গৌতম ভট্টাচার্য
কেকেআর (Kolkata Knight Riders) টিমের ম্যাচ শেষে উচ্ছসিত পদচারণা থেকে চোখটা ছিটকে বারবার মুম্বইতে স্টার স্পোর্টস ষ্টুডিওয় চলে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এমনও হয় ? এ তো চোখের সামনে ঘটতে দেখা সিনেমা।
ছয় মাস আগের কথা। বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল কমেন্ট্রি করার ফাঁকে তখন ঊর্মি বিল্ডিংয়ের সাততলায় কফি আনতে গেছি। দেখি পাশের ঘর থেকে কে ডাকছে। দেখা গেল গৌতম গম্ভীর (Gautam Gambhir)। অন্তরঙ্গতা না থাকলেও অতীতে ওঁর সঙ্গে ভারতের কোনো কোনো মহানায়ক নিয়ে অফ দ্য রেকর্ড আলোচনা হয়েছে। আর আইপিএল চলাকালীন দুই গৌতমে মাঝেমধ্যে টেক্সট হতেই থাকে। গম্ভীর লখনউতে থাকার সময়ও আলোচনার বিষয় থাকত কেকেআর। আমিই প্রসঙ্গটা তুলতাম।
সেদিন প্রথম নিজে থেকে বিষয়টা তুললেন– দাদা, কে কে আরের খবর কী ? বললাম খুব খারাপ অবস্থা। একে তো টিম ভাল খেলেছে না। তার ওপর কোচিং স্টাফে টেনশন। এরপর এমন একজনের প্রসঙ্গ উঠল যিনি আমার মতে টিমের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গোলমেলে হয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী। বললাম আপনি তো সবই জানেন যে ডাগআউটের প্রব্লেমটা কোথায় হচ্ছে ? জিজি মাথা নাড়লেন।
তখনও আমি দাঁড়িয়ে। গম্ভীর বললেন বসুন না। বড় রিপোর্টার তখনই জাজ করে নিত অন্তরালে নিশ্চয়ই কিছু পাকছে। নইলে এত এত উৎসাহ দেখাবে কেন ? কিন্তু আমি ভাবিনি কারণ সঞ্জীব গোয়েঙ্কার সঙ্গে গভীর পারিবারিক বন্ধুত্বের কথা জানতাম। কেকেআরে থাকাকালীনও বহুদিন আলিপুরের গোয়েঙ্কানিবাসে ডিনারে গিয়েছেন। তিনি টানা দু’বার প্লে অফে তোলা লখনউ টিম ছেড়ে আসতে পারেন ,মাথাতেই আসেনি।
আমাদের আলোচনা আরও চলত কিন্তু ঘরে হঠাৎ অনিল কুম্বলে ঢুকে পড়লেন আর গম্ভীর চুপ করে গেলেন। তখনও বোঝা উচিত ছিল যে নিছক ফ্রাঞ্চাইজির প্রাক্তন ক্যাপ্টেন আর সেই শহরের সাংবাদিকের মধ্যে ক্রিকেটগসিপ চলছিল না। নইলে বন্ধ হয়ে অন্য প্রসঙ্গে যাবে কেন ?
পাঁচদিন বাদে জানলাম হাতের কাছে এসেও কত বড় স্টোরি মিস। যেদিন স্টার অফিসে দেখা — ঠিক তার আগের রাতেই নাকি শাহরুখ প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন।
মোটেও সহজ ছিল না গম্ভীরের কাজ। তাঁকে একই সঙ্গে হতে হয়েছে ‘পাঠান ‘ এবং ‘ জওয়ান ‘। কোচিং ইউনিট খুব শক্তিশালী তাঁর। কিন্তু সেই তিন আবার তিন বিভিন্ন দিকের অনুসারী। পণ্ডিত একরকম। ভরত অরুণ একরকম। আবার সিইও-র বিশেষ প্রিয় অভিষেক নায়ার আর
একমুখী। এঁদের এক সুতোয় প্রথম বাঁধতে হয়েছে। তার পর তো টিম।
প্রথমে বিদেশিরা। যাঁরা পন্ডিতি অনুশাসনে একেবারেই স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করছিলেন না। বিদেশী প্লেয়ারদের ডিল করার ধরণ অবশ্যই আলাদা যা দেশজ টুর্নামেন্টে শ্রেষ্ঠ কোচেরও আয়ত্তে আনা এক নতুন চ্যালেঞ্জ। যার সামনে হাঁসফাঁস করছিলেন পণ্ডিত।
গম্ভীর আসাতে নারিন -রাসেলরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। নইলে কেউ কেউ ভেবেছিলেন গোটা টুর্নামেন্টে গতবার যে সাকুল্যে ২১ রান করেছে। আর বোলিংয়েও আগের চেহারায় নেই তাকে ধরে রেখে কী লাভ ? বরঞ্চ নিলামে ছেড়ে দেওয়া হোক। আজ্ঞে হ্যাঁ, নারিনের গতবছর মোট রান ছিল ২১। তার আগের বছর ৬২। তারও আগের বছর ৭১। গতবছরের সর্বোচ্চ রান ৭। বোলিংয়ে গতবছর ১১ উইকেট। তার আগের বছর ৯। এককালে ইকোনোমি থাকত ৫-৬। সেটা বাড়তে বাড়তে বিপজ্জনক মাত্রায় চলে যাচ্ছিল।
সেই একই লোক এবারে ৪৮৮ রান করেছেন। নিয়েছেন ১৭ উইকেট। দুটো ম্যাচ বৃষ্টিতে পন্ড না হলে হিসেব আরো হীরকখচিত দেখাত।
কী ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা হবে ? এ তো ম্যাজিক। আর ক্রিকেট অলিন্দে সবাই জানে ক্রিকেট -ম্যাজিকের আসল নাম কুশলী ম্যান ম্যানেজমেন্ট।
প্রাক -গম্ভীর গত ক’বছর কেকেআর ছিল দেশীবিদেশি কিছু সুগন্ধি মুখ। আসোর্টেড পেস্ট্রির মতন । জিজি সেগুলো জড় করে একটা ফাইভ ইন ওয়ান কেকের রূপ দিয়েছেন। উপাদানগুলো হাতের কাছেই ছিল। কিন্তু কোনো ওস্তাদ শেফ ছিল না যে সেগুলোকে ঠিকঠাক একত্রিত করে।
যেমন ছোট ছোট পারফর্মেন্সগুলোকে মান্যতা দেওয়া। ক্রিকেটজীবনে স্বার্থপর প্লেয়ারদের বরাবর ঘৃণা করে এসেছেন যারা নিজস্ব রান আর এভারেজের জন্য খেলে। ক্যাপ্টেন থাকার সময় যেমন টিমের জন্য করা ৭ বলে ২০ কে ৪৪ বলে ৬২- র চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এখানেও তাই। তারকা কক্ষপথের বাইরে আংরিশ রঘুবংশী বা হর্ষিত রানাকে তৈরি করেছেন। যারা টিমের জন্য জান বাজি লাগিয়ে দেবে। পাশাপাশি জনতার দাবিতেও রিঙ্কু সিংকে কিছুতেই তিন বা চারে তুলতে চাননি। সে তিনি যতই মহাতারকা হয়ে যান। টিমের জন্য রিংকু সিংয়ের এলাকা নির্দিষ্ট করেছিলেন ১৪-২০। তার আগে কিছুতেই নয়। তাতে লোকে গোঁয়ার বললে বলুক। রিংকু গতবছর ৪৭৪ করেছিলেন। এবার এত সুযোগ না পেয়ে মোট ১৬৮। কিন্তু গম্ভীরের কিছু আসে যায়নি। গতবছর আর এবার রিংকুর স্ট্রাইক রেট মোটামুটি এক আছে। দেড়শোর কাছে। টিমের তো সেটাই চাই।
ব্যক্তিগত মহিমা নয়। দলের জন্য কে কত বেশি এবং কীভাবে কাজে আসছে ? বেস্ট এক্সাম্পল রমনদীপ। মোট রান মাত্র ১২৫। কিন্তু এসেছে দুশোর ওপর স্ট্রাইক রেটে। তার ওপর দুরন্ত ক্যাচিং। রঘুবংশী মোট রানে ১৬৩। কিন্তু স্ট্রাইক রেট যে ১৫৫।
মেন্টরের যাবতীয় কারিগরির পরেও ভাগ্যের একটা পর্যাপ্ত বাইশ গজ খোলা থাকে। যা এতকাল পাননি গম্ভীর দুটো বিশ্বকাপ ফাইনালের ম্যাচ জেতানো হায়েস্ট স্কোরার আর দু’বার আইপিএল জয়ী ক্যাপ্টেন হয়েও। এই প্রথম ধোনি – লাক তাঁর জন্য হাজির হয়ে গেল। ধোনি-লাক কাউকে খাটো করে দেখানোর জন্য নয়। ধোনি ভারতীয় ক্রিকেটে অনন্য। সাদা বলের পৃথিবীতে সর্বকালের সেরা অধিনায়ক। কিন্তু পরিস্থিতির আদিদৈবিক সাহায্য তাঁর শৃঙ্গশিখর জয়কে এত রাজসিক করেছে। ২০০৭ এ মিসবা-র স্কুপ আর দু হাত ওপর দিয়ে গেলে তিনি বিশ্বসেরা মুকুট পান না। ২০১৩ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ে ব্যাট হাতে তাঁর কোনো ভূমিকা নেই। ২০১১ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে করেন ২০। সেদিনই টুর্নামেন্টের বাইরে চলে যেতে পারতেন আফ্রিদিরা চোখ না করলে। গোটা টুর্নামেন্টে তার আগে ধোনির সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ৩৪। আমেদাবাদের কোর্য়াটার ফাইনালে যখন ৭ রানে আউট হয়ে গেলেন তখন ভারত হারের মুখে। প্রেস বক্স জুড়ে আলোচনা চলছিল এই ক্যাপ্টেন সরাও। একটা ম্যাচেও রান করল না। সেই হারা ম্যাচ বাঁচিয়ে দেয় যুবরাজ-রায়না পার্টনারশিপ। নইলে ওয়াংখেড়ের অমর ইনিংস আর ওই চিরকালীন ছক্কাটা হয় না।
তিরাশির বিশ্বকাপ যে অর্থে ব্যাট-বলে পারফর্মেন্স এবং অধিনায়কত্ব দুই মিলিয়ে একান্ত কপিলের। এগারো মোটেও ধোনির না। গম্ভীরদের এখানেই চিরকালীন অভিমান যে আমি-সচিন-যুবরাজ-শেহবাগ সবাই তোমার চেয়ে অনেক বেশি রান করেছি । ভারতকে বারবার জিতিয়েছি । অথচ একটা ইনিংসে তুমি ঈশ্বর বনে গেলে। সেখানেও আমি তোমার চেয়ে বেশি রান করে প্রচার পাইনি। লোকে তোমার ৯১ মনে রেখেছে। অব্যর্থ ম্যাচ হার থেকে টেনে আনা আমার ৯৭ নয়।
আবার বলা যাক এবারে সেই ধোনি-লাক জীবনে প্রথম পেলেন গম্ভীর। আধ ডজন সহায়তা।
এক, প্রবল প্রতিপক্ষ সিএসকে গতবারের সোনার টিম পায়নি। ব্যাটে সেরা এবং ৬৭২ রানকারী ডেভন কনওয়ে-র চোট ছিল। বোলিংয়ে মাথিসা পাথিরানা-রও তাই। শ্রীলংকান ছোট মালিঙ্গা গতবার ১৯ উইকেট নিয়েছিলেন । এবার হাফ ফিটনেসে কোনোরকমে ৬ ম্যাচ খেলেন।
দুই ,মুম্বই —যারা কিনা ঐতিহাসিকভাবে কেকেআরের সবচেয়ে বড় গাঁট। তারা বিঘ্নিত ছিল অন্তর্দ্বন্দ্বে।
তিন ,জেসন রয়ের আচমকা অনুপস্থিতি ফিল সল্টকে হাতে এনে দেয়। যা হিসেবে ছিল না। জেসনের আইপিএল স্ট্রাইক রেট ১২৯। সল্ট সেখানে পাওয়ার প্লে-তে ১৮৩। তফাৎটা ভাবুন !
চার ,রাসেলের মরশুম জুড়ে দুর্দান্ত ফিটনেস। যা নিয়ে সন্দেহ মোছাতে কেকেআর গতবছর ডালাসের হাই পারফরমেন্স সেন্টার থেকে ট্রেনিং করিয়ে এনেছিল তাঁকে। তবু ফিট করা যায়নি। বল করতে গিয়ে পড়ে গিয়েছেন। এবার উন্নতিতর ফিটনেসে ১৯ উইকেট এবং কেকেআরের ট্রফি জেতার অন্যতম ফ্যাক্টর। রাসেলের এমন ফিটনেস গতবছর পণ্ডিত পেলেও টিম চ্যাম্পিয়ন হত না। কিন্তু প্লে অফ অন্তত যেত।
পাঁচ ,কামিন্স গোটা টুর্নামেন্ট দুর্দান্ত নেতৃত্ব দেওয়ার পর ফাইনালে এসে টসের মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত।
ছয় ,স্টার্কের টুর্নামেন্টের একেবারে শেষ দিকে নাটকীয়ভাবে ছন্দে ফেরা। মাঝে গম্ভীর অসির বোলিং নিয়ে এত বিরক্ত ছিলেন যে এক ম্যাচ বসিয়েও দিয়েছিলেন । অনেক ম্যাচে স্টার্ককে ফোর্থ ওভার না দিয়ে ভারতীয় পেসার বল করেছেন। একটা ম্যাচে নতুন বল দেওয়া হয়নি। কে জানত এমন অত্যাশ্চর্য রূপান্তর ঘটবে তাঁর শেষ দুই ম্যাচে ? যেখানে বিপক্ষের রকেট উৎক্ষেপণকেন্দ্র ব্যাটিং পাওয়ার প্লে -তেই আগুন ধরিয়ে দেবেন স্টার্ক ? আইপিএলে পাশে রাখার মতো নমুনা যদি বা থাকে এইমুহূর্তে মাথায় আসছে না।
কেমন যেন মনে হয় কেকেআর মেন্টরের জন্য পারিপার্শ্বিক ল্যাপ টপ নিয়ে তৈরিই ছিল। এক্সেল শিটে শুধু নম্বরগুলো বসিয়ে দিয়েছে। কী বৈপরীত্য ! ভাগ্যের চকমকি পাথরের এতকাল বিচ্ছুরণ হয়নি বলেই গম্ভীর থেকে গিয়েছেন ওটিটি হিরো। প্রয়োজনীয় কিন্তু গ্ল্যামারাস নয়। দুরন্ত পারফর্মার কিন্তু কোথাও গিয়ে সুপারস্টারডম নেই। খানরা নন। বচ্চন নন। রণবীর সিং-ও না। স্রেফ পঙ্কজ ত্রিপাঠি।
কিন্তু আজকের দিনে ওটিটি হিরোরাই সর্বক্ষণ মানুষের মনে লেপ্টে থাকে। সে আর বাউন্ডুলে ঘুড়ি নয়। একেবারে বেড রুমের বাসিন্দা। তাই প্রচুর টাকা কমায়। ধোনির সঙ্গে সেরা বিজ্ঞাপনে তথাকথিত তারকার আগে ডাক পায়। সিকিউরিটি নিয়ে চলতে বাধ্য হয়। এইটিথ্রি ফিল্মে নায়কের পরে সবচেয়ে শক্তিশালি চরিত্রে কাজ করে। গম্ভীর সেই লোকের ক্রিকেটীয় প্রোটোটাইপ।
এতবছর বাদে এবার সুপারহিরোদের টক্কর দেওয়ার রেজিস্ট্রেশন পেলেন। মাত্র ৫৮ টেস্ট তাঁর প্রাপ্য ছিল না। ১৪৭ ওয়ান ডে -ও না। ধোনির অধীনে এত বছর খেলেও অশ্বিন মনে করেন , টি টোয়েন্টিতে তাঁর দেখা সেরা অধিনায়ক গম্ভীর। কিন্তু সুযোগ কোথায় পেলেন ?
এবার হয়তো গোলাকৃতি পৃথিবীর ভাগ্যের মুখ তাঁর জন্য বদলাচ্ছে। নইলে জয় শাহ এমন গদগদ মুখে ম্যাচের পর সবাইকে ছেড়ে জিজি-র জন্য এত সময় ব্যয় করবেন কেন ? এখন তো চরম সিদ্ধান্তের মুখে গম্ভীর । ক্লাব না দেশ ? দু পক্ষই প্রবল আকুতির সঙ্গে চায়। কজন ম্যানেজারের এমন ভাগ্য হয় ?
বিনোদনের পৃথিবী অনেকটাই গ্রাস করে ফেলেছে ওটিটি। ড্রয়িং রুমে তা আর আটকে নেই। তিনি গম্ভীরও চিপকের সর্বাত্মক বিজয়ের পর এখন ভারতীয় ক্রিকেটের বেডরুমে।
এই প্রোমোশন সহজে যাওয়ার নয় !