Sunday, August 24, 2025
HomeScrollঅদিতির সঙ্গে সাদা কালো | দেউচা পাঁচামি, সমস্যাটা কোথায়?

অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | দেউচা পাঁচামি, সমস্যাটা কোথায়?

নমস্কার আমি অদিতি, শুরু করছি কলকাতা টিভির আর নতুন নয়, ইতিমধ্যেই ৬৫ টা এপিসোড হয়ে গেছে,হাজির আমাদের অনুষ্ঠান নিয়ে, সাদা কালো। একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। আজকের বিষয়, দেউচা পাঁচামি, সমস্যাটা কোথায়?

দেউচা পাঁচামি কয়লা খনি বীরভূম জেলায়, ভারতের সবচেয়ে বড় খনিগুলোর মধ্যে একটা। হিসেব মতো এখানে প্রায় ২,১৭০ মিলিয়ন টন কয়লা আছে। এটা আমাদের বাংলার অর্থনীতির ছবিটা বদলে দিতে পারে, এক বিরাট পরিবর্তন আনতেই পারে। যদি এই প্রজেক্টের রিসার্চগুলো ঠিক হয় তাহলে এটা ভারতের সবচেয়ে বড় আর বিশ্বের দ্বিতীয় বড় কয়লা খনি হয়ে উঠবে। কিন্তু স্থানীয় আদিবাসীদের এক অংশ এর বিরোধিতা করছে, বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে এই প্রকল্পের বিরোধিতাও করা হচ্ছে। হ্যাঁ শিল্পায়ন, বেকারদের চাকরি, বাংলার অর্থনীতির যুক্তি দিচ্ছেন রাজ্য সরকার, তৃণমূল দল আর তার প্রতিবাদ করছে মূলত বামেরা। বামেদের এই প্রতিবাদ, এই আন্দোলন এক ধরনের প্যারাডাইম শিফট। সেই সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের সময়ের কথা ভাবুন, সেদিন যে যে কথাগুলো বাম সরকার বলেছিল, যে যে যুক্তিগুলো বুদ্ধ ভট্টাচার্য তুলে ধরেছিলেন, সেই কথাগুলো আজকে মমতা সরকার বলছেন, ঠিক যে ভাবে সেদিন তৃণমূল বিরোধিতা করছিল সেই মাত্রায় না নিয়ে যেতে পারলেও বামেদের বিরোধিতার ক্ষেত্রে বক্তব্য হুবহু এক। যদিও একটা বিরাট ফারাক হল সেদিন সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের সময়ে সরকার, প্রশাসন আর পুলিশের যে ভূমিকা ছিল, আজ সেটা এক্কেবারে আলাদা। কথা বলে, আলোচনায় বসে, বুঝিয়ে সুঝিয়ে, কোথাও কোথাও ম্যানেজ করে সামলানোর চেষ্টা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। গণ আন্দোলনে গুলি চালাব না বলেছিল বাম সরকার, কিন্তু কাজে ঠিক উল্টোটা করেছিলেন, মমতা কিন্তু সেটাই করে দেখাচ্ছেন, আলোচনা, ম্যানেজমেন্ট, ট্র্যাক টু আলোচনা, সামনের আলোচনা সব মিলিয়ে একটা বাবা বাছা বলে কাজ করানোর চেষ্টা। এবং এসবের মধ্যে দেউচা পাঁচামি মোহাম্মদবাজার ব্লকের দেউচা ও পঞ্চমতী বা পাঁচামি এলাকায়, ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩২৬ একর জমিতে বেসল্ট খুঁড়ে বার করা কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। পক্ষের যুক্তিগুলো দেখে নেওয়া যাক। এই যুক্তিগুলো কিছু সরকারের কথা আর কিছু সরকারপন্থী অর্থনীতিবিদদের কথা। তাঁদের বক্তব্য এই প্রকল্পের ফলে প্রায় ২০,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ আসবে, কয়লা দিয়েই রাজ্যের অর্থনীতি হাল বদলানো যাবে। মোট খরচ ৩৫,০০০ কোটি টাকা হতে পারে। প্রায় ১,০০,০০০ মানুষের চাকরি হবে, সরাসরি চাকরি। সরকার জানাচ্ছে বীরভূম আর পাশের এলাকায়। যারা জমি ছাড়বে, তাদের পরিবার থেকে একজনকে পুলিশে চাকরি দেওয়া হবে। এনার্জি সিকিউরিটি, হ্যাঁ দেশের শক্তির নিরাপত্তার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা, কয়লা বেশি হলে বাইরে থেকে কিনতে হবে না, দেশের শক্তির জোগান ভালো হবে। এবং আগের মতো বোকামি না করে ক্ষমতায় থাকা সরকার এক বিরাট কমপেনসেশন প্যাকেজ সাজিয়ে ফেলেছে। ক্ষতিপূরণে ১০,০০০ কোটি টাকার প্যাকেজের কথা বলা হচ্ছে। প্রতি বিঘায় ১০-১৩ লক্ষ টাকা, ৬০০ বর্গফুটের বাড়ি, আর ৫.৫ লক্ষ টাকা সাহায্য। কৃষি শ্রমিকদের ৫০,০০০ টাকা আর ৫০০ দিনের কাজ দেওয়া হবে। সরকার বলছে, প্রথমে সরকারি জমিতেই কাজ শুরু হবে, জোর করে জমি নেওয়া হবে না। এবং এই প্রতিশ্রুতিগুলো কিন্তু লিখিত আকারেই সব্বার কাছে দেওয়াও আছে। এবারে আসুন একটু অন্যদিক থেকেও বিষয়টাকে দেখা যাক।

আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | এবার শুরু অর্ধেক আকাশের দাবিতে লড়াই

একটু খতিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন যে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়ে তৃণমূল যা যা বলেছিল, এবারে সিপিএম ঠিক সেই কথাগুলোই প্রায় তোতাপাখির মতো বলে যাচ্ছে, কেবল সময়ের তফাৎ তাও নয়, তফাৎ অনেক কিছুর। সেদিন মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন, জল জমি জঙ্গলের অধিকারের কথা, মহাশ্বতা দেবী সঙ্গে ছিলেন, উঠেছিল স্লোগান মা মাটি মানুষের।

আজ সিপিএম পেছন থেকে এগিয়ে দিচ্ছে আদিবাসী, পরিবেশবাদী আর সমাজসেবীদের। তাদের বক্তব্য, এক, ২১,০০০-এর বেশি মানুষ, যার ৪৩ শতাংশ আদিবাসী যাঁদের বেশিরভাগই সাঁওতাল, তাঁরাই উচ্ছেদ হবেন। ১১টি গ্রাম আর ৫৩টি পাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ১১,২২২ একরের ৮১ শতাংশ আদিবাসীদের জমি। দুই, খোলা খননে জঙ্গল, জীবজন্তু আর পরিবেশের ক্ষতি হবে। ব্যাসল্ট খননে বিদেশি টাকা আর প্রযুক্তি লাগবে, ক্ষতি বাড়তে পারে। তিন,স্থানীয়দের সঙ্গে ভালো করে কথা হয়নি। আদিবাসী মহিলারা জমি ছাড়তে রাজি নয়, বিক্ষোভে নেমেছে। চার, সমাজ আর পরিবেশের ক্ষতি অর্থনীতির লাভের চেয়ে বেশি হবে। ক্ষতিপূরণের টাকা সঠিকভাবে খরচ নাও হতে পারে, আদিবাসীরা দরিদ্র হয়ে যেতে পারেন। এসব বলার পরে আন্দোলন শুরু হয়েছে কিন্তু সেই তীব্রতা পায়নি কারণ সিপিএমের বিশ্বাসযোগ্যতা এখন তলানিতে। ২০২৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩২৬ একরে ব্যাসল্ট খনন শুরু হয়েছে। কিন্তু বিক্ষোভ থামেনি। আদিবাসীদের এক অংশ ক্ষতিপূরণ নিতে রাজি নয়। আমরা দেখেছি, ২০২১ সালের ১৮ ডিসেম্বর বিক্ষোভে মহিলারা ঝাঁটা নিয়ে প্রকল্পের লোকদের তাড়িয়েছে। সরকারি দলের সঙ্গে আদিবাসীদের ঝামেলা হয়েছে। এখনও সেই বিক্ষোভ চলছে। দেউচা পাঁচামি প্রকল্পে অর্থনীতির স্বপ্ন আর সমাজ-পরিবেশের ক্ষতির আশঙ্কাকে ঘিরে এক লড়াই চলছে। এই প্রকল্প চাকরি আর অর্থনৈতিক লাভ এনে দিতে পারে, কিন্তু আদিবাসীদের উচ্ছেদ আর পরিবেশের ক্ষতি সেটাও তো এক বড় চিন্তা। আসলে আরও একটু গণতান্ত্রিক পরিবেশে আরও আলোচনা আর কথাবার্তার ভিত্তিতেই একটা সমাধানে আসা সম্ভব। কিন্তু যাঁরাই প্রতিবাদ করবেন তাঁরাই মাওবাদী, প্রতিবাদীদের ঢুকতেই দেওয়া হবে না এরকম গা-জোয়ারি কাজকর্ম কিন্তু কোনও সমস্যার সমাধান করতে পারবে না, উলটে সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠবে, এই কথাটা বিশেষ করে সরকার পক্ষের মাথায় রাখা উচিত। সঠিক নীতি দরকার, যাতে মানুষের অধিকার আর পরিবেশ দুটোই বাঁচে।

Read More

Latest News