এমন একটা সময় আসে, যখন কোনও একটা দেশে কালো হয়ে নামে অন্ধকার, আর সেই অন্ধকারে ঢেকে যায় মানুষের জীবন। হোঁচট খেতে থাকে সভ্যতা। আমাদের দেশেও কিন্তু সেরকমই একটা সময় নেমে এসেছে। ছড়িয়ে পড়েছে মৃত্যু আর হাহাকার। না, যুদ্ধ নয়, মহামারী নয়। বলছি এসআইআর-এর কথা। পর পর আত্মহত্যার ঘটনা দিয়ে এসআইআর পথচলা শুরু করেছিল এই বাংলায়। আর এখনও মানুষ রাস্তা হাতড়াচ্ছে এসআইআর-এর অন্ধকারে। কিন্তু এরকমটাই যে হবে, তার আঁচ তো বিহারে এসআইআর লাগু হওয়ার সময় থেকেই টের পাওয়া গিয়েছে, তাই না? রাহুল গান্ধী বিহারে ভোটার অধিকার যাত্রা শুরু করার আগেই, এই অভিযোগ উঠেছিল যে, বেছে বেছে সংখ্যালঘু এবং মহিলা ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে। সোজা কোথায়, বিজেপির হিন্দুত্ববাদী ভোটার যাঁরা নয়, তাঁদের নাম ভোটার লিস্ট থেকে যত পারা যায় কেটে দেওয়াই নির্বাচন কমিশনের লক্ষ্য।
এসব নিয়ে সেই সময় নানা রকম জল্পনা হয়েছিল। কারও কারও তো মনে হয়েই ছিল, না, এতটা করার সাহস বোধ হয় কোন সরকারেরই হবে না। কিন্তু তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন, স্বৈরাচারী কোনও সীমা মানে না। ক্ষমতা দখলের জন্য সে যেকোনওরকম অন্যায় করতে পিছুপা নয়। সে মুখে বলে, যেমন নেপোলিয়ন বলতেন যে, সিংহাসন আসলে মখমলে ঢাকা একটা কাঠের চেয়ার ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু কাজের বেলা হাজারো মানুষের জান মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে তার বাঁধে না। কেন বলছি এ কথা? বলছি এই কারণেই যে, এসআইআর নিয়ে সম্প্রতি মারাত্মক একটা অভিযোগ উঠেছে। কারা তুলেছেন সেই অভিযোগ? না, তৃণমূল তোলেনি। কোন রামা-শ্যামা-হেজি-পেজিও নয়। অভিযোগ তুলেছেন ইআরও অর্থাৎ ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসাররা। বিএলও-দের উপরে কাজ করেন এই ইআরও-রা। সেই তাঁরাই একটি চিঠি পাঠিয়েছেন, রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিককে। রাজ্যে যে প্রক্রিয়ায় এসআইআর করা হয়েছে, তা নিয়ে প্রবল আপত্তি তোলা হয়েছে ডব্লিউবিসিএস অ্যাসোসিয়েশনের তরফে পাঠানোর সেই চিঠিতে।
কী বলা হয়েছে সেই চিঠিতে? আবারও বলছি মারাত্মক অভিযোগ। তাঁরা জানিয়েছেন, ইআরও-দের সঙ্গে আলোচনা না করেই তালিকা থেকে ইচ্ছেমতো নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। আপত্তি জানানো হয়েছে খসড়া ভোটার তালিকা তৈরি করা নিয়েও। চিঠিতে এই অভিযোগও করা হয়েছে, যোগ্য ভোটারদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। চমকে উঠলেন কি? দাঁড়ান, খেলা বাকি আছে। আসল কথা শুনলে হয়তো শিউরে উঠবেন। যে চিঠির কথা আপনাদের বললাম, সেখানে জানানো হয়েছে, আইন অনুযায়ী ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে ইআরও-দের একটি ভূমিকা থাকে। যাঁর নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কথা হচ্ছে, তাঁর বক্তব্য শোনার সুযোগ দেন ইআরও। কিন্তু, এই সুযোগটাই দেওয়া হয়নি। দেওয়া যে হবে না, সেটা কারা ঠিক করল? কেন ঠিক করল? চিঠিতে আরও অভিযোগ করা হয়েছে যে, যে সব নাম বাদ গিয়েছে তা একেবারেই ইআরও-দের অন্ধকারে রেখে করা হয়েছে। ফলে যাঁরা ভোগান্তিতে পড়েছেন তাঁরা ইআরও-দেরই কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন।
ভাবুন একবার – ২৭ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া শুনানিগুলোকে সামনে রেখে, যে শুনানিতে লক্ষ লক্ষ ভোটারের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে, তাকে যথাযথ করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসার বা ইআরও-রা যখন প্রাণপণ প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ঠিক তখনই রাজ্যের এক প্রশাসনিক আধিকারিক সংগঠন গুরুতর আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। সংগঠনটির অভিযোগ, স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর প্রক্রিয়ায় ইআরওদের অজ্ঞাতসারে ও আইনসিদ্ধ অংশগ্রহণ ছাড়াই ‘স্বপ্রণোদিত, সিস্টেম-চালিত’ পদ্ধতিতে ব্যাপক হারে নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে। সোজা কথায়, এআই দিয়ে, সফটওয়্যার দিয়ে ভোটার লিস্ট থেকে নাম বাদ দেয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুন: Aajke | বাংলাদেশকে গাজা পট্টি বানিয়ে দেবো, শুভেন্দু অধিকারী কী ভেবে এই কথা বললেন?
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও) মনোজ আগরওয়ালকে লেখা হয়েছে এই চিঠি, যার অনুলিপি প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারকেও পাঠানো হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সিভিল সার্ভিস (এক্সিকিউটিভ) অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন অভিযোগ করেছে যে, এসআইআর চলাকালীন ‘ভোটারদের AI ব্যবহার করে বাদ দেওয়া হচ্ছে এবং এতে ইআরওদের আইনগতভাবে নির্ধারিত ভূমিকা কার্যত এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে’।
জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫০ অনুযায়ী, কোনও ভোটারের নাম তালিকায় থাকবে কী না, সে বিষয়ে নোটিস জারি, শুনানি গ্রহণ এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র আইনগত ক্ষমতা ইআরও-দের। কিন্তু সংগঠনের দাবি, এই এসআইআর প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন অব ইন্ডিয়া (ইসিআই)-র সফটওয়্যারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে নোটিস তৈরি করাচ্ছে, যেখানে সংশ্লিষ্ট ইআরওদের স্বাধীনভাবে বিবেচনার কোনও সুযোগই থাকছে না। আসুন দেখা যাক, মানুষ এই নিয়ে কী বলছেন।
ইআরও-দের এই অভিযোগের সঙ্গে মিল রয়েছে বিহারের সমস্যারও, যেখানে ইআরওরা লক্ষ্য করেছিলেন যে ইসিআই-এর সেন্ট্রালাইজড পোর্টালে তাঁদের লগইনে এমন সব নোটিস দেখা যাচ্ছে, যেগুলোতে তাঁদের নাম থাকলেও সেগুলি তাঁরা নিজেরা তৈরি করেননি। কি করব এবার? রাহুল গান্ধীর স্লোগান ফিরে বলব, ‘ভোট চোর গাদ্দি ছোড়?’
ইআরও-দের অভিযোগের কথায় আরেকবার ফিরে আসি। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সাইকত আশরাফ আলি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া বক্তব্যে জানিয়েছেন, এই সংগঠন স্বচ্ছতা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ চায়। তাঁর কথায়, “যদি নাম বাদ দেওয়া হয়, তবে মানুষকে স্পষ্টভাবে জানাতে হবে যে, এর জন্য ইআরও-রা দায়ী নন। আমরা চাই না, একজন প্রকৃত ভোটারের নামও ভুলভাবে বাদ পড়ুক।”
জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫০-এর ধারা ২২ উদ্ধৃত করে সংগঠনটি জানিয়েছে, কোনও ভোটারের নাম বাদ দেওয়ার আগে ইআরও-কে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ‘যুক্তিসঙ্গতভাবে শুনানির সুযোগ’ দিতে হবে, যে দায়িত্ব বর্তমান প্রক্রিয়ায় ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলেই তাদের অভিযোগ।
তবে পশ্চিমবঙ্গ সিইও-র দফতর এই অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছে। জ্ঞানেশ কুমার কী বলছেন? তিনি যথারীতি দিল্লি দেখিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু দিল্লি বহুত দূর হ্যায়, তাই না? সেখানে পৌঁছনোর আগেই কত নাম যে বাদ যাবে, কে জানে।
ফাইনাল যে ভোটার লিস্ট বেরোবে তাতে ইআরও-র সই ও সিলমোহর থাকবে। তাই অ্যাসোসিয়েশনের তরফে আবেদন করা হয়েছে, যাতে এমন পদক্ষেপ করা হয়, যার মাধ্যমে ইআরও-রা নিয়ম-অনুযায়ী নিজেদের ক্ষমতার যোগ্য ব্যবহার করে আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারেন।
ডব্লিউবিসিএস অফিসারদের উপরেই এসআইআর-এর শুনানি পর্বের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। এই কাজের ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হলে ইসিআই-এর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে বলে, ইতিমধ্যেই নির্বাচন কমিশনের তরফে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতেই মঙ্গলবার ডব্লিউবিসিএস এগজিকিউটিভ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই মিটিংয়ে অফিসারদের আশ্বস্ত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এসআইআর নিয়ে সব অফিসারদের পাশে সরকার থাকছে বলে আশ্বাস দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
দেখুন আরও খবর:







