নেহাত কপিরাইটের সমস্যা আছে তা না হলে আজকের অনুষ্ঠান শুরুই করতাম ওই অমিতাভ বচ্ছনের ছবির গান দিয়ে, উনি নিজেই ঢাক বাজাচ্ছেন আর নিজেই গানটা গেয়েছিলেন, আরে ফেঁসে গেল, ফেঁসে গেল কালীরামের ঢোল। আমরা যখন প্রায় রোজ এই আরজি কর মামলা চলাকালীন বিভিন্ন মিথ্যে নিয়ে কথা বলছিলাম, সত্যিটা বলার চেষ্টা করছিলাম, তখন আমাদের একজন সিনিয়র সাংবাদিক বলেছিলেন যে এই ডাক্তারের দল আর সিপিএম-গণশক্তি জানেই না যে যেদিন এই মামলার রায় বের হবে সেদিন এই সব মিথ্যেগুলো বানের জনে ভেসে যাবে, মানুষের কাছে রায়ের কপিটা বাংলাতে অনুবাদ করে রেখে দিলেই যথেষ্ট, মানুষ বুঝে ফেলবেন। তখন ভেবেছিলাম বিচারক কেন খামোখা এই ডাক্তারদের ছড়ানো মিথ্যেগুলোর জবাব দেবেন? উনি ওনার রায় দেবেন, এই চোখে চোখ রাখা সন্ধেয় কলতলার ঝগড়া বসানো টিভি চ্যানেলের মিথ্যের জবাব উনি দেবেন কেন? কিন্তু রায় আসার পরে একদম পরিষ্কার বুঝলাম যে উনি ঠিকই বলেছিলেন, যে রায় লিখেছেন বিচারক অনির্বাণ দাস তা সত্যিই ওই ডাক্তার মোক্তার, বিকিয়ে যাওয়া মিডিয়া বা ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য ক্রমাগত মিথ্যে বলে যাওয়া সিপিএম-গণশক্তির প্রতিটা মিথ্যের জবাব ওই রায়ের মধ্যেই আছে, প্রতিটা মিথ্যেকে ভেঙে চুরমার করেই এক সত্য নির্মাণ করেছেন তিনি। ১৭২ পাতার এই রায়ে সেই ৮ অগাস্ট থেকে প্রত্যেকটা গুজবের, প্রত্যেকটা মিথ্যের জবাব আছে, প্রত্যেকটা প্রশ্ন যা এখনও হতাশ কেউ কেউ ভাসিয়ে দিচ্ছেন সুযোগ পেলেই, তার উত্তর আছে। আর এই প্রত্যেকটা উত্তর কোন তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বলা, কোন সাক্ষ্যের ভিত্তিওতে বলা তার প্রত্যেকটার জবাব আছে। উনি কেবল একটা ট্রায়াল শুনেছেন, সাক্ষ্য শুনেছেন, দেখেছেন অসংখ্য নথি আর সিজার লিস্টে থাকা অসংখ্য জিনিস তাই নয়, তার ভিত্তিতে যে দলিল তিনি দিলেন, মানুষের সামনে যা রাখা আছে তারপরেও যাঁর মাথায় এই প্রশ্ন ঘুরবে তাঁকে বলব মাথার চিকিৎসা করান, অন্য কোনও উপায়ে আপনাদের সত্যিটা বোঝানো যাবে না।
এই ১৭২ পাতার দলিল সেই সব চিল্লানেসরাস মিডিয়া বা সেই সব এগিয়ে থাকে এগিয়ে রাখে পত্রিকা হাউসের যাবতীয় প্রতিবেদকদের জন্য এক নির্মোহ সত্য যা বিচারক অনির্বাণ দাস তাঁর ওই ১৭২ পাতার রায়ে বলেছেন। আসুন একে একে দেখে নিই। না সবটা বলতে পারব না, কিন্তু এই রায় হাতে নিয়ে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি ওই সমস্ত সেলিব্রিটিদের, ওই ডাঃ নন্দ, ডাঃ মাহাতো বা ডাঃ হালদারদের সাহস থাকে সামনে আসুন, আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর শিয়ালদহ নিম্ন আদালতের বিচারকের রায়ের মধ্যে আছে। হ্যাঁ, আপনি বলতেই পারেন যে বিচারের রায় আপনার পছন্দ হয়নি, সে তো অনেকের চিংড়ি মাছ পছন্দ নয়, অনেকেই ওলকপি খান না, অনেকের দিঘা তেমন ভালো লাগে না, অনেকেরই বঙ্কিম সাহিত্য পোষায় না, সে তো ব্যক্তিগত ভালোলাগা না লাগা, পছন্দ না পছন্দ। কিন্তু যদি যুক্তিবুদ্ধির কথা বলতে চান তাহলে এই রায় প্রতিটা মিথ্যের জবাব এনে হাজির করেছে, যুক্তিবোধ্য জবাব। ধরুন প্লেস অফ অকারেন্স। কোথায় হয়েছিল খুনটা? ধর্ষণের সেই ঘটনা ঘটেছিল কোথায়? কত রকমের তত্ত্ব, যাঁরা বলছেন আরজি করে ঢুকে তৃণমূলিরা আসলে সেমিনার রুমে চল বলছিল ১৪ তারিখ রাতে, আসলে তারা সেদিন সব প্রমাণ লোপাট করার তালে ছিল। আবার সেই তারাই বলছে আসলে ধর্ষণ আর খুন তো ওই সেমিনার রুমে হয়ইনি, বাইরে কোথাও হয়েছিল, মৃতদেহ এনে ওইখানে ডাম্প করে রাখা হয়েছে। তাহলে কোন প্রমাণ লোপাটের কথা আগে বলছিলেন? আমরা এইভাবে যুক্তি দিয়েছিলাম। কিন্তু বিচারক এক অন্য জায়গা থেকে শুরুই করলেন।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | বিরলের মধ্যে বিরলতম, কী বলছে আইন? আরজি করে কী হয়েছিল সেদিন?
তিনি প্রথমেই বোঝার চেষ্টা করেছেন, সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে জানার চেষ্টা করেছেন এবং জানিয়েছেন যে ওই অভয়ার ডিউটি কোথায় ছিল? ডিউটি আওয়ার কতটা ছিল? অনেকেই ৭২ ঘণ্টা, ৪৮ ঘণ্টা ইত্যাদি বলছিলেন কিন্তু সেদিনের ডিউটি রস্টার থেকে যা বের হয়েছে তা হল অভয়া সেদিন সকাল ৯টার সময়ে ডিউটিতে এসেছিলেন, তারপরের দিন রাত ৯টা পর্যন্ত তাঁর ডিউটি ছিল। অর্থাৎ সেদিন তিনি আসলে ১২ ঘণ্টার ডিউটির শেষে সেমিনার রুমে গিয়েছিলেন, সেখানেই বন্ধুদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করে, তাঁর বন্ধুরা বেরিয়ে গেলে তিনি ওই সেমিনার রুমেই একটা মেক-শিফট বিছানায় শুয়ে পড়েন। এগুলো জানা যাচ্ছে তাঁর তিন জন বন্ধু ডাঃ অর্ক সেন, ডাঃ সৌমিত্র রায়, ডাঃ শুভদীপ সিংহকে জেরা করে, যাঁরা তাঁর সঙ্গে সেদিন রাত ১টা পর্যন্ত ছিলেন। একটা কথা রটানো হয়েছিল যে খাবারের পাত্রগুলো কোথায়? মানে রেস্তরাঁ থেকে খাবার এলে তো পাত্র থাকবে। তা নেই কেন? বিচারক বলছেন যদি এক্ষেত্রে বিষ বা ওরকম কিছুর সম্ভাবনা থাকত তাহলে ওই পাত্রের ব্যাপারটা খুব জরুরি মনেই হত, তা নয় বলেই ওই পাত্রের ব্যাপারটা আমার কাছে প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়নি। আর এটাও ভেবে দেখা দরকার যে তারা সব্বাই একই খাবার খেয়েছিল। ওই বন্ধুরা যাঁরা সেদিন রাতে ডিউটিতে ছিলেন তাঁদেরকে জেরা করেই এসব জানা গেছে। ওনাদের জেরার বয়ানে আমি সন্তুষ্ট যে ওনারা কোনও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন না। এই সমস্ত সাক্ষ্য থেকে তিনি বলেছেন যে এটা প্রমাণিত যে অভয়াকে সেদিন ২.৫০ পর্যন্ত ওই হলেই জীবিত অবস্থাতেই দেখা গেছে। এরপর তাঁকে তারপরের দিন সকালে ডাঃ অর্ক সেন প্রথম মৃত অবস্থাতে দেখেন, তাঁকে ডাঃ সৌমিত্র রায় বলেছিলেন যে অভয়াকে মোবাইলে পাওয়া যাচ্ছে না, একবার খোঁজ করতে। যেহেতু ডাঃ অর্ক সেন তাঁকে শেষ ওই সেমিনার হলেই দেখেছিলেন উনি ওখানে যান এবং গিয়ে জামাকাপড় অবিন্যস্ত অভয়াকে পড়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়েই বেরিয়ে আসেন। তিনিই ডাঃ পুজা, ডাঃ প্রিয়া, ডাঃ ভেনিলা ইত্যাদিকে জানান, তাঁরা গিয়ে ডিপার্টমেন্টাল হেড ডাঃ সুমিত দে তপাদারকে গিয়ে সেটা ইনফর্ম করেন।
অর্থাৎ অভয়াকে শেষ রাত ২.৩০ পর্যন্ত ওই সেমিনার হলে জীবিত দেখা গিয়েছিল, আর সকালে মৃত দেখা গেল। কাজেই এর মধ্যের সময়ে তিনি যদি হাসপাতাল ছেড়ে বের হতেন তাহলে আর কারও চোখে না পড়লেও সিসিটিভিতে ধরা পড়ত, তিনি যদি বের হতেন কোথাও বাইরে যেতেন তাহলে তাঁর মোবাইল ফোনের টাওয়ার সেটা বলত। কাজেই তাঁকে শেষ জীবিত দেখা গেছে ওই সেমিনার রুমে, প্রথম মৃত অবস্থাতেও দেখা গেছে ওই সেমিনার রুমেই। কাজেই প্লেস অফ অকারেন্স ওই সেমিনার রুম, আর কোথাও নয় বলেই বিচারক রায় দিচ্ছেন। কজ অফ ডেথ, ৭ নম্বর বিষয়ের জে প্যারাগ্রাফে বিচারক তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই লিখছেন As per the evidence of the PW-10, the mother of the victim was present during the inquest but for an emotional reason, she sitting at a distance. মানে ওই যে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না ইত্যাদি, আসলে সেই সময়ে সাবজুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ইনকোয়েস্ট চলছিল, সেখানে স্বাভাবিক কারণেই বাবা-মাকে ঢুকতে দেওয়ার কথাও নয়, মানে তাঁদের আত্মজার ধর্ষিত ক্ষতবিক্ষত দেহের মাপঝোক দেখতে কোন বাবা-মাকে পাঠানো হবে? এবং বিচারক জানাচ্ছেন যে ওখানে সমস্ত ইনকোয়েস্ট প্রসিডিওর ভিডিও রেকর্ডিং করা হয়েছে। তিনি জানাচ্ছেন ওই অভয়ার দুই কোলিগ ডাঃ দিয়াসিনি রায় এবং ডাঃ অন্তরা বর্মনের উপস্থিতেই ইনকোয়েস্ট বা ময়নাতদন্ত চলছিল। এবং এই পর্যায়ে বিচারক প্রত্যেকটা ক্ষতের বর্ণনা দিয়েছেন, না কোথাও পেলভিক বোন ভাঙা বা কলার বোন ভাঙা ইত্যাদি ছিল না। সেই থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে এক মহিলার হাড়ভাঙা আর পা চেরার সেই বর্ণনা যে এক প্রকাণ্ড মিথ্যেই ছিল তা এই পর্যায়ে পরিষ্কার হয়ে গেল।
এরপরে তিনি মৃত্যুর সময়ের বিষয়ে এক পরিষ্কার ধারণা দিয়েছেন, জানিয়েছেন যে ৪.৪৫ থেকে ৫.১৫র নাগাদ এই ধর্ষণ আর মৃত্যু হয়েছে। এরপরে আসুন সিসিটিভি ফুটেজের ব্যাপারে, কলকাতা পুলিশ নাকি সিবিআইকে সিসিটিভি ফুটেজ দেয়নি। কিন্তু রায় থেকে জানা যাচ্ছে ১১টা, হ্যাঁ ১১টা হার্ড ড্রাইভ আর দুটো পেন ড্রাইভ সিবিআই-এর হাতে দেওয়া হয়েছিল যেগুলোর প্রত্যেকটার ফরেনসিক তদন্ত হয়েছে, তার রিপোর্টে বলা হয়েছে কোনওরকম ফুটেজ ট্যাম্পারিং হয়নি। আর সেই ফুটেজেই ওই হত্যার সময়ের মধ্যে যাঁদের দেখা গেছে তাঁদের মধ্যে সঞ্জয় রায় ছিলেন, এবং একমাত্র তিনিই কেন ওখানে এসেছিলেন, কোন কাজে ঢুকেছিলেন, কোন কাজে বেরিয়েছিলেন তা জানাতে পারেন না। বাকি প্রত্যেকটা আনাগোনার তদন্ত করা হয়েছে, তাদের গতিবিধিতে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি এবং তাঁরা ওই ধর্ষণ বা হত্যার সময়ে যাননি। এবং সঞ্জয় রায়কে তার ব্লু-টুথ হেডফোন নিয়েই ঢুকতে দেখা গেছে এবং বের হওয়ার সময়ে সেই ব্লু-টুথ ছিল না, যা পাওয়া গিয়েছিল সেই সেমিনার রুমে। এবারে একটা গুজব শেষের দিকে এসে হাজির হল যে সেন্ট্রাল ফরেনসিক ল্যাবরেটারির রিপোর্ট দুটো কথা বলছে, ১) ওই সেমিনার হলে যেতে গেলে একটা ওয়ার্ডের মাঝখান দিয়ে যেতে হয়, তারপরে একটা নার্সিং ওয়ার্ক স্টেশন আছে, কাজেই এর মধ্যে দিয়ে আন-নোটিসড যাওয়াটা খুব সহজ নয়। ২) যে বিছানাতে নির্যাতিতাকে ধর্ষণ বা হত্যা করা হয়েছে সেখানে সেরকম কোনও স্ট্রাগলের চিহ্ন নেই। তো প্রথমটার জবাব তো সোজা যে সঞ্জয় রায় ওই আরজি করের রোগী সুরক্ষা ইত্যাদির জন্য যে কমিটি আছে তাতে সিভিক ভলান্টিয়ার হিসেবে ছিলেন কাজেই তিনি আরজি করে অত্যন্ত পরিচিত মুখ, তিনি অনায়াসেই ওখান দিয়ে যেতেই পারেন, কিন্তু যা সম্ভবই নয় তা হল নির্যাতিতাকে বাইরে মেরে লাশ এই জায়গার মধ্যে দিয়ে নিয়ে সেমিনার রুমে ফেলে আসা।
আর ওই বিছানাতে ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই বলে যে রিমার্ক, তা নিয়ে বিচারক বলছেন যে the team of CFSL had visited the said place on 14.08.2024 ie 6 days after the date of commission of the offence. It appears from the evidence on record that during this time several footprints were there in the said Seminar Room for the purpose of investigation. The bed sheets, blankets and other materials available, were collected by the Forensic Team of Kolkata Police and the same were seized accordingly on 09.08.2024. Sample cotton was collected from the mattress on the same date. The said bed sheets, blankets were sent to CFSL for forensic analysis. The first time view of the said Seminar Room after the incident, came to our notice when the photographs [Ext-P47(14)] were exhibited in this case. If we examine the said photographs carefully, the said bed-sheet, on which the victim was sleeping, is itself an evidence to show the marks of struggle. কাজেই বুঝতেই পারছেন, প্রথম তোলা ছবিতে সেই ধস্তাধস্তির চিহ্ন ছিল, স্বাভাবিকভাবেই তারপরে প্রমাণ কালেক্ট করার জন্য টিম এসেছে এবং সেসব জায়গা খানিক বদলেছেও। বিচারক কিন্তু সেই সব ছবি দেখেছেন। দেখেছেন সেই ইনকোয়েস্ট-এর সময়ের ভিডিও রেকর্ডিং, যেখানে তাঁর রায় থেকে জানা যাচ্ছে একজন আয়া ওই ইনকোয়েস্টে সাহায্য করছিলেন, বাকি যাঁরা ওই হলে ঢুকেছিলেন তাঁরা যথেষ্ট দূরেই ছিলেন। বিশাল রায়, আরও অনেক কিছু আছে, বিশেষ করে ডিএনএ নিয়ে বিচারকে অবজার্ভেশন দুর্দান্ত, অনেকের গুজব আর সংশয়ের জবাব আছে, কিন্তু সবটা তো একই এপিসোডে বলা সম্ভব নয়। আগামী দিনে সেই সত্যিগুলোও নিয়ে হাজির হব।