়ে গিয়ে মমতাই হয়ে ওঠেন তাঁদের টার্গেট। ফলে বামেদের র্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইল, বাম সমর্থকেরা মমতা বা তৃণমূলকেই তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে, আর তাকে সরাতে পারে এমন শক্তি বিজেপিকেই ভোটটা দেয়। ভোট হয়ে যাওয়ার পর ফলাফল বেরোলে আবার শূন্য, আরও গভীর হতাশা, আর সেই হতাশা থেকে আরও তীব্র ঘৃণা। সেই বৃত্তে ঢুকে গিয়েছে সিপিএম, সেই বৃত্ত থেকে না বেরোলে বামেদের পুনর্জাগরণ একটা কথার কথা হয়েই থেকে যাবে।
দেখুন ভিডিও:








