সারা বাংলা বিচার চাইছে, প্রত্যেকে। মাথার মধ্যে যাদের ঝট করে গদিতে বসে পড়ার ইচ্ছে আছে তারাও চাইছে, গদি বাঁচাতে যাঁরা উৎসাহী, তাঁরাও বিচার চাইছেন আর অসংখ্য মানুষ বিচার তো চাইছে। কিন্তু যদি তদন্তই না শেষ হয় তাহলে বিচার টা হবে কী করে? নিজে থেকেই আরজি কর ধর্ষণ হত্যা মামলা হাতে নিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court of India), ১৬ পাতার রায় দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস চন্দ্রচুড় সমেত তিনজনের বেঞ্চ। দেশের হাসপাতালে ডাক্তার আর স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষার জন্য কমিটি তৈরি হয়েছে, আর তার পরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সি বি আই (CBI) তাদের স্ট্যাটাস রিপোর্ট জমা দিয়েছে।
জানা গেছে, তাদের রিপোর্টে একজনই ধর্ষণ করেছে, গ্যাং রেপের তত্ত্ব তাঁরাও উড়িয়েই দিয়েছে। আমি ঘটনার কথা বলছি। সকাল থেকে সি সি টিভি ফুটেজ দেখে, এক হেডফোনের সূত্র ধরে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী ১২ তারিখেই মেয়েটির বাবা-মার সঙ্গে দেখা করেছিলেন, ৭ দিন সময় দিয়েছিলেন কলকাতা পুলিশ (Kolkata Police)-কে তদন্তের কিনারা করুন না হলে তদন্তের ভার দেওয়া হবে সি বি আই কে, বলেছিলেন। ১৩ তারিখে কলকাতা উচ্চ আদালত এই তদন্তের ভার দিলেন সি বি আই-এর হাতে, ১৪ তারিখে যাবতীয় তথ্য প্রমাণ ইত্যাদি সি বি আই-এর হাতে দিয়ে দিল কলকাতা পুলিশ, সি বি আই হাতে পেল তখনও পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়া ওই সঞ্জয় রাইকে। এগুলো ঘটনা এবং এই ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে আশা করবো কারোর কোনও দ্বিমত নেই। এরপরে বিভিন্ন সংবাদ সূত্র, ফেসবুক পোস্ট, বিভিন্ন মানুষের, জ্ঞানিগুণি মানুষের নানান মন্তব্য আসতে শুরু করল। এক মেধাবী ডাক্তার, তরুণীর এই নৃশংস খুন ধর্ষণ সমাজে আলোড়ন তো ফেলবেই, তার সঙ্গে এই অর্ধ সত্য আর অর্ধ মিথ্যে তথ্য মিশে এক ঝাঁঝালো ককটেল তৈরি হলো আর তার ফলে কিছু পপুলার পার্সেপশন, কিছু জনপ্রিয় ধারণার জন্ম হল। যা কোনওটা সত্যি, কোনওটা নির্ভেজাল মিথ্যে, আবার কোনওটা সত্যি আর মিথ্যের মধ্যে ঝুলছে।
কী সেই ধারণাগুলো?
১) একজন নয়, একাধিক মানুষজন সরাসরি এই ধর্ষণ আর হত্যার সঙ্গে জড়িত।
২) ওই অভিযুক্ত সঞ্জয় রাই আসলে এক বলির পাঁঠা, তাকে ফাঁসানো হয়েছে।
৩) হত্যা ওই সেমিনার রুমে হয়নি, অন্য কোথাও হত্যা করে ওখানে এনে রাখা হয়েছে।
৪) আসলে এই হত্যার পেছনে বিরাট অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি জড়িয়ে আছে যার মাথায় কলেজের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ।
৫) পুলিশকে ব্যবহার করে সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণকে মুছে দেবার চেষ্টা চলছে।
৬) কাজেই কেবল বিচার চাই না, শাস্তি চাই, ফাঁসি চাই, আর সরকারের পদত্যাগ চাই।
এই মূহুর্তে তৃণমূলের (TMC) খুব ঘনিষ্ঠ সমর্থক কর্মী না হলে এগুলোই সাধারণ ধারণা, সবটা না হলেও অনেকের ধারণা এর বেশিরভাগটাই সত্যি এবং এরসঙ্গে আছেন সেই চিন্তাশীল জগতের মানুষজন যাঁরা এই ধর্ষণ আর হত্যার ঘটনাকে নারীত্বের লাঞ্ছনা, অবমাননার এক চূড়ান্ত উদাহরণ হিসেবেই দেখেছেন, তার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন, সেই স্বর আসলে ন্যায়ের দাবী, সমাজে সমানতার দাবী, এবং যাঁরা সেই দাবি তুলেছেন তাঁরা জানেন যে সরকার ব্যতিরেকে, যেকোনও সরকারের আমলেই এই ঘটনা ঘটে চলেছে, এ এক সামাজিক অপরাধ, আমাদের সমাজের সমষ্টি চেতনার অনেক গভীরে রয়েছে এর কারণ, এ এক মিছিলে, এক ধক্কায় শেষ হয়ে যাবে তেমন নয়, কিন্তু এরকম ঘটনা ঘটলেই সরব হতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে, সমাজের নজরে আনতে হবে।
অমর্ত্য সেন বলেছেন এ এক জঘন্য ব্যাপার যা সারা দেশেই ঘটে চলেছে, আমাদের এর বিরোধিতা করতেই হবে। এরই সঙ্গে রয়েছে স্বাভাবিকভাবেই বিরোধী রাজনৈতিক মতামত, তা একজন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদের হতেই পারে, হতেই পারে কোনও এক নির্দিষ্ট রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষ, অনুপম খের নাকি আজ শব্দ খুঁজেই পাচ্ছেন না, কলকাত্তাকা ইয়ে বেটি কে লিয়ে রুহ কাঁপ উঠতা হ্যায়, কলকাতার এই মেয়েটির জন্য যাঁর আত্মা কেঁপে কেঁপে উঠছে, সেই অনুপম খেরের আত্মা ৫ পেগ ব্রান্ডি খেয়ে নিজেকে গরম রেখেছিল মণিপুরের ঘটনায়, হাথরসের ঘটনায়, বিলকিস বেগমের কান্নায় তিনি শুনতেই পাননি, তিনি কেন অনেকেই শুনতে পাননি, যাঁরা আজ পাচ্ছেন।
যে অগ্নিমিত্রা পল এখন এত উত্তেজিত হয়ে বিচার চাইছেন, সেই তিনিই রাজ্যপালের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানীর অভিযোগকে এক কানে শুনে আরাকান দিয়ে বের করে দিয়েছেন। এসব সিলেকটিভ প্রতিবাদ হয়, হবে আমরা জানি। কলকাতা পুলিশ ধর্ষণ খুনের এক দিনের মধ্যেই গ্রেফতার করেছে। সেই তদন্তে সন্তুষ্ট না হয়ে তদন্তের চার দিনের মাথায় যাদের হাতে তদন্ত ভার দেওয়া হয়েছিল, তারা এই বারো দিনে কী কী করেছেন? কোন নতুন তথ্য মানুষের সামনে এনেছেন? কোন নতুন গ্রেফতারি হয়েছে? কোনও কোনও প্রশ্নের জবাব মানুষ পেলেন? আসুন সেগুলো দেখা যাক। প্রথম পার্সেপশন একজন নয়, একাধিক মানুষজন সরাসরি এই ধর্ষণ আর হত্যার সঙ্গে জড়িত। সি বি আই গোয়ান্দারা বারো দিনের মাথায় একাধিক মানুষের জড়িত থাকার কোন তথ্যটা আমাদের সামনে এনে হাজির করেছেন? অনেক ছেড়েই দিন, এই ধর্ষণ আর হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে আর একজনকেও কি গ্রেফতারি করা হয়েছে? অন্তত এই কথাটাও কি এসেছে যে একজন নয়, নিশ্চিতভাবেই আরও অনেকেই জড়িত ছিল? শোনা যাচ্ছে ঐ অভিযুক্তকে নিয়েই তাঁরা সাইক্রোম্যাট্রিক্স করিয়েছেন, পলিগ্রাফ টেস্ট চাইছেন, ওই অভিযুক্তকে নিয়েই বিভিন্ন জায়গাতে গেছেন। না একাধিক, অন্তত অন্য আর একজনের ইনভলভমেন্টের খবর এখনও নেই। যেমনটা ছিলনা কলকাতা পুলিশের ঐ চার দিনের তদন্তে। দ্বিতীয় পপুলার পার্সেপশন ওই অভিযুক্ত সঞ্জয় রাই আসলে এক বলির পাঁঠা, তাকে ফাঁসানো হয়েছে।
কেবল অগ্নিমিত্রা পল বলেছেন এমন নয়, বহু লোকজন সমাজমাধ্যমে সাফ জানিয়েই দিয়েছেন, যে ঐ সঞ্জয় রাই আসলে স্কেপ গোট, বলির পাঁঠা, তাকে ফাঁসানো হয়েছে। কি করে জানলেন? স্বপ্নে? তো ওরা জানলেন জানলেন, সি বি আই কি জানালো? সেই অভিযুক্তের তার আগের বেশ কিছুদিনের কল লিস্ট, তার মুভমেন্ট, তার পরিচিতদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পরে তারা আপাতত নিশ্চিত হতে চাইছে যে এই সঞ্জয় রাই এর সঙ্গে আর কেউ এই ধর্ষণ হত্যায় জড়িয়ে আছেন কি না? সেই এখনও পর্যন্ত সি বি আই তদন্তের মূল অভিযুক্ত, তাকে ঘিরেই সি বি আই-এর যাবতীয় তদন্ত ঘুরছে। যেমনটা ঘুরেছে কলকাতা পুলিশের তদন্তের ধারা। তিন নম্বর ধারণা, হত্যা ওই সেমিনার রুমে হয়নি, অন্য কোথাও হত্যা করে ওখানে এনে রাখা হয়েছে। এই ধারণা আবার এসেছে আমাদের রাজ্যের বিরোধী দলনেতা কাঁথির খোকা বাবুর কাছ থেকে।
হত্যা আর দেহ পড়ে থাকার এই যে আলাদা লোকেশনের তত্ত্ব সে বিষয়ে সি বি আই গোয়েন্দারা কিছু আলোকপাত করতে পেরেছেন? জানা গেছে অবশ্যই এই সম্ভাবনার ভিত্তিতেই তাঁরা খোঁজখবর চালিয়েছেন, কিন্তু এই বারো দিনেও এই বিষয়ে ব্রেক থ্রু নেই, বরং পোস্ট মর্টেমের আর ইনকোয়েস্টের রিপোর্ট বলছে ধর্ষণ আর হত্যা ঐ একই সেমিনার রুমেই হয়েছে। আর যদি নাও হয়ে থাকে তাহলেও সে ব্যাপারে সি বি আই এখনও কোনও তথ্য পাননি, যেমনটা পান নি কলকাতা পুলিশ। চতুর্থ ধারণা হল আসলে এই হত্যার পেছনে বিরাট অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি জড়িয়ে আছে যার মাথায় কলেজের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ।
গত শুক্রবার থেকে ওই সন্দীপ ঘোষকে সি বি আই জেরা করে চলেছে, প্রতিদিন, এখনও কোনও সেরকম তথ্য বের হয়নি, রোজ জেরার পরে বাড়িতে রেইড হল, সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েই হল এবং এই ধারণা তো আজকের নয়, বহু আগে থেকেই এই সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধ এ ধরণের অভিযোগ ছিল। কিন্তু সমস্যা হল সেই দূর্নীতির সঙ্গে এই ধর্ষণ আর হত্যার ন্যূনতম সম্পর্ক সি বি আই দিতে পারেনি। সন্দীপ ঘোষ দূর্নীতিগ্রস্ত কি না, তাঁর আর্থিক দূর্নীতি নিয়ে মাঠে হাজির ই ডিও কিন্তু তার সঙ্গে এই ধর্ষণ বা হত্যাকে জুড়ে দেবার কোনও তথ্য সি বি আই আজ পর্যন্ত দিতে পারেনি, যেমন পারেনি কলকাতা পুলিশ।
পাঁচ নম্বর ধারণাটা খুব সাংঘাতিক, পুলিশকে ব্যবহার করে সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণকে মুছে দেবার চেষ্টা চলছে। সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ যদি মুছে ফেলার চেষ্টা কলকাতা পুলিশ করে থাকতো তাহলে এক কি বড়জোর দু দিনের মাথাতেই সেই সত্য সি বি আই তদন্তের ফলে বেরিয়ে আসা উচিত, তারা তো ফালা ফালা করে দেখিয়ে দিতে পারতো যে এই জায়গাতে কলকাতা পুলিশ সাক্ষ্য প্রমাণ নষ্ট করেছে, রাখেনি, পুড়িয়েছে, লুকিয়েছে। বারো দিনের তদন্তে সেরকম কিছু এসেছে? না আসেনি, একটাও এরকম তথ্য নেই যা নষ্ট করা হয়েছে বলে ঐ সি বি আই বা ঐ চোখে চোখ রাখনেওয়ালারা যাঁরা সি বি আই এর অলিখিত মুখপাত্র তাঁরা জানিয়েছেন। উলটে দেখা যাচ্ছে যে তাঁরা আবারও কলকাতা পুলিশের কাছে আসছেন সাহায্যের জন্য এবং কলকাতা পুলিশ সেসব তথ্যও দিচ্ছেন।
সেমিনার হলের উল্টোদিকে ঘর ভাঙার যে তথ্য ছিল তা সি বি আই এর হাতে তদন্তের ভার দেবার আগেই বন্ধ হয়েছিল, সি বি আই তদন্তেও সেই ঘর ভাঙার সঙ্গে এই ধর্ষণ আর হত্যার কোনও যোগাযোগের কথা আজ অবদি বলেন নি। তাহলে দাঁড়ালো টা কি? ৪ দিন বনাম ১২ দিনের গোয়েন্দাগিরিতে ৪ দিনে যা করেছিল কলকাতা পুলিশ, সি বি আই ঠিক সেইখানেই দাঁড়িয়ে আছে, কোনও একটা বিষয়েও তাঁদের নতুন কোনও ইনপুট নেই। তাহলে এই তদন্তভারের হস্তান্তরণ কেন হয়েছিল? আসল কারণ টা কি? সেটা যেমন জানা দরকার তেমনই জানতেই হবে যে এখন তাঁরা কী করছেন? আজ বারো দিন পরে তো সে প্রশ্ন উঠবেই, আর যদি দেখা যায় তেনারা এই সাতদিন ধরিয়া সেই জাবরই কাটিতেছিলেন, যে জাবর কলকাতা পুলিশ ৪ দিনের মাথাতে তাদের কে দিয়েছিল, তাহলে মানুষকে বুঝতে হবে এই তদন্তকে আসলে দীর্ঘায়িত করার জন্যই এই কমান্ড চেঞ্জ করা হল, এই তদন্তকে চালানো হবে নন্দীগ্রামের মামলার মত, যা সি বি আই আজও কোনও সিদ্ধান্তে এনে হাজির করাতে পারেননি, যেমন রবি ঠাকুরের মেডেল আজও অধরা, যেমন তাপসী মালিককে কে মারলো তা আমরা আজও জানি না, তাপসি মালিক ধর্ষিতা হয়েছিলেন? তাও জানি না।
এই অসম্ভব বাজে ট্রাক রেকর্ডওলা এক এজেন্সির কাছে এই তদন্তের ভার যাঁরা দিতে বললেন, তাঁদের ঐ বলার পেছনের উদ্দেশ্য কী? তাও খতিয়ে দেখা হোক। ডান বাম মধ্য, বাম, বিজেপি, তৃণমূল, কোনও পক্ষেরই নয় তেমন মানুষও নেমেছিলেন রাস্তায়, একটাই শ্লোগান নিয়ে, উই ওয়ান্ট জাস্টিস, সেই ন্যায় ক্রমশ কি দূরে সরে যাচ্ছে? সেই সি বি আই কে মামলা দেবার জন্য আদালতে কত সওয়াল করেছেন প্রখ্যাত বিচারপতিরা, তাঁদের কাছ থেকে এই দীর্ঘসূত্রতার কারণ তো জানতেই চাইবো। আপনারাও নিশ্চই একমত হবেন। রাজ্য সরকার পারেনি, কলকাতা পুলিশ পারেনি। আপনাদের হাতে তদন্ত। সাত দিন হয়ে গেছে, কোনও অ্যাঁ আঁ উঁ উঁ নয়, এবার সকলে আবার রাস্তায় নামুন, আবার সব্বাই নামুন, এবারের শ্লোগান বাকি যা করার করুন, ধর্ষণ আর খুনের তদন্ত শেষ করুন সি বি আই।