গৌতম ভট্টাচার্য
কিরণ চৌধুরীর মোটা সেই ইতিহাস বই এখনকার স্কুল পাঠ্যে আছে কিনা জানি না। কিন্তু আমাদের প্রজন্মের ইতিহাসের প্রথম পাঠ । যেখানে বারবার থাকত দুটো পৃথিবীর কথা। বিশ্বযুদ্ধ পূর্ব। বিশ্বযুদ্ধ উত্তর। কোনো কোন চ্যাপ্টারের আরো পরিষ্কার ভাগ থাকত – প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পূর্ব ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ উত্তর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ব-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর। হিস্ট্রি পেপারের জন্য তৈরি হওয়ার সময় মোঘল সাম্রাজ্য আর সম্রাট অশোকের সময়কার কলিঙ্গর পাশাপাশি সেই শতাব্দীতে ঘটা বিশ্বযুদ্ধের টাইম লাইনগুলোও মাথায় রাখতে হত।
ইদানীং ক্রমাগত বদলে যেতে থাকা পৃথিবীতে বসে মনে হয় ,ইতিহাস বইটা সংশোধিত হয়ে আধুনিক সময়ের টাইমলাইনের সবচেয়ে বড় দিগনির্দেশ দেওয়া উচিত —প্রযুক্তি পূর্ব। প্রযুক্তি উত্তর। আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে জীবন্ত যুগ এই দুটোই !
নির্বাচনী বিশ্লেষণে যেমন প্রি এক্সিট পোল। পোস্ট এক্সিট পোল। ছিল কোথায় সদ্য প্রাচীন পৃথিবীতে ?
আমেরিকার প্রথম অভিজ্ঞতায় আসা যাক। ১৯৯০। ইউ এস ওপেন কভার করার ফাঁকে একদিন ইচ্ছে হল নিউইয়র্ক এলাম আর ম্যানহাটন দেখব না হয় নাকি ? অটল আত্মবিশ্বাস ছিল পাঁচবছর ধরে বিদেশ সফর করছি। বারদুয়েক ইংল্যান্ড ভ্রমণ হয়ে গিয়েছে। তো আমেরিকা কী এমন পরীক্ষা নেবে ? কে জানত সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত জায়গা থেকে আক্রমণ অপেক্ষা করে রয়েছে ? ম্যানহ্যাটন ঘোরার ফাঁকে হঠাৎ বাথরুম পেল। একটা মলে ঢুকলাম। টয়লেট কোথায় ? জানি বললেই দেখিয়ে দেবে। এ তো আর ফ্রান্স বা জার্মানি নয় যে লোকে ইংরেজি জানলেও বলবে না। আমেরিকা তো ইংরেজি ভাষাভাষিদের দেশ।
এবং তারা কেউ বলতে পারছে না টয়লেট কোথায় ? মনে রাখবেন চৌত্রিশ বছর আগের পৃথিবী। চিকেন টিক্কা কী বস্তু পশ্চিমি দেশ জানে না। বলিউড বিজ্ঞাপিত নয়। এত দক্ষিণ এশিয়তে ভরে যায়নি হাসতে মার্কিন মুলুক। যাদের দেখতে পাচ্ছি হয় সাহেব। নয় ঢ্যাঙা সব কৃষাঙ্গ। একটা লোক বলতে পারছে না টয়লেট কোথায় ? মল থেকে দৌড়তে দৌড়তে গেলাম পাশের হোটেলে। সেখানেও কেউ বলতে পারছে না টয়লেট ব্যাপারটা কী ? ছোট বাথরুম কিন্তু এক ঘন্টার বেশি চেপে থাকা কী দুঃসহ বুঝতেই পারছেন। জীবনে কখনো ভিনদেশে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে ভাবিনি। কেউ যদি বলে অমুক জায়গাটায় গেলে পাবেন তাহলেও ট্যাক্সি নিয়ে দৌড়োনো যায়। কিন্তু এরা তো ব্যাপারটাই বুঝতে পারছে না। নানা ভাবে বোঝাতে চাইছি। কখনো বলছি বাথরুম। কখনো বলছি লু। এমনিতে হোটেলের কোথায় টয়লেট থাকতে পারে মোটামুটি আন্দাজ করা যায়। কিন্তু সেদিন টেনশনে সেই বোধটাও চলে গেছিল। অনেক বোঝানোর পর একজন দেখিয়ে দিয়েছিল সেই দরজাটা যা আমার কাছে তখন স্বর্গ।
দু’সপ্তাহ পরে হিউস্টনে আমার এক বন্ধু দম্পতি হাসতে বলেছিল, আরো তো এদেশে আসবে। ফেরার সময় জেএফকে -র বুক শপ থেকে একটা চটি বই কিনে নিও। ব্রিটিশ ইংলিশের আমেরিকান ইউসেজ। টয়লেট বলে না এদেশে। বলে ওয়াশরুম। বা মেন্স। লেডিস।
টেনিস কভার করার সঙ্গে এই আমেরিকাকেও মনে মনে সমান্তরাল ভাবে কভার করছিলাম। যার সঙ্গে অন্য দেশগুলোর তুলনাই হয় না। এত বড় শহর নিউইয়র্ক যে লন্ডনকে যেভাবে টিউব দিয়ে সামলাতে পেরেছি এখানে সেই টেকনিক কাজ করছে না। খবরের কাগজের নিউজ স্ট্যান্ড নেই যেই স্থানীয় টেনিস স্টোরির খোঁজ পাব। নাইন ইলেভেন স্টোরস কনসেপ্টের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। নিউইয়র্ক উপকণ্ঠে যে আত্মীয়বাড়িতে উঠেছিলাম ,আশেপাশে তেমন কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। শুনলাম গ্যাস স্টেশনে কাগজ পাবো। গ্যাস ষ্টেশন ? জানলাম পেট্রল পাম্পকে এদেশে গ্যাস স্টেশন বলে।
আরও পড়ুন: আগামী মঙ্গলবার আমরা সবুজ আবির খেলব, নির্বাচনের শেষে ঘোষণা তৃণমূলের
বিলেতে টিভি খুললে বিবিসি বা চ্যানেল ফোর সবচেয়ে রদ্দি গেস্টহাউস মার্কা ফিচেল হোটেলেও আসতে দেখেছি। এখানে পে চ্যানেল। গৃহকত্রীর যদি এনবিসি স্পোর্টস সাবস্ক্রাইব করা না থাকে তাহলে পাওয়ার দূরতম সম্ভাবনাও নেই। উগ্র কনজুমারিজমের উপত্যকা যা আজকালকার যুগে নিতান্ত স্বাভাবিক । কিন্তু সেই সময়টা যে ইন্টারনেট পূর্ব পৃথিবী। ক্রীড়া -পর্যটক হিসেবে দিশেহারা হয়ে গেছিলাম তার ঝড় সামলাতে। কোথাও মনে হয়েছিল শহরের রিং টোন হওয়া উচিত ক্রেনের আওয়াজ। এই সভ্যতায় কবি থাকার কথা নয়। আলেন গিন্সবার্গ কী করে হলেন কলকাতা ফিরে সুনীলদাকে জিজ্ঞেস করব।
একে তো বাড়িগুলো বিশাল বিশাল সাইজের। তার আগে দুবাই -লন্ডন-ম্যাঞ্চেস্টার -করাচি এত শহর ঘোরা। কিন্তু স্কাইলাইন শব্দটা শহর ঘিরে অচেনা ছিল। শুধু তো বাড়ি না কফির কাপেরও স্কাইলাইন। রেগুলারটাই ইজিলি দুজনে খেতে পারে। আমার কলেজের বেস্ট ফ্রেন্ড এর মধ্যে কলম্বাস থেকে নিউইয়র্ক ন’ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে এল ওর ভাবী পাত্রী দেখতে। নিউইয়র্কের কুইন্স অঞ্চলে। আমিও গেলাম। রাত্তিরটা হোটেলে থাকবে। কিন্তু রাতে শোবে কী পরে ? ডিকি খোলার পর দেখা গেল সুটকেস উধাও। পার্কিংয়ের জায়গা থেকেই কেউ লক ভেঙে তুলে নিয়েছে । পুলিশ এসে গেল ঘটনাস্থলে। কোনো কিনারাই হল না। আশেপাশে জড় কিছু মুখ রায় দিল ওই আমেরিকান-আফ্রিকানদের কাজ নির্ঘাত। কিন্তু ওদের ঘাঁটি তো ব্রুকলিন। কুইন্স তো সচরাচর নিরাপদ থাকে। তখনি জানলাম নিউইয়র্কের যাবতীয় আভিজাত্যের আড়ালে লুকিয়ে কিছু বিপদসঙ্কুল এলাকা। যেখানে রাতে পর্যটকের অভিযান না করাই শ্রেয়।
রোহিত শর্মারা (Rohit Sharma) যে নিউইয়র্কে পৌঁছেছেন তা নতুন যুগের বিগ আপেল সিটি। নাইন-ইলেভেনের ধংসকাণ্ডের পর এই শহরের পুলিশ-প্রশাসন অনেক কড়া। রাস্তায় রাস্তায় সি সি টিভি। টুরিস্ট এলাকায় পুলিশের কড়া নজরদারি মধ্যরাতেও। কিন্তু কোথাও যেন এই দেশ প্রতিটি মুহূর্তে আপনার অনুভবে টেক্সট করবে ,সজাগ থাকো। মানিয়ে নাও আমাদের দেশের নীরব অনুশাসনের সঙ্গে। তুমি এসেছো পৃথিবী গ্রহ থেকে। কিন্তু এটা আমেরিকা গ্রহ।পৃথিবীর সংবিধান চলবেই এমন নিশ্চিন্তিতে থেক না। এখানকার আইন ঠিক করব আমরা আমেরিকানরা।
ঠিক এই দাদাগিরির মনোভাবটাই কোথাও যেন ক্রিকেট ঘিরে ঘটবে বলে মনে হচ্ছে।
আবার ফ্ল্যাশব্যাকে যাই। নব্বই দশকের মাঝামাঝি অফিসে বসে কাজ করছি। জগমোহন ডালমিয়ার (Jagmohan Dalmia) ফোন এল। বললেন আপনাকে কাল কল ব্যাক করা আর হয়ে ওঠেনি। অনেক রাত অবধি ফোনে ছিলাম। শুনলাম ভারতীয় বোর্ডের (Indian Cricket Board) সঙ্গে মিলেমিশে আইসিসি আমেরিকায় ক্রিকেট প্রসারে নামছে। দায়িত্ব পেয়েছেন আইএস বিন্দ্রা এবং আইসিসির এক সাহেব। লস আঞ্জেলিস থেকে শুরু হবে প্রজেক্ট। ডিজনিল্যান্ডের বাইরে বড় হোর্ডিং পড়বে ওয়াচ ব্রায়ান লারা উইথ মিকি মাউজ।
শুনে দারুণ লেগেছিল। মধ্য ইংল্যান্ডের হ্যাম্বলডন জাত ক্রিকেট সভ্যতাকে যদি আমেরিকার বুকে চালান করা যায় তার চেয়ে ভালো কিছু আর কী হতে পারে ? শুধু তো লারা নন। ক্রিকেটের মহাকাশে শচীন -আক্রম -ওয়ার্নের মতো মাহাতারারা আছেন। হলিউডের পাড়ায় ওঁরাও বিজ্ঞাপিত হবেন। ওই আমেরিকানদের দম্ভ অন্তত কিছু কমবে।
বছর দুয়েক কিছুই শোনা গেল না। কালক্রমে ডালমিয়া হলেন আইসিসির প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আমেরিকায় ক্রিকেটের প্রসার থেকে গেল অসমাপ্ত। একদিন বিরক্তভাবে বললেন , বিন্দ্রারা বলছে ওখান থেকে যথেষ্ট উৎসাহ না পাওয়া গেলে গুঁতিয়ে কতদূর করা সম্ভব ? কিছুদিন পর পরিত্যক্ত হয়ে গেল সেই প্রকল্প। ডালমিয়া-রাজে এমন ব্যর্থতার ইতিহাস হাতে গোনা।
আইসিসির (ICC) নতুন কর্তারা এমন সময় সেই ফাইল খোলার সুযোগ পেয়েছেন যখন আমেরিকা মহাদেশে দক্ষিণ এশীয় প্রতিপত্তি অনেক বেশি। যখন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের দৌলতে মেজর লিগ ক্রিকেট শুরু হয়ে গিয়েছে খোদ আমেরিকাতে। বিরাট কোহলির মতো ইন্টারনেট যুগের গ্লোবাল সুপারস্টার ব্যাট হতে নেমে পড়তে যাচ্ছেন ক্রিকেটের নতুন উপনিবেশ তৈরিতে। ভারত -পাক আগামী ৯ জুন নিউইয়র্ক শহরের সামান্য বাইরে নতুন যে স্টেডিয়ামে ম্যাচ খেলবে তা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে যেভাবে তৈরি হয়েছে , ময়দানবকে মনে করিয়ে দেবে। আমেরিকানদের পক্ষেই সম্ভব এত কম সময়ের মধ্যে আইসেনআওয়ার পার্কের কার পার্কিংয়ে ব্যবহৃত এলাকাতে ৩৪ হাজার আসনের স্টেডিয়াম বানিয়ে দেবে।
কিন্তু সেটা পেশাদার আমেরিকা। ব্যক্তি আমেরিকা জড়িত কোথায় ? টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের (T20 World Cup) মাত্র ১৬ ম্যাচ হচ্ছে এই মহাদেশে। শতকরা ৩৯ শতাংশ ম্যাচ। তা-ও অনুষ্ঠানকেন্দ্র তিন শহরে। ডালাস। নিউইয়র্ক। ফ্লোরিডা। আমেরিকাজুড়ে ম্যাচ কোথায় ? বিশেষ করে আরিজোনা , মিনেসোটা জাতীয় মুখ্যত আমেরিকান জনসংখ্যাবিশিষ্ট অঞ্চলে। সবাই জানে সাড়ে তেত্রিশ কোটি জনসংখ্যা বিশিষ্ট মহাদেশে স্পোর্টস বলতে বেসবল। বাস্কেটবল। আমেরিকান ফুটবল। বক্সিং। টেনিস। এবং ইদানীং সময়ে আমরা যাকে ফুটবল বলি সেই ফুটবল। এতগুলো খেলার যে কোনো একটা থেকে টি টোয়েন্টি ক্রিকেট মন সরিয়ে দিতে পারবে কি ? ললিত মোদিকেও বলতে শুনেছি টি টোয়েন্টি মার্কিন দেশে লড়াইয়ের সেরা অস্ত্র। তার সময়সীমা বেসবল ম্যাচের কাছাকাছি। তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা।
প্রশ্ন হল অসামান্য উদ্যোগে ৯০০ বিলিয়ন ডলার স্পোর্টসবাজারের কত অংশকে প্রভাবিত করা যাবে ? ম্যাডিসন এভিনিউ হল বিশ্বের বৃহত্তম বিজ্ঞাপন বাজার। তারা কি আকর্ষিত হবে বিরাট বা রোহিতের মোহে ? নাকি উপেক্ষা করবে দক্ষিণ এশীয়দের নিজেদের মেনুর উপমহাদেশীয় বিনোদন হিসেবে ? বিশ্বকাপ আজ শুরু হয়ে গেল। কিন্তু মার্কিন নামী দৈনিকে লেখা কোথায় ? ‘ নিউইয়র্ক টাইমস ‘ ,’ ওয়াশিংটন পোস্ট ‘। ‘এল এ টাইমস ‘ তো এখনো নির্বাক। হয়তো পাক-ভারত ম্যাচের আগে উঠে বসবে। কিন্তু একটা খেলার বিশ্বকাপ হচ্ছে অথচ কোনো রেখাপাত নেই দেশের কাগজ বা ডিজিটালে। বিস্ময়কর। নয় কি ? স্পনসররাও তো বেশির ভাগ ভারতীয় বাজারে প্রাসঙ্গিক।
নাকি আমেরিকানরা তখনই কোনো খেলায় উৎসাহী হবে যখন তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে ? কন্ট্রোল ফ্রিক বলে তাদের বদনামটা এতটুকু অযৌক্তিক নয়। অলরেডি শোনা যাচ্ছে ফুটবল নিজের দেশে প্রকৃত স্থাপনের জন্য মার্কিনিরা ফিফাতে ঢোকার তোড়জোড় করছে। কেউ কেউ বলছেন আইসিসিতে যতক্ষণ না মার্কিনিরা জোরকদমে ঢুকবে , ততদিন নিজভূমিতে ক্রিকেটের প্রসারে তারা আগ্রহী হবে না। আর আইসিসিতে মার্কিন আধিপত্য বাড়ার পরিস্থিতি তৈরি হওয়া মানে ভারতের প্রশাসনিক গ্রহণ। আদৌ সেদিকে কখনও পরিস্থিতি যাবে?
এখনকার মতো অবশ্য এতদূরে যাওয়ার আগে অন্য ম্যাচ। মার্কিন উপনিবেশে ক্রিকেটের ঠিকঠাক উৎক্ষেপণ হবে ? নাকি ফুলকি হয়েই নিভে যাবে ? বিশ্বকাপের আসল টি টোয়েন্টি ফাইনালের স্কোরবোর্ড মনে রাখবেন টুর্নামেন্ট শেষ হলে দেখা যাবে।