রামমন্দিরের পরে এবার মোদিমন্দির হবে, অন্য আর সব ঈশ্বরের পুত্রদের মতোই তিনি নিজেকে ঈশ্বরের পুত্র হিসেবেই ঘোষণা করেছেন। জানিয়েছেন, ঈশ্বরই তাঁকে দিয়ে এই কাজ, মানে এই মহিলা রিজার্ভেশন বিল পাশ করিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন। দেশের ৫০ শতাংশ মানুষের গড় রোজগার মাসে ৯ হাজার টাকা, সেটা বাড়ানোর জন্য ওঁকে ঈশ্বর দায়িত্ব দিচ্ছেন না। দেশের ৮০ কোটি মানুষ ফ্রি-তে র্যাশন না পেলে খেতে পাবেন না, তাঁদের মুখে অন্ন জোগানোর নির্দেশ ঈশ্বর মোদিজিকে দেননি। দেশের ২৫ বছর বয়সের তলার গ্র্যাজুয়েটদের ৪২ শতাংশের চাকরি জোটেনি, তাঁদের চাকরি দেওয়ার, তাঁদের রোজগারের বন্দোবস্ত করার নির্দেশ মোদিজি ঈশ্বরের কাছ থেকে পাননি। দেশ থেকে ৪৭ হাজার কোটি টাকা লুঠ করে ৩৩ জন ব্যবসায়ী, যাদের সিংহভাগ আবার গুজরাতি এবং যাদের অনেকেই মোদিজির সুপরিচিত, তাঁরা পালিয়ে গেছেন, ঈশ্বরের বরপুত্র এখনও তাঁদের ধরার নির্দেশ পাননি। ২০১৪-তে ক্ষমতায় এসেছেন, ২০১৬-তে যে জিডিপি আমাদের ছিল, তা ক্রমশঃ নেমেছে, এখনও ২০১৬-কে ছুঁতে পারেনি, এ ব্যাপারেও আমাদের ঈশ্বরের বরপুত্র কোনও নির্দেশ পাননি। এখনও মণিপুর জ্বলছে, হত্যা লুঠ চলছে, আমাদের স্বয়ম্ভু ঈশ্বরের বরপুত্র এখনও সেখানে যাওয়ার, তা নিয়ে কথা বলার সময় পাননি। কিন্তু সেই ঈশ্বরের বরপুত্র নির্দেশ পেলেন ওম্যান রিজার্ভেশন বিল পাশ করানোর। তো সেই বিল মাত্র দু’জনের বিরোধিতার পরে ৪৫৪ জনের সমর্থনে পাশ হয়ে গেল। অনেকদিন, বহু বহু বছর পরে বিরোধীরাও যথেষ্ট সংযম দেখিয়ে বিলের সপক্ষে ভোট দিলেন। এআইএমআইএম-এর আসাদউদ্দিন ওয়েইসি আর ওই দলেরই ইমতিয়াজ জলিল বিরোধিতা করলেন, তাঁদের বক্তব্য ছিল আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস এবং মুসলমান মহিলাদের জন্যও ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ওবিসিভুক্ত মহিলাদের সংরক্ষণের কথা রাহুল, সোনিয়াও গতকাল বলেছেন, যে বিষয়ে তাঁরা রাজি থাকলে ২০০৮-এই এই বিল পাশ হয়ে যেত। কিন্তু যাই হোক বেটার লেট দ্যান নেভার, বিরোধী দল এই বিল বিরোধিতার দায় নিতে চাননি, তাই বিলের পক্ষেই ভোট দিয়েছেন।
রাজ্যসভায় আজ বিল পেশ করা হয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবেই সেখানে কোনও বিরোধিতা ছাড়াই বিল পাশ হয়ে যাবে। তারপর রাষ্ট্রপতির কাছে বিল যাবে, বিলে সই করবেন রাষ্ট্রপতি, তারপর তা আইন। অর্থাৎ সেই আইন মেনে আমাদের সংসদ, লোকসভা, রাজ্যসভা, বিধানসভা, বিধান পরিষদ সর্বত্র ৩৩ শতাংশ রিজার্ভেশন লাগু হয়ে যাবে। এরকমটাই ভাবছেন তো? সাধারণভাবে তো মানুষ এটাই ভাববেন, আশা করবেন। কিন্তু পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত, কাহানি মে টুইস্ট হ্যায়। এখন লাগু হওয়া তো ছেড়েই দিন, ২০২৪-এর নির্বাচনে লাগু হওয়ার তো প্রশ্নই নেই, ২০২৯-এ কি লাগু হবে? নাকি তারপরে ২০৩৪-এ? নাকি তারও পরে লাগু হতে পারে এই বিল? এদিকে বিল পাশ হয়েছে ২০২৩-এ। বিলের মধ্যেই দেওয়া আছে বিলের মেয়াদ ১৫ বছরের, তাহলে ২০৩৮-এর পরে যে বিল লাগুই হল না, তা নিয়ে রিভিউ হবে? কেন? এত সংশয় কেন? ঈশ্বরের বরপুত্র কি আমাদের হাতে এক বিশুদ্ধ দিল্লি কা লাড্ডু ধরিয়ে দিলেন, যা খেলেও পস্তাতে হবে, না খেলেও পস্তাতে হবে? আসুন সেটা নিয়ে ক’টা কথা বলা যাক। প্রথম কথা হল এই বিলে রিজার্ভেশন কারা পাবেন? দুই নম্বর গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল কতটা পাবেন? তিন নম্বর প্রশ্ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কবে পাবেন? আসুন তিনটে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক। কারা পাবেন এই রিজার্ভেশন? এসসি এসটি, মানে সিডিউল কাস্ট, সিডিউল ট্রাইবের যে কোটা আছে, সেই কোটার মধ্যেও যেহেতু ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণ থাকবে তাহলে ধরেই নেওয়া যায় যে এসসি, এসটি-রা এই সংরক্ষণের লাভ পাবেন। এরপর কিন্তু সবটাই জেনারেল কোটা, মানে ওবিসি মহিলাদের জন্য এই বিলে কোনও সংরক্ষণ নেই। অর্থাৎ যে ৪-৫ শতাংশ উচ্চবর্ণের মহিলারা পড়াশুনোর সুযোগ পেয়েছিলেন, তাঁরাই আপাতত এই সংরক্ষণের সুবিধে পাবেন। যদি আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসের মহিলাদের জন্য আলাদা করে রিজার্ভেশন থাকত, তাহলে কিন্তু এক লপ্তে বহু পিছিয়ে পড়া মহিলারা এই সংরক্ষণের সুবিধে পেতেন। এবারেই তা হল না, মিলিয়ে নেবেন, এটা হতে বাধ্য, এই বিল আবার সংশোধিত হবেই, তখন এই পাপ শুধরে নেওয়া যাবে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মহিলা রিজার্ভেশন বিল এবং মোদিজির রাজনীতি
আর পেলেন না মুসলমানেরা, এটাও অত্যন্ত জরুরি ছিল, কারণ সেখানেও জমে আছে নিকষ কালো অন্ধকার, সেই অংশের প্রতিনিধিত্ব এলে সেই অন্ধকার অনেকটা কাটত। যে কারণে একজন মুসলমান ডাক্তার, লইয়ার, ইঞ্জিনিয়ার বা অধ্যাপক শিক্ষক হওয়াটা অনেক বেশি জরুরি, ঠিক তেমনই মুসলমান সমাজের মহিলাদের বিধানসভা, লোকসভাতে আসাটা জরুরি। কিন্তু আপাতত সেটা হল না। কিন্তু যা হল, তাই বা কম কীসের? কমবেশি ৫০ শতাংশ জনসংখ্যা কমবেশি ৩৩ শতাংশ অধিকার তো পেল, দরজা তো খুলে গেল। যে দরজা বহু আগেই ইউরোপ খুলেছে, বহু আগেই আমেরিকা খুলেছে, বিশ্বের বহু দেশেই মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ আছে, আমাদের দেশে ২৭ বছর আগে যে বীজ পোঁতা হয়েছিল, আজ তা স্বীকৃতি পেল, সে বীজ অচিরেই মহীরুহ হবে, তা বলা বাহুল্য। এবার প্রশ্ন কতটা পাবেন? সোজা হিসেবে তো ৫০ শতাংশ হওয়া উচিত, অর্ধেক আকাশের অধিকার তো স্বাভাবিকভাবেই প্রাপ্য, কিন্তু আপাতত ৩৩ শতাংশ সই। কিন্তু ৩৩ শতাংশও কি হবে? কারণ ওই উচ্চবর্ণের শিক্ষিতা মহিলাদের ভাগেদারিতে কিছুই বদলাবে না, সেন্ট স্টিফেন্স বা জেএনইউ-র পাশ করা উচ্চবিত্ত বা বিত্তশালী মহিলাদের রাজনীতিতে আসাটা আদত ছবিকে এতটুকুও বদলাবে না। যতই হাসুন, ওই রাবড়ি দেবীদের আসতে হবে, মমতা ব্যানার্জি, বীরবাহা হাঁসদা, সন্ধ্যারানী টুডুদের আসতে হবে, দ্রৌপদী মুর্মুকে আসতে হবে। সেটা কি সংরক্ষণ লাগু হলেই হবে? না, হবে না, যে কোনও সংরক্ষণের শুরুর লাভ বিত্তশালীরাই পায়, এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হবে না কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই ছবিটা বদলাবে। সাধারণভাবে উত্তর ভারতের গোটা প্রশাসনিক ব্যবস্থার দিকে চোখ রাখলেই সেটা বোঝা যাবে, ওবিসি, এসসি, এসটিদের উপস্থিতি উচ্চবর্ণের যা ইচ্ছে করব, এরকম ব্যাপারটাতে লাগাম দিয়েছে অনেকটাই। এখন ওবিসি একজনকে অত্যাচার করলে, একজন ওসি, একজন সাব ইনস্পেক্টর, একজন সরকারি কর্মচারী সামনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন, তা নিয়ে হইচই হচ্ছে, খবর হচ্ছে। কাজেই নারী সংরক্ষণ বিল লাগু হলেই ছবি হঠাৎ পাল্টাবে না বটে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ছবি বিলকুল বদলে যাবে।
এবারে লাখ টাকার প্রশ্ন কবে লাগু হবে? হ্যাঁ, এইখানে এসেই সব ব্যাপারটা ব্যাক টু স্কোয়্যার হয়ে যাবে। কবে যে লাগু হবে তা কিন্তু কেউ সঠিকভাবে বলতে পারবেন না। একটা কথা তো সাফ যে ২০২৪-এ লাগু হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? আইন পাশ হয়ে যাবে, রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেবেন, তারপরে লাগু না করার কী আছে? সরকার একটা লাগু করার সাধারণ আইন তৈরি করে দেবেন, যেটা একদিনেই করা সম্ভব, যেভাবে আপাতত মিউনিসিপালিটি, পঞ্চায়েতে রোটেশন অনুযায়ী সংরক্ষণ আছে, সেভাবেই বিধানসভা লোকসভাতে এটা লাগু করাই যায়, সমস্যা কোথায়? সামনের যে ৫ রাজ্যের নির্বাচন আছে, সেখান থেকেই এটা লাগু করা সম্ভব। কিন্তু না, হচ্ছে না, বিজেপি তার জন্য এক ব্যবস্থা করে রেখেছে। দুটো কথা বলা আছে এই বিলে। প্রথম হল জনগণনা হতে হবে, দু’ নম্বর শর্ত হল সেই জণগণনার ভিত্তিতে সংসদ বা বিধানসভার আসনের পুনর্বণ্টন, ডিলিমিটেশন করতে হবে। জনগণনায় কত সময় লাগে? বছর দুইয়ের কিছু কম। তার মানে ২০২৪-এ নির্বাচনের পরে নতুন সরকার জনগণনা করবে, তারপরে ২০২৬-এর মধ্যে সেই জনগণনার রিপোর্ট আসবে, তা নিয়ে ডিলিমিটেশন হবে। ডিলিমিটেশন করতে কত সময় লাগে? ২০১২তে ডিলিমিটেশন-এর সার্কুলার আসে, কমিটি তৈরি হয়, রিপোর্ট আসে ২০১৭-তে। মানে কমবেশি ৪ বছর। তার মানে জনগণনার রিপোর্ট আসবে ২০২৬ এ, ওই ২০২৬-এই যদি ডিলিমিটেশন কমিটি তৈরি হয়ে যায় তাহলে ২০৩০ নাগাদ ডিলিমিটেশনের রিপোর্ট আসবে। তার মানে ২০২৯-এর লোকসভা নির্বাচনেও ওই নারী আসন সংরক্ষণ বিল লাগু করা যাবে না। আপনি বলতেই পারেন, তাহলে ২০৩৪-এ? তাতেও সমস্যা আছে। প্রথম কথা হল ওই ডিলিমিটেশন নিয়ে অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকারে এক আইন পাশ করে বলা হয়েছে, এরপরের ডিলিমিটেশন ২০২৬-এর পরের যে জনগণনা হবে, তার ভিত্তিতে হবে। মানে ২০২৬-এর পরে জনগণনা করতে হবে, তা যদি ২০২৪-এ হয়, তাহলে তার ভিত্তিতে ডিলিমিটেশন হবে না। মানে তারপরের সেনসাস, ২০৩৪-এর জনগণনার পরে রিপোর্ট আসবে ২০৩৬-এ, তারপর ডিলিমিটেশন কমিটি বসবে এবং চার বছর পরে রিপোর্ট দেবে মানে ২০৪০-এ? এখানেও দুটো সমস্যা, এই বিল আনা হয়েছে ১৫ বছরের জন্য, মানে এর নির্ধারিত সময়সীমা ২০৩৮। দু’ নম্বর সমস্যা হল এবারে যখনই ডিলিমিটেশন হোক না কেন, তা বেশ জটিল হবে, কারণ উত্তর ভারতে জনসংখ্যা বেড়েছে, দক্ষিণে কমেছে, এবং কেবল জনসংখ্যার ভিত্তিতেই ডিলিমিটেশন হলে উত্তরপ্রদেশের সাংসদ সংখ্যা ৮০ থেকে বেড়ে ১১৫-১২০ হবে, বিহারের ৪০ থেকে বেড়ে ৫৩ হবে, তামিলনাড়ুর সাংসদ সংখ্যা ৩৯ থেকে কমে ২৮ হবে, বাংলার সাংসদ কমে ৩৭ হবে। এটা ওই রাজ্যগুলো মেনে নেবে? কাজেই যে ডিলিমিটেশনের কথা বলা হচ্ছে, তা ২০২৬-এই হোক বা ২০৩৬-এ, তা কিন্তু খুব সহজে মিটবে না। সব মিলিয়ে এই দুটো শর্ত জুড়ে দিয়ে আমাদের ঈশ্বরের বরপুত্র আমাদের দেশের মানুষের হাতে নির্ভেজাল দিল্লি কা লাড্ডু ধরিয়ে দিয়েছেন, যা খেলেও পস্তাতে হবে, না খেলেও পস্তাতে হবে।