Sunday, August 24, 2025
HomeScrollFourth Pillar | গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরুন: মমতা

Fourth Pillar | গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরুন: মমতা

দাদা-কাকাদের মুখে শুনেছিলাম, সাতের দশকের এক স্লোগান, গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলুন। আদত কথাটা ছিল মাও সে তুংয়ের, চীন বিপ্লবের সময়ে তিনি কৃষি প্রধান চীনের বিপ্লবের নেতা হিসেবে বলেছিলেন গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলুন। হ্যাঁ, সেই সময়ের হাতে গোনা সেই চীনের শহরগুলো ঘিরে ফেলেছিল অসংখ্য গ্রাম থেকে রওনা দেওয়া লাল ফৌজ। আজ এই দুনিয়াতে ওই অস্ত্র হাতে বিপ্লব বা সমাজ পরিবর্তন হবে কি হবে না তা নিয়ে বিশাল তর্ক করা যায়, কিন্তু এটাও হলফ করেই বলা যায় যে আমাদের এই কৃষিপ্রধান দেশের ধমনি শিরা সবই ওই গ্রাম দিয়েই বইছে, সেই বিশাল রুরাল ইন্ডিয়া, ভারতের গ্রামের মানুষদের সমর্থন ছাড়া দেশের ক্ষমতা দখল সম্ভব নয়। কমিউনিস্টদেরই দেখুন, ক্রমাগত এলিটিজমে ঢুকে পড়ে এক নাগরিক কমিউনিস্ট পার্টি আজ অস্তিত্বের সংকটে আর কেবল জুগগি ঝোপড়ি খেত খলিয়ানের হিন্দু মানুষের মনের রামলালাকে সামনে রেখে বিজেপি আজ মসনদে। সেই একই খেলাতে এই বাংলায় মমতা এগিয়ে, অনেক এগিয়ে। গ্রাম বাংলার ধমনি শিরার স্পন্দন মমতা বোঝেন, আর বোঝেন বলেই নির্বাচনের পর নির্বাচন তাঁর সমর্থনকে ধরে রেখেছেন, তা অটুট, সামান্য বাড়ছে বই কমছে না। সিপিএম-এরও সেটাই ছিল ভিত্তি, সেই তেভাগার আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, এক বাটি ফ্যান ভাতের লড়াইয়ের ভিত্তি তো ছিল গ্রামবাংলা। হঠাৎ তেনাদের মাথায় উন্নয়নের ভূত চাপল। সারা পৃথিবীর জঘন্য উদারনীতির আড়ালে এক অত্যাচারি উন্নয়নের মডেলেই ওনারা তিন ফসলা জমি কেড়ে বিকাশের কাজে নামলেন, নামার আগে সেই জমির আদত মালিকদের সঙ্গে, সেই গ্রামবাংলার মানুষদের সঙ্গে একবারও আলোচনা করারও প্রয়োজন মনে করলেন না। এখন নিজেদের পার্টি অফিসগুলোকে ধরে রাখার জন্য জান কবুল লড়তে হচ্ছে।

উল্টোদিকে এক উথাল পাথাল নাগরিক আন্দোলন, রিক্লেইম দ্য নাইট মমতা সরকারের একটা ইটও খসাতে পারেনি তা এখন পরিষ্কার। হ্যাঁ, এটা অন্য যে কারও থেকে বেশি বুঝেছেন, ভালো করে বুঝেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই পরীক্ষার আগে যেমন মা তার সন্তানের কপালে কালো টিকে দিয়ে দেয় নিয়ম করে, ঠিক সেইরকমভাবেই প্রতিটা মুহূর্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের নজরে আছে গ্রামবাংলা। শুরুর থেকে কন্যাশ্রী থেকে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে দুয়ারে সরকার, আদত লক্ষ্য ওই গ্রামবাংলা। কারণ এখানেই থাকে ওনার দুই নয়নমণি, ১) গরিব বাঙালি মুসলমান ভোটার, ২) মহিলা ভোটার। এই দুইয়ের যোগফল হল ওনার ওই ৪৫ থেকে ৪৮ শতাংশ ভোট। আপনি বলতেই পারেন শহরের হিন্দিভাষী মুসলমান ভোটারদের কথা, কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবেন তাঁদের কাছে মমতা ছাড়া কোনও আলাদা বিকল্প নেই, বিজেপিকে হারাতে যে পারে তারাই ওই অবাঙালি মুসলমানের ভোট পাবে, কাজেই আপাতত তাঁদের কাছে তৃণমূল ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। শহরের গরিব বস্তি এলাকার মানুষ আজ নয় সেই রাজনীতির শুরুয়াতি দিনগুলো থেকেই মমতার সঙ্গেই আছে, সেই কবে টালিগঞ্জ রেল বস্তির আন্দোলনের কথা যাঁদের মনে আছে তাঁরা জানেন, মহানগরের বস্তি থেকেই লালবাড়ি হয়ে নবান্নতে হাজির মমতার শিকড় ওখানে আছে। কিন্তু আসল জমা পুঁজি ওই গ্রামবাংলার ভোট আর সেটা আবার আমরা দেখলাম এবারের বাজেটে। অর্থমন্ত্রী সে দেশের হোক আর রাজ্যের হোক বাজেট কেবল পেশ করেন, বাজেটের মূল দিশা তো প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীরই থাকে আর এই বাংলাতে আমরা জানি মন্ত্রিসভার ১ থেকে ৩৯ নম্বরের নাম ওই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তো এবারের বাজেটের দিকে চোখ রাখুন।

পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন: ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে বরাদ্দ ৪৪,১৩৯.৬৫ কোটি টাকা। বাংলার বাড়ি (গ্রামীণ) প্রকল্পে ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে আরও ১৬ লক্ষ বাড়ি তৈরি করা হবে। এর জন্য আরও ৯৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে রাজ্য বাজেটে। গ্রামীণ সড়কের জন্য রাজ্য সরকারের পথশ্রী প্রকল্পে তিন দফায় ইতিমধ্যে কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। আগামী অর্থবর্ষে পথশ্রী প্রকল্পের জন্য আরও ১৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। আগামী অর্থবর্ষে আরও ১৬ লক্ষ পাকাবাড়ি তৈরির প্রথম কিস্তির টাকা দেওয়া হবে এ বছরের ডিসেম্বরেই। ১৬ লক্ষ পরিবারকে পাকাবাড়ির প্রথম কিস্তি দিতে মোট খরচ পড়বে ৯৬০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এ বছর রাজ্যকে বাংলার বাড়ি প্রকল্পে জুন এবং ডিসেম্বর মিলিয়ে মোট ব্যয় হবে ১৬৪০০ কোটি টাকা। গ্রামীণ রাস্তাঘাট সংস্কার এবং নতুন সড়ক তৈরির জন্য রাজ্য সরকার নিজস্ব পথশ্রী প্রকল্পও চালু করেছে। পথশ্রী-১, পথশ্রী-২ এবং পথশ্রী-৩ মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত ৩৭০০০ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ করা হয়ে গেছে। সামনের বছরে এই প্রকল্পের জন্যও বরাদ্দ ঘোষণা করা হয়েছে রাজ্য বাজেটে। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী বা আশা কর্মীদের স্মার্ট ফোন দেওয়া হবে, কেবল বীরভূম জেলার অঙ্গনওয়াড়ি ও আশাকর্মীদের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। সকলকে কাজের প্রয়োজনে ফোন দেওয়া হলে সেটা নিয়ে উল্লসিত আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা। জেলার অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরাও বলছে্ন, কাজের চাপ আছেই, সঙ্গে নানাবিধ তথ্য সংগ্রহে রাখতে হয়। সে জন্য স্মার্ট ফোন আবশ্যক। প্রায়ই প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে যে সব দাবি তাঁরা জানিয়েছেন সেই তালিকায় স্মার্টফোন দেওয়ার দাবিও ছিল। এবার দাবি পূরণ হল।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ডাক্তারবাবুরা গাছেরও খাবেন, তলারও কুড়োবেন?

একইভাবে মা ও শিশুদের পরিষেবা-সহ জনস্বাস্থ্য বিষয়ক নানা পরিষেবা দেওয়া এবং তথ্য সংগ্রহ আশাকর্মীদের কাজের অঙ্গ কাজেই দীর্ঘদিন ধরে স্মার্টফোনের দাবি ছিল তাঁদেরও। তাঁদের বক্তব্য, নিয়োগের সময় থেকেই মোবাইলের দাবি তুলেছিলেন তাঁরা। তখন রাত-বিরেতে প্রসূতিদের গর্ভযন্ত্রণা উঠলে অ্যাম্বুল্যান্স ডাকা-সহ বিভিন্ন কাজ তাঁদের করতে হত। পরে জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন প্রকল্পে নানান তথ্য নথিভুক্ত করার কাজও তালিকায় যোগ হয়। অবশেষে সেই দাবিও পূরণ হল। এরপরে আসা যাক নদীবাঁধে বরাদ্দের প্রসঙ্গে। গত বর্ষায়ও বীরভূমে কিছু এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল দুর্বল নদীবাঁধ ভেঙে। বীরভূমে বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এই প্রেক্ষিতে জেলার নদ-নদীগুলির দুর্বল বাঁধগুলির জন্য বরাদ্দ হলে জেলা উপকৃত হবে। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতি বছরই নদীপাড় ভাঙন, বাড়ি ঘর তলিয়ে যাওয়া বা বহু মানুষের বাস্তুহারা হওয়ার মতো ঘটনা অন্যান্য জেলার মতো বীরভূমে তেমন ঘটে না। তবে দুর্বল নদীপাড় ভেঙে এলাকা প্লাবিত হওয়া প্রায়ই হয় এই জেলায়। অজয়, হিংলো ময়ূরাক্ষী, ব্রাহ্মণী-সহ বেশ কয়েকটা বড় নদী ছাড়াও জেলায় আছে কুয়ে নদীও। সারা বছর নদীগুলিতে জল না থাকলেও বর্ষায় খাত ছাপিয়ে যায়। শুধু জেলায় ভারী বৃষ্টিপাত নয়, ঝাড়খণ্ড থেকে প্রবাহিত নদীগুলোও শুধু ওই রাজ্যের ভারী বৃষ্টিপাত হলেই উপচে উঠে। মাঝেমধ্যেই এলাকা ভাসিয়ে দেয়।

এবারে সেই কাজের টাকা এল, আর তা খরচ হবে রাজ্য জুড়ে নদী অববাহিকা অঞ্চলে, মানে এক্কেবারে গ্রামবাংলার উঠোনে। ‘নদী–বন্ধন’ নামে একটি নতুন প্রকল্পের আওতায় বাজেটে বিভিন্ন নদীর মধ্যে এবং নদী ও জলাভূমির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে সাধারণ মানুষের জন্য নানাবিধ জীবিকা তৈরি হবে যার জন্য এ জন্য বাজেটে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। নদী ভাঙন রোধে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের বাজেটে ৫০১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, এই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে বহু কথাবার্তা হত এবারে তার রূপায়ণের কাজ শুরু হল। মোদ্দা কথা হল হাতে তো টাকা যাচ্ছিলই, বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যেই তা আরও ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ তো চলছিলই, এবারে এমন কিছু নতুন প্রকল্প চালু করা হল যা আদতে গ্রামীণ মানুষজনের সরাসরি উপকারে লাগবে, রাজ্য জুড়ে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, আশা কর্মীদের এক বিরাট সমর্থন বেস মমতা পাবেন। হ্যাঁ এটাকেই বলে ওই সংসদীয় পদ্ধতিতে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা। আপনি দেড় দুই তিন লক্ষ মানুষ নিয়ে রাজপথের রাস্তা দখল করে রিক্লেইম দ্য নাইটের আন্দোলন চালাতেই পারেন, আপনি সেখানে উচ্চকিত ইন্টেলেকচুয়াল পথনাটিকা পেশ করে গা ঘামাতেই পারেন, কিন্তু নির্বাচনের সময়ে ফলাফল দেখে মুষড়ে পড়বেন না, গ্রামবাংলার মানুষ দীর্ঘদিন পরে তাদের প্রাপ্য পাচ্ছে, তাদের এই বরাদ্দ বাড়ানোর পরে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ৪ শতাংশ ডিএ বাড়িয়েছেন, বা ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পোদ্যোগ ও বস্ত্র খাতে ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে বরাদ্দ করেছেন ১,২২৮.৭৮ কোটি টাকা, উচ্চশিক্ষা খাতে ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে অনেকটা বেশি বরাদ্দ ৬,৫৯৩.৫৮ কোটি টাকার সংস্থান করার পরেও ডেট টু জিএসডিপি, মানে মোট সম্পদ আর ঋণের যে হার তা কমাতে পেরেছেন, এটা এক বড় ব্যাপার। অনেকেই এই বাজেটের সমালোচনা করতে গিয়ে ওই ঋণের ব্যাপারটা নিয়ে বলছেন, ভারত সরকারেরও ঋণ আছে, রাজ্য সরকারকেও উন্নয়নের বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য ধার নিতেই হবে, কিন্তু কথা হল সেই নেওয়া ধার আর সম্পদের রেশিওটা কেমন? বিহারের ১১.৬, রাজস্থানের ১২.৫, পঞ্জাবের ১৫.৮, এমনকী উত্তরপ্রদেশের ১ আর বাংলার মাইনাস ১। আমাদের শান্তিকুঞ্জের খোকাবাবু এসব বুঝবেন না, বোঝার কথাও নয়, ডে ওয়ান থেকে মমতা গ্রামের দিকেই নজর দিয়েছিলেন, এখন সেই গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরছেন, ২০২৬-এ সেটা টের পাবেন শান্তিকুঞ্জের খোকাবাবু।

Read More

Latest News