সাংবাদিকতা, গোয়েন্দাগিরি, খোচড়বৃত্তি, বকলমে প্রোপাগান্ডা চালানো এবং দালালি – এই সবকটার মধ্যে খুব সামান্য তফাৎ। যত দিন যাচ্ছে, তত সেই তফাৎ কমছে, কমানো হচ্ছে, আর তার এক নগ্ন চেহারা আমরা দেখছি রাজ্য নয়, দেশ নয়, দুনিয়া জুড়ে। সাংবাদিকের কারবার খবর নিয়ে, গোয়েন্দাগিরি হল নিজেই এক রহস্যের উন্মোচনা করা, একমাত্র যার পর সেই রহস্য এক খবর হয়ে উঠবে। এক গোয়েন্দা পুলিশ রিকশাওলা সেজে এক গ্যাংস্টারকে ধরার পরে তা খবর হয়ে ওঠে। এক সাংবাদিক রিকশাওলা সেজে সেই কাজ করলে তাকে সাংবাদিকতা বলে না। কিন্তু করেন, করেছেন, আর সেসব রোমহর্ষক কাহিনী বারবার বলা হয়েছে, এবং তা সাংবাদিকতার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার ধরুন খোচড়বৃত্তি, মানে গুপ্তচর হওয়া তো সাংবাদিকের কাজ নয়, এক গুপ্তচর তাঁর কাজ শেষ করলে সাংবাদিকের কাজ শুরু হয়। কিন্তু ক্রাইম বিটের বহু সাংবাদিককে দেখেছি গুপ্তচরের, মানে ঐ পুলিশের খোচড়বৃত্তির কাজ করতে, বদলে তাঁরা নাকি পুলিশের ঘোড়ার মুখের খবর পান। দালালি তো এখন যে কোনও পেশায়, তবুও সাংবাদিকতাতে আজ তার বিরাট প্রভাব।
একসময় কলকাতা মাঠে দলবদলের আগে এই দালাল সাংবাদিকদের রমরমা বাজার আমরা দেখেছি, আইপিএল-এর সময়েও দেখেছি, শুনেছি, রাজনীতির ক্ষেত্রে এই নেতার সঙ্গে ঐ নেতার মিটিং ফিক্স করা, সেই শিল্পপতির সঙ্গে ওই মুখ্যমন্ত্রীর ডিল করিয়ে দেওয়া, এসব দালাল এমনিতেই চোখে পড়বে। এনাদের সমাজ মাধ্যমে কেবল সেলফি, এনার সঙ্গে, ওনার সঙ্গে এবং প্রোপাগান্ডা। এই মুহুর্তে রাজ্যের বিরোধী দলনেতার নাকি কমসম করে তিন-চারজন ইউটিউবার আছে, যাঁরা নাকি সকালে ওনার ব্রিফ নিয়েই মাঠে নামেন। তো বিরোধী নেতারই যখন আছে, ক্ষমতায় থাকা নেতাদেরই বা থাকবে না কেন? সেখানেও আছে। কাজেই এই সাংবাদিকতা ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত চেহারা নিচ্ছে। কেউ দালাল, কেউ প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছেন, কেউ খোচড়, কেউ গোয়েন্দা। সব মিলিয়ে অন্য কিছু সাংবাদিক নয়। সেটা আবার সামনে এল। সাংবাদিক দৌড়চ্ছেন এক হত দরিদ্র মানুষের পিছনে, “অ্যাই তুই তো রোহিঙ্গা, তোর ভোটার কার্ড কোথায়? পাসপোর্ট আছে? ২০০২-এর ভোটার লিস্টে নাম আছে?” হাতে বুম, পেছনে ক্যামেরাম্যান, এনারা কারা? এনারা সাংবাদিক? যদি সেই পরিচয় দেন, তাহলে সত্যিই তা লজ্জার। আর সেটাই বিষয় আজকে, সাংবাদিক যদি নাগরিকত্বের প্রমাণ দেখতে চায়, গাছে বেঁধে রাখুন, পুলিশে খবর দিন।
আরও পড়ুন: Aajke | জাস্টিস গাঙ্গুলি কো গুসসা কিঁউ আতা হ্যায়?
এটা সাংবাদিকতা? সাংবাদিকের অধিকার আছে নাকি এক নাগরিকের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, পাসপোর্ট দেখার? সে ঘর বন্ধ করে পটি করতে যাচ্ছে, না বাজারে যাচ্ছে, না তার মাসির বাড়িতে যাচ্ছে – তা জানতে চাওয়ার অধিকারও কি তাঁর আছে? এই নির্লজ্জ দালালেরা কারা? কাদের নির্দেশ অনুযায়ী এরা এসব করছে? কেন করছে, তা তো জানাই আছে। কিন্তু সেসব করার অধিকার কি তাঁদের আছে নাকি? এক এলাকার এক বড় অংশের মানুষ যদি অন্য কোথাও চলে যায়, তাহলে তার খবর তো করতেই হবে। পড়শি, প্রতিবেশী, স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশকে জিজ্ঞেস করে রিপোর্ট তৈরি করাই তো উচিত। সেসবের ধারে কাছেও না গিয়ে এ এক আতঙ্কের আবহ তৈরি করার চেষ্টা। ওই যে ‘রাজ্যে দেড় কোটি রোহিঙ্গা আছে’- সেই মিথ্যেটার ভিত্তি নির্মাণে লেগে যাওয়া দালালেরা এই কাজে নেমেছে, এদের একজনও সাংবাদিক নয়, মাইনে পাওয়া দালাল, প্রোপাগান্ডিস্ট। এদের একজন করে ধরে র্যাডক্লিফ লাইনের কথা বললে বারুইপুরের রেললাইনের পাশের কোনও জায়গা দেখিয়ে দেব, এদের একজনকেও পরাধীন ভারতবর্ষের হক শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মন্ত্রিসভার কথা জিজ্ঞেস করলে কলাগাছের মত থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকবে। এদের একজনও ইউনাইটেড নেশনস-এর উদ্বাস্তু সংক্রান্ত সাধারণ নির্দেশের কথা শোনেইনি। তাঁরা একটা লাঠি ধরে একজনের পিছনে পিছনে ছুটছে, “আপনি কি নাগরিক? আপনি কি নাগরিক?” যেন নাগরিক হলে ১০ লাখ টাকা হাতে তুলে দেবে আর নাগরিক না হলে ফাঁসিতে চড়াবে। এদের যেখানে দেখবেন, প্লিজ মারধর না করে বেঁধে রাখুন, আর পুলিশে খবর দিন, পুলিশের কাছে অভিযোগ জানান। এই লোকজনেরা আপনার শান্তিভঙ্গের কারণ। আমাদেরও জানাতেই পারেন, কারণ সাংবাদিকের নাম করে কিছু লোচ্চা এই নোংরা কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়েছে, আমরা সেই খবর আর ছবি নিশ্চই দেখাবো। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনারা কি মনে করেন একজন সাংবাদিকের আপনার নাগরিকত্ব যাচাই এর সামান্যতম অধিকার আছে?
প্রধানমন্ত্রী এক ভাঁড়ের ভূমিকায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভিলেনের, বিরোধী দলনেতা আপাতত দেশের সংবিধান বাঁচাতে ব্যস্ত, কারণ ভোট লুঠ হয়ে যাচ্ছে, শিক্ষকরা ব্যস্ত ভোটার তালিকা শোধরানোর কাজে, ছাত্ররা রেল উদ্বোধনে আর এসএসএর প্রার্থনা গাইছেন, বুলডোজার এখন বাড়ি ভাঙার যন্ত্র, হিন্দু ধর্মের মানুষজনের কাজ এখন একটাই গরু পাচার আটকানো, আর সাংবাদিকতার নামে এক অসভ্যতামি চলছে। মজার কথা হল, এগুলো কোনওটাই আলাদা নয়, বিচ্ছিন্ন নয়, একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে আছে। একজন সাংবাদিক হিসেবে সেটাই আজ লজ্জার, এই বাংলা জন্ম দিয়েছে বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, গৌরকিশোর ঘোষ, বরুণ সেনগুপ্তের, সেই বাংলাতে এখন সাংবাদিকের নামে দালালদের চাষবাস।
দেখুন ভিডিও:








