মোদিজীর জন্মদিন বলে কথা, যে জন্মদিনে ওনার অবসর নেবার কথা, সেই জন্মদিনেই ওই অবসরের মতো অপয়া অলুক্ষুনে কথা বার্তাগুলো এড়ানোর জন্যই সারা দেশে ঢাকঢোল পিটিয়ে ওনার জন্মদিন পালন করা হচ্ছে। রাজারাজড়াদের ক্ষেত্রে এটা হত। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষও জন্মদিন পালন করেন বইকী, কিন্তু তা এক পাবলিক ইভেন্ট করে তোলে তারাই যারা নিজেদের অস্তিত্ব, কাজ আর জীবনচর্যা নিয়ে সারাক্ষণ প্রচণ্ড হীনমন্যতায় ভোগে। এক্কেবারে সেই কারণেই সম্রাট, রাজারাজড়ারা জন্মদিন পালন করতেন আর খেয়াল রাখতেন অনুগত জনেরা উৎসবে যোগ দিল কি না, নজরানা পাঠাল কি না। তো মোদিজির জন্মদিন বেশ কিছু বছর ধরেই পালন করা হয়, নানা চেহারায়, এবারে তার জাঁকজমক অনেক বেশি কারণ এবারে ৭৫। হিসেব ধরলে এবারে ওনার অবসর নেওয়ার কথা, তো সেই উপলক্ষে এবারে কলকাতায় ওনার জীবনের নানান গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে একটা প্রদর্শনী ওনার জন্মদিন ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২১ সেপ্টেম্বর, পাঁচ দিন চলবে। কলকাতা মিউজিয়াম, জাদুঘরের কোনও একটা ঘরে বা কোনও একটা হলে তার আয়োজন সম্ভব নয়। দু’টো তলা আর মাঝের কোর্টইয়ার্ড জুড়ে প্রদর্শনী সাজানো হচ্ছে। পাঁচ দিনই সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত প্রদর্শনী খোলা থাকবে। মানে মোদিজিকে দেখতে চান? চলে যান জাদুঘরে, যেখানে লুপ্ত হয়ে যাওয়া ডাইনোসরের চোয়াল থেকে কাটা মাথা কনিষ্কের মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে ইতিহাসের মুছে যাওয়া পাতাগুলোকে দেখে নেওয়া যায়। এমন এক সিম্বলিক আয়োজনের জন্য বঙ্গ রাজ্য সভাপতির ধন্যবাদ তো প্রাপ্য, আফটার অল এতদিন পরে একজন ইনটেলেকচুয়াল দায়িত্ব নিয়েছেন দলের, মোদিজিকে পাঠিয়েছেন জাদুঘরে। সেটাই বিষয় আজকে, হ্যাঁ, ওই জাদুঘরেই ঠাঁই হবে মোদিজির, রাজ্য বিজেপির সিদ্ধান্ত ১০০% ঠিক।
২০১৪ সালে মোদিজি দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, হওয়ার আগে অন্তত চারটে বড় প্রতিশ্রুতির কথা তিনি প্রত্যেকটা জনসভায় বলেছিলেন, ১) কালা ধন ওয়াপস লায়েঙ্গে, কালো টাকা ফেরত আনব, আর সেই টাকা দেশের মানুষকে দেব, ইউঁহি হরেক কে খাতে মে পন্দরহ পন্দরহ লাখ আ যায়েঙ্গে। একটা টাকাও এখনও ফেরত আসেনি, বরং তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে, ৫০ জন শীর্ষ ঋণ খেলাপি ব্যবসায়ী ৯২৫৭০ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে, যাদের মধ্যে ৯০ শতাংশ আবার গুজরাটি। ২) বলেছিলেন কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করে দেব। কৃষকদের আয় যদি ইনফ্লেশনকে মাথায় রেখে হিসেব করি তাহলে বাড়া তো দূরের কথা কমেছে। ৩) বলেছিলেন না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা। আজ চারিদিকে লুটপাট চলছে, দেশের সম্পদ নামমাত্র টাকায় তুলে দেওয়া হচ্ছে কিছু হাতে গোনা ব্যবসায়ীদের কাছে। ৪) বলেছিলেন অচ্ছে দিন আয়েঙ্গে। এই মুহূর্তের হিসেব হল যুবক যুবতী, যাঁরা ৩০ বছরের মধ্যে এবং যাঁদের গ্রাজুয়েশনের সার্টিফিকেট আছে, তাদের ৩৭ শতাংশ বেকার। টাকার দাম পড়তে পড়তে তলানিতে, অর্থনীতি বেহাল। সেই প্রধানমন্ত্রীর কোন কীর্তি ওই মিউজিয়ামে রাখা হবে? অনেকেই তেমন কিছু খুঁজে পাবেন না।
আরও পড়ুন: Aajke | কেন শাঁখা, নোয়া, পলা খুলেই বিবাহিত মহিলাদের ঢুকতে হবে পরীক্ষা হলে?
আমি বরং চারটে সাজেশন দিই যেগুলো ওই মিউজিয়ামে রাখলে আমরা দল বেঁধে দেখতে যাব। প্রথমটা হল মোদিজির সার্টিফিকেট, হ্যাঁ উনি যে কেবল এমএ পাশ করেছেন তাই নয়, জানা গেছে উনি বিএ-ও পাশ করেছেন, তো সেই দুটো সার্টিফিকেট, ওই এন্টায়ার পলিটিক্যাল সায়েন্সের একটা বই আর ওনার তিনজন শিক্ষকের নাম আর ১০ জন একই সঙ্গে পড়েছেন এমন বন্ধুর নামের তালিকা। হ্যাঁ, এটা দেখতে দেশবিদেশ থেকে লোকজন আসবে। দ্বিতীয়টা হল, ওনার ভিক্ষে করে আমেরিকার ২৬টা অঙ্গরাজ্যে যাওয়ার ভিসাটা যদি রাখা হয় তাহলে রেকর্ড ভিড় হবে, কারণ সেই সময় ভিক্ষে করে কমসম করে ২৬ দিন আমেরিকায় কাটানো একজনের ভিসা দেখতে লোক হামলে পড়বে। ৩) সেই পুকুর যেখান থেকে উনি জ্যান্ত মগরমচ্ছ ধরে বাড়ি ফিরেছিলেন, সেই পুকুরের ছবি আর তার সঙ্গে সেই মগরমচ্ছের মানে কুমিরের একটা ছবি দিলে জমে ক্ষীর, বাইরে টিকিট ব্ল্যাক হবে। ৪) ওনার বচপন মে কলকাত্তা মেট্রো রেল ঘুমনে আতা থা, তো ওনার সেই ৩৬ বছরের বচপনের একটা ছবি, পৃথিবীর কেউ তো ৩৬ বছরের শিশু বা বালক দেখেনি, কাজেই তা স্বচক্ষে দেখে অনেকেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়বে। এই চারটে জিনিস থাকলেই আগামী সাতদিন কলকাতার সব রাস্তা গিয়ে মিশবে ওই কলকাতা জাদুঘরে, বাচ্চারা তালি বাজাবে, মাদারি খেল দেখো, জাদুকা খেল দেখো। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাদের অনেকেই তো ইন্দিরা গান্ধীকে দীর্ঘ সময় রাজনীতিতে দেখেছেন, জ্যোতি বসুকে দেখেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখছেন, তাঁদের জন্মদিনকে ঘিরে কোনওদিন এরকম আদেখলেপনা দেখেছেন? একজন জীবিত মানুষের জন্মদিন নিয়ে এই ধরনের এক ইভেন্ট তৈরি করাকে কীভাবে দেখছেন আপনারা? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
একটু খেয়াল করে দেখবেন, কলকাতায় বিজেপির সমস্ত ইভেন্ট ইজেডসিসি, কলকাতা জাদুঘর, ন্যাশন্যাল লাইব্রেরি বা কলকাতা পোর্টের অডিটোরিয়াম ইত্যাদিতে হয়। মানে দিল্লির সরকার বাহাদুরের হাতে যা আছে সেটা ওনারা ওনাদের পিতৃপুরুষের সম্পত্তির মতোই ব্যবহার করেন, এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু ওই চারটে জায়গার মধ্যে এক জাদুঘরকে প্রধানমন্ত্রীর জীবনী প্রদর্শনীর জন্য বেছে নেওয়াকে বাহবা না জানিয়ে পারা গেল না। আজ থেকে শ’ দু’শ চারশ বছর পরেও থাকবে কলকাতা মিউজিয়াম, তার এক কোণে নরেন্দ্র মোদি থাকতেই পারেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, এ প্লাস বি হোল স্কোয়ারের নতুন ফর্মুলার আবিষ্কারক হিসেবে, যেখানে ওনার সামনেই পড়ে থাকবে সেই এক্সট্রা টুএবি-টা।