পুঁজিবাদী অর্থনীতি আর সমাজের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য হল, যা বেচে পয়সা আসে তাই বিক্রি করা। নীতি, নৈতিকতা, সত্য, মিথ্যে, আদর্শ, মতবাদ, ছাইপাশ যা খুশি হোক, বেচে পয়সা আসছে কি? তাহলে বেচো, আসছে না? ফেলে দাও। অর্থাৎ মন, শরীর, জল, হাওয়া, বন, জঙ্গল, প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় যা কিছু বেচে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল পুঁজির উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে। পুঁজি অর্থনীতি যত বেড়েছে, যত ছড়িয়েছে তত বেশি বেড়েছে এই সবকিছু বেচে লাভ করার, মুনাফা কামানোর প্রবণতা। ১ কিলো মায়া, ৩ কিলো দুঃখ, ৬ কিলো ভালোবাসা? বিক্রি করা গেলে বেচে দাও। দেশ বেচে দাও, দেশের মানুষ বেচে দাও, স্বাধীনতা দিবস আসছে, প্লাস্টিকের তেরঙা তৈরি করো, বেচে দাও মুনাফা হবে, গণতন্ত্র দিবসে তেরঙা পতাকার চেন, দারুণ বিক্রি হবে, বেচে দাও। চাই কি ভগৎ সিংয়ের, ক্ষুদিরামের ছবিওলা ব্যাজ, বেচে দাও। সেরকম বিক্রির তালিকায় রবীন্দ্রনাথ আছেন, ২৫ বৈশাখ আর ২২ শ্রাবণ। বছরের অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ দাড়িওলা আলখাল্লা পরা বুড়ো এক মানুষ, আছেন বিবেকানন্দ, মাটির মূর্তি থেকে ব্যাজ, জন্মদিনে ভালো বিক্রি হয়। সেই বিক্রি হওয়ার তালিকার শীর্ষে আছেন নেতাজি সুভাষ বসু, ওনাদের চেয়ে ঢের ঢের বেশি, কারণ তাঁর জীবন রোমাঞ্চকর, এক বিপ্লবীর জীবন, তাঁর মৃত্যু রহস্যে ঘেরা। অতএব তা নিয়ে ব্যবসা জমবে ভালো। রোজ তাঁকে বাঁচিয়ে তোলো, কখনও শৈলমারিতে। কখনও অযোধ্যায়, কখনও আশ্রমের এক সাধু, কখনও গুমনামি এক বাবা যিনি লুকিয়ে আছেন মানুষের সামনেও আসেন না, তাঁকে নিয়ে বই লেখো, অজানা তথ্যের নামে ভূরি ভূরি মিথ্যে লিখে যাও, আজগুবি তথ্য মানুষ গেলে ভালো। কনস্পিরেসি থিওরির বাজার বরাবরই আছে, তাকে নিয়ে সিনেমায় সেই আজগুবি তথ্য তুলে ধরো, তারপর ধর্মতলায় তাঁর স্ট্যাচুর তলে সেলফি তুলে পোস্ট করো, লাইক পড়বে, সিনেমার টিকিট বিক্রি হবে। সিনেমা শেষ, এবার অন্য কোনও সিনেমা, ধর্মতলায় ওনার স্ট্যাচুর তলায় পরিচালক নায়কের সেলফির আর দরকার নেই, প্রয়োজন মিটে গেছে।
একেই বলে বাজার অর্থনীতি যেখানে নারী মাংস আর নেতাজি বেঁচে আছেন, একই সঙ্গে বিক্রি হয়। এ পর্যন্ত তো জানাই আছে, আমাদের দেশে নয় পৃথিবী জুড়েই পুঁজির এই চরিত্র, ক্রমশ সবাই জেনে ফেলেছে। সমস্যাটা অন্য জায়গায়, কেবল টাকা নয়, কেবল পুঁজির মুনাফার জন্যই নয়, রাজনৈতিক মুনাফার জন্যও, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যও, বিরোধী রাজনীতিকে পরাস্ত করার জন্যও, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে ব্যবহার করা হচ্ছে, তিনি বেঁচে থাকলে যে বিশ্বাসঘাতকেরা গর্তে লুকিয়ে থাকত, যারা একটা কথাও বলতে পারত না, তারা নেতাজির নামে এক ভয়ঙ্কর রাজনীতি করে যাচ্ছে, অশিক্ষা আর কুশিক্ষা নিয়ে আমার দেশের মানুষ সেই প্রচারের শিকার, আজ তা নিয়েই দু’ চারটে কথা। এতবড় এক সম্পদ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, তার মালিকানা নিয়ে বিরাট লড়াই, কে সহি মালিক, তাই নিয়ে কাজিয়া। স্বাধীনতার পরে দেশে তিন ধারার রাজনীতি চলছিল, বহুবার বলেছি, আবারও বলি। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া দেশের, স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা কংগ্রেস ছিল প্রথম এবং সবথেকে শক্তিশালী ধারা। দ্বিতীয় ছিল কমিউনিস্টরা, যারা ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় বলার পরে ফিরে এল জাতীয় রাজনীতিতে, কেন সে আজাদি ঝুটা নয়? এই আজাদির গুরুত্ব কোথায়? সেসব আলোচনা আর মীমাংসা কি তাঁরা করলেন? না করেননি, বলেননি ওই স্লোগানে কোথায় ভুল ছিল, তাও বলেননি, কেবল কমিউনিস্ট পার্টির উপর থেকে ব্যান তুলে নেওয়া হল, তাঁরা ফিরে এলেন, অমীমাংসিতই রয়ে গেল যবতীয় প্রশ্ন। সেই কারণেই তাঁদের দেখা যায়নি ১৫ অগাস্ট তেরঙা ওড়াতে, ২৬ জানুয়ারি গণতন্ত্র দিবস পালন করতে, অর্থাৎ সব প্রশ্নই এক কৌশলের আড়ালে রয়ে গেল। ওন্যদিকে আরএসএস জনসঙ্ঘ, তারাও এই সংবিধানকে মানেনি, জাতীয় পতাকাকে মানেনি। তাদের কাছে এই স্বাধীনতার কোনও মূল্যই ছিল না, তারা স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণও করেনি, অতএব গান্ধী হত্যায় অংশ নিয়েছে, নাগপুরে সদর কার্যালয়ে পতাকা তোলেনি।
এ তো গেল স্বাধীনতার প্রশ্ন, কিন্তু নেতাজি? লালকেল্লায় যখন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির বিচার চলছে, তখন জওহরলাল নেহরু শামলা পরে, আইএনএর যুদ্ধাপরাধীদের হয়ে সওয়াল করেছেন, তাদের লড়াইকে স্বাধীনতার আন্দোলন বলেছেন। কিন্তু এই পর্যন্তই, নেহরু যে দৃষ্টিকোণ থেকে সুভাষকে দেখতেন, কংগ্রেসের অন্য নেতারা তো সেই চোখে দেখতেন না। কংগ্রেস দলেও এ নিয়ে কোনও আলোচনা বা তার মীমাংসা হয়নি, কিন্তু নেতাজির বিরোধিতাও হয়নি, তার কারণ নেতাজির জনপ্রিয়তা। নেতাজি তৈরি করেছিলেন নেহরু ব্রিগেড, গান্ধী ব্রিগেড। স্বাধীন ভারতবর্ষে দেশের সৈন্যবাহিনীতে কোনও সুভাষ ব্রিগেড তো হয়নি, মানে সেখানেও ছিল অবহেলা। যদিও সারা দেশের প্রত্যেক প্রান্তে, নেতাজির নামে রাস্তা হয়েছে, মূর্তি বসেছে, কংগ্রেসি নেতারা সেসব মূর্তিতে মালা দিয়েছেন, কেউ দাবি তোলেননি যে আমাদের কারেন্সিতে সুভাষ বসুর মুখ রাখা হোক, গান্ধীও থাকুক, সুভাষও থাকুক। না হয়নি। কমিউনিস্টরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেতাজিকে কুইসিলিং, বিশ্বাসঘাতক বলেছেন, তাঁর দেশপ্রেমকে অস্বীকার করেছেন, এটাও ইতিহাস, বহু পরে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, আমাদের মূল্যায়ন ভুল ছিল। কিন্তু কোনও পার্টি কংগ্রেসে প্রস্তাব এনে সেই ভুল স্বীকার বা সংশোধন তো করা হয়নি, এটাও ইতিহাস। আরএসএস জনসঙ্ঘের সঙ্গে নেতাজির আদর্শগত ফারাক এতটাই ছিল যে, তারা কোনওদিন নেতাজি নিয়ে কথাই বলেনি। সবচেয়ে বড় কথা হল, সেদিনের আরএসএস জনসঙ্ঘ নেতারা ইতিহাস জানতেন, নেতাজির অবস্থান জানতেন। তাঁরা জানতেন নেতাজির রাজনৈতিক, সামাজিক চিন্তাভাবনা, এক ১০০ শতাংশ অসাম্প্রদায়িক মানুষকে নিয়ে নাচানাচি করার কোনও কারণ তাঁদের ছিল না, করেনওনি।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | আরজি কর মামলা— ডাক্তারবাবুদের মিথ্যে প্রচারের ফানুস ফুটো হয়ে গেছে
তারপর বহু বছর পার হয়ে গেছে, মাঝে নেতাজির ১০০ বছর মানে জন্মশতবার্ষিকী ঢাকঢোল পিটিয়ে পালন করা হয়েছে। আর প্রায় সেই সময় থেকেই নেতাজি যে এক সম্পদ, তাঁকে ভাঙিয়েও যে রাজনীতি করা যায়, এটা সবাই বুঝতে পেরেছেন। কাজেই প্রায় ওই সময় থেকেই এক কদর্য খেলা শুরু হয়েছে, যে খেলার নাটের গুরু আরএসএস–বিজেপি। নেতাজি মৃত, কাজেই নেতাজি নয়, তাদের রাজনীতি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে, এবং আজকের আরএসএস–বিজেপি নেতাদের কাছে আছে হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি, যেখানে অনর্গল মিথ্যে বলা যায়, এমন মিথ্যে যা মানুষের কাছে ছড়িয়ে যাবে, নিরক্ষরতা আর অশিক্ষা তো আছেই, তাকেই সম্বল করে তারা মাঠে নেমেছে। নেতাজি কী বলেছেন, নেতাজি কী করেছেন? নেতাজির সেই অজস্র লেখা, নেতাজির সেই বীরত্বের, দেশপ্রেমের ইতিহাস ক’জনই বা পড়েছেন? সেই সুযোগটাই নিয়েছে আরএসএস–বিজেপি। আজ নেতাজির জন্মদিন। আবিদ হাসান নেতাজির সহযোগী ছিলেন, যিনি নেতাজির সঙ্গে জার্মানি থেকে জাপান সাবমেরিনে এসেছিলেন, এই দুর্গম যাত্রার একমাত্র ভারতীয় সঙ্গী। তিনি সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন একবার এক সর্বধর্ম প্রার্থনা সভার আয়োজন করেছিলেন, নেতাজির আসার কথা ছিল, পরিদর্শনে। তিনি এলেন। সব ধর্মের সেনারা তাঁদের ধর্ম অনুযায়ী প্রার্থনা করলেন, নেতাজি চলে গেলেন। নেতাজি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কথা বলতেন, আবিদ ভেবেছিলেন, এই প্রার্থনা দেখে নেতাজি নিশ্চয়ই খুশি হবেন। পরে নেতাজি তাঁকে ডেকে বলেছিলেন রাজনীতি ও ধর্ম কখনও মিশিও না, এমনকী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্যও নয়। তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের স্যালুটেশন করেছিলেন জয় হিন্দ, একে অন্যের সঙ্গে দেখা হলে তারা বলত নমস্কার বা আদাব নয়, বলত জয় হিন্দ। আমাদের মোদিজি তো নানান রূপে আবির্ভূত হন, কখনও চাওলা, কখনও চৌকিদার, তো ওনার আর একটা ছবি পাওয়া যায়, আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের পোশাক পরে, নিজেকে তিনি নেতাজির উত্তরাধিকারীও বলেছেন ক’বার, তাঁরই আদর্শে নাকি মোদিজি চলছেন।
মোদিজির আর এক গুরুদেব হলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এই শ্যামাপ্রসাদ তাঁর ডায়রিতে লিখে গেছেন যে হিন্দু মহাসভা নিয়ে রাজনীতি করতে এলে নেতাজি তাঁর হাত-পা ভেঙে দেবেন এমন কথাও বলেছেন। তার ক’দিন পরেই এক জায়গায় এরকম হিন্দুত্ববাদী বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন, সেখানে ঢিল মেরে তাঁর মাথা ফাটানো হয়, তিনি অভিযোগ করেছিলেন এটা নেতাজির কাজ। আর নেতাজি ১৯৪০-এ কংগ্রেসের সভাপতি হওয়ার পরে হিন্দু মহাসভা বা মুসলিম লিগের কোনও সদস্যকে কংগ্রেসের সদস্যপদ দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা করেছিলেন। যদিও কমিউনিস্টদের জন্য এমন নিষেধাজ্ঞা ছিল না। এই হিন্দু মহাসভার উত্তরাধিকারী হলেন নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি, বিজেপি, অমিত শাহ। যাদের সম্বন্ধে নেতাজি বলেছিলেন, “সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের ত্রিশূল হাতে ভোট ভিক্ষায় নামিয়ে দিয়েছে হিন্দু মহাসভা। ত্রিশূল ও গেরুয়া বসন দেখলেই তো হিন্দুরা ভক্তিতে মাথা নোয়ায়। ধর্মের সুযোগ নিয়ে, ধর্মকে হেয় করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতির বৃত্তে প্রবেশ করছে। একে ধিক্কার জানানো সমস্ত হিন্দুদেরই কর্তব্য… জাতীয় জীবন থেকে এই বিশ্বাসঘাতকদের বিতাড়িত করুন। কেউ ওদের কথায় কান দেবেন না।”
নেতাজি কংগ্রেসের সেই অসাম্প্রদায়িক স্বর ছিলেন যার সমর্থক ছিলেন নেহরু নিজে, কারণ বল্লবভাই প্যাটেল এমনকী গান্ধীজিও নিজেদের জীবনে গোঁড়া হিন্দুই ছিলেন। কংগ্রেসে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পুরোধা নেতাজি বলেছিলেন, “ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়া উচিত। ধর্ম ব্যক্তি বিশেষের বিষয় হওয়া উচিত, …ধর্মীয় কিংবা অতীন্দ্রিয় বিষয়ের দ্বারা রাজনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত নয়।”
“…হিন্দু ও মুসলমানের স্বার্থ পৃথক— এর চেয়ে মিথ্যা বাক্য আর কিছু হতে পারে না। বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মড়ক ইত্যাদি বিপর্যয় কাউকে রেহাই দেয় না। …হিন্দুরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে ‘হিন্দু রাজ’-এর ধ্বনি শোনা যায়, এগুলি সর্বৈব অলস চিন্তা।”
যখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ, জিডিপি কমছে, সম্পদ বৃদ্ধি কমছে, মুদ্রাস্ফীতি হু হু করে বাড়ছে, বেকারত্ব তার চরম সীমায়, তার মধ্যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী, আমাদের সরকার সিএএ-এনআরসি নিয়ে সারা দেশে তাণ্ডব করে বেড়াচ্ছেন, মানুষকে ভয় দেখাচ্ছেন। নেতাজি কী বলছেন শুনুন– “গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়গত খণ্ড চিন্তা নয়, সমগ্র জাতিকে জড়িয়েই চিন্তা করতে ও অনুভব করতে আমাদের শিখতে হবে। সামাজিক ও আর্থিক ক্ষেত্রের যে সত্যটি সম্বন্ধে আমাদের নিরক্ষর দেশবাসীর চোখ আমাদেরই খুলে দিতে হবে, তা হল— ধর্ম, জাত ও ভাষার পার্থক্য থাকলেও আর্থিক সমস্যা ও অভাব অভিযোগগুলি আমাদের সকলেরই এক। …দারিদ্র ও বেকারত্ব, অশিক্ষা ও রোগগ্রস্ততা, কর ও ঋণের বোঝা সব সমস্যাই হিন্দু ও মুসলমান-সহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের জনগণকে একই ভাবে আঘাত করে এবং এগুলির সমাধানও সর্বাগ্রে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের উপর নির্ভর করে।”
আজ নেতাজির উত্তরাধিকারী আমরা, যারা অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলি, সম্প্রীতির কথা বলি মানুষে মানুষে সৌভ্রাতৃত্বের কথা বলি, নরেন্দ্র মোদি নন।