Saturday, August 16, 2025
Homeচতুর্থ স্তম্ভচতুর্থ স্তম্ভ: রবীন্দ্রনাথ না আরএসএস–বিজেপি? কোন পথে চলবেন

চতুর্থ স্তম্ভ: রবীন্দ্রনাথ না আরএসএস–বিজেপি? কোন পথে চলবেন

Follow Us :

আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে, তাই হেরি তায় সকল খানে॥
আছে সে, নয়নতারায় আলোকধারায়, তাই না হারায়–
ওগো, তাই দেখি তায় যেথায় সেথায় তাকাই আমি যে দিক-পানে॥
আমি তার মুখের কথা শুনব ব’লে গেলাম কোথা,
শোনা হল না, হল না–
আজ ফিরে এসে নিজের দেশে এই-যে শুনি
শুনি তাহার বাণী আপন গানে॥
কে তোরা খুঁজিস তারে কাঙাল-বেশে দ্বারে দ্বারে,
দেখা মেলে না মেলে না,–
ও তোরা আয় রে ধেয়ে দেখ্‌ রে চেয়ে আমার বুকে –
ওরে দেখ্‌ রে আমার দুই নয়ানে॥
আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে, তাই হেরি তায় সকল খানে॥

হ্যাঁ তিনিই আমাদের প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ আর আত্মার শান্তি। সেই রবিঠাকুর আমাদের জীবন চর্যার কিছু দিক নির্দেশ তো করে গিয়েছেন৷ আজ তাঁর জন্মদিনে আসুন সেই জীবনচর্যা নিয়ে কটা কথা বলা যাক। ভারতবর্ষের শিরায় ধমনীতে ধর্ম আছে, এক আধ্যাত্মিক ভারতবর্ষ৷ সেই ধর্ম নিয়ে আমাদের ঠাকুর কী বলেছেন? জীবন চর্যায় ধর্ম তাঁর কাছে কেমন ছিল? প্রথমত তাঁর পূর্বজরা ব্রাহ্মণ হলেও তিনি ব্রাহ্মণ ছিলেন না৷ ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত ছিলেন৷ সেটা কোনও পারিবারিক, বংশের প্রথা হিসেবে নয়৷ নিজেও সেই ব্রাহ্ম সভা, ব্রাহ্ম ধর্মের সক্রিয় উপাসক ছিলেন৷ কেন ব্রাহ্ম ধর্ম? কেন হিন্দু নয়? কেন ব্রাহ্মণ নয়? তাঁর লেখার ছত্রে ছত্রে সেই কথা লেখা আছে৷ বিভিন্ন লেখায়, কবিতায়, উপন্যাসে, গল্পে, নাটকে সেই কথা বার বার বলা আছে৷ এক নিষ্ঠুর আচার সর্বস্য, প্রথা সর্বস্য, চাপিয়ে দেওয়া হিন্দু উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ ছিল ব্রাহ্ম ধর্ম। সেই প্রথা, আচারের বাইরে এসে সেই তিনি, যিনি নাকি সর্বশক্তিময়, তাঁর উপাসনা ছাড়া আর কোনও বন্ধন ব্রাহ্ম ধর্মে ছিল না, রবীন্দ্রনাথ সেই কথাই সারা জীবন ধরে বলে গিয়েছেন। ধর্ম ধারণ করে সমাজ জীবনকে৷ এই সনাতনী চিন্তার থেকে বেরিয়ে, ধর্ম তাঁর কাছে ছিল উপাসনা৷ ভেদাভেদ নয়৷ আচার বিচার নয়৷ এক অজ্ঞেয়কে জানার ইচ্ছা৷ তাঁকে সবকিছু সমর্পণ করার ইচ্ছাই ছিল রবীন্দ্রনাথের ধর্ম।

জীবন সায়াহ্নে এসে, ৮০ বছর বয়সে, তাঁর উপলব্ধি, “‘আজ আমার আশি বছরের আয়ুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনের সত্যকে সমগ্রভাবে পরিচিত করে যেতে ইচ্ছা করেছি। …আমি বারবার তপোবনের কথা বলেছি। সে তপোবন… পেয়েছি কবির কাব্য থেকেই। তাই স্বভাবতই সে আদর্শকে আমি কাব্যরূপেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছি। বলতে চেয়েছি, পশ্য দেবস্য কাব্যাং, মানবরূপে দেবতার কাব্যকে দেখো। আবাল্যকাল উপনিষদ আবৃত্তি করতে করতে আমার মন বিশ্বব্যাপী পরিপূর্ণতাকে অন্তর্দৃষ্টিতে মানতে অভ্যাস করেছে। সেই পূর্ণতা বস্তুর নয়, সে আত্মার। তাই তাকে স্পষ্ট জানতে গেলে বস্তুগত আয়োজনকে লঘু করতে হয়৷’’ বিরাট মন্দির, বিরাট মূর্তি, বিরাট আয়োজনের কথা নয়, তাঁর ভগবান ছিল একান্ত ব্যক্তিগত জীবন চর্যা, তাঁর কবিতা, তাঁর গান, তাঁর লেখা। ধর্ম যদি এক বিরাট আয়োজন হয়, তাহলে সে আর যাই হোক, ধর্ম নয়, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিলনা রবীন্দ্রনাথের, তিনি ধর্ম প্রসঙ্গে বলছেন, “আমার গৃহকোণের জন্য যদি একটি প্রদীপ আমাকে জ্বালিতে হয়, তবে তাহার জন্য আমাকে কত আয়োজন করিতে হয়—সেটুকুর জন্য কত লোকের উপর আমার নির্ভর। কোথায় সর্ষপ-বপন হইতেছে, কোথায় তৈল-নিষ্কাশন চলিতেছে, কোথায় তাহার ক্রয়-বিক্রয়—তাহার পরে দীপসজ্জারই বা কত উদ্‌যোগ—এত জটিলতায় যে আলোকটুকু পাওয়া যায় তাহা কত অল্প। তাহাতে আমার ঘরের কাজ চলিয়া যায়, কিন্তু বাহিরের অন্ধকারকে দ্বিগুণ ঘনীভূত করিয়া তোলে। বিশ্বপ্রকাশক প্রভাতের আলোককে গ্রহণ করিবার জন্য কাহারও উপরে আমাকে নির্ভর করিতে হয় না,-তাহা আমাকে রচনা করিতে হয় না, কেবলমাত্র জাগরণ করিতে হয়। চক্ষু মেলিয়া ঘরের দ্বার মুক্ত করিলেই সে আলোককে আর কেহ ঠেকাইয়া রাখিতে পারে না।

যদি কেহ বলে প্রভাতের আলোককে দর্শন করিবার জন্য একটি অত্যন্ত নিগূঢ় কৌশল কোথাও গুপ্ত আছে, তবে তৎক্ষণাৎ এই কথা মনে হয়, নিশ্চয় তাহা প্রভাতের আলোক নহে—নিশ্চয় তাহা কোনো কৃত্রিম আলোক-সংসারের কোনো বিশেষ-ব্যবহারযোগ্য কোনো ক্ষুদ্র আলোক। কারণ, বৃহৎ আলোক আমাদের মস্তকের উপরে আপনি বর্ষিত হইয়া থাকে—ক্ষুদ্র আলোকের জন্যই অনেক কলকারাখানা প্রস্তুত করিতে হয়। যেমন এই আলোক, তেমনি ধর্ম। তাহাও এইরূপ অজস্র, তাহা এইরূপ সরল। তাহা ঈশ্বরের আপনাকে দান,—তাহা নিত্য, তাহা ভূমা, তাহা আমাদিগকে বেষ্টন করিয়া আমাদের অন্তরবাহিরকে ওতপ্রোত করিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিয়াছে। তাহাকে পাইবার জন্য কেবল চাহিলেই হইল, কেবল হৃদয়কে উন্মীলিত করিলেই হইল। আকাশ পূর্ণ দিবালোককে উদ্‌যোগ করিয়া পাইতে হইলে যেমন আমাদের পক্ষে পাওয়া অসম্ভব হইত, তেমনি আমাদের অনন্তজীবনের সম্বল ধর্মকে বিশেষ আয়োজনের দ্বারা পাইতে হইলে সে পাওয়া কোনোকালে ঘটিয়া উঠিত না।

এটাই রবীন্দ্র দর্শন, এটাই আমাদের ঠাকুরের কথা। অন্যদিকের কথা, হিন্দুত্বের কথা, আরএসএস–বিজেপি ধর্ম নিয়ে যা বলে তার কথা ভাবুন, ১০৮ ফুট উঁচু হনুমানে মূর্তি না গড়লে তাদের পুজো হয় না, যে রাম রবিঠাকুরের মানসভূমিতে বসবাস করে, আর এস এস – বিজেপি তার জন্মস্থান খুঁজে বের করে সবচেয়ে উচুঁ মন্দির বানানোর কথা বলে, এই আয়োজনই তাদের ধর্ম, এই আয়োজনেই হারিয়ে যায় ভগবান, পড়ে থাকে আচার, বিচার, প্রথা আর কুসংস্কার, যার বিরোধিতা করেই বড় হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিজেপির ধর্ম মানুষকে আলাদা করে দেয়, বিভেদের জাল বোনের তাদের আচার বিচার, ভাবনা, আচরণ। রবি ঠাকুরের ধর্ম বিশ্বমানবতাবাদ, সব্বার বেঁচে থাকার আশ্বাস, এক জীবনচর্যা। কোনটা বেছে নেবেন? না দুটো নেওয়া সম্ভব নয়, তারা আকারে, প্রকারে, নীতিতে, আচরণে এতটাই বিপ্রতীপ, এতটাই আলাদা, এতটায় একে অন্যের বিরুদ্ধে, যে হয় আপনাকে আরএসএস – বিজেপি বেছে নিতে হবে, নয় রবি ঠাকুর কে, দুই এর সহাবস্থান সম্ভব নয়।

বিজেপির আর আছে কী? আর আছে তাদের রাষ্ট্রবাদ, জঙ্গি রাষ্ট্রবাদ, এক উগ্র জাতীয়তাবাদ। আচ্ছা, রবি ঠাকুর কী বলছেন এই বিষয়ে? ১৯২১ সালে জগানন্দ রায়কে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলছেন—nationalism হচ্ছে একটি ভৌগোলিক অপদেবতা৷ পৃথিবী সেই ভূতের উপদ্রবে কম্পান্বিত—সেই ভূত ছাড়াবার দিন এসেছে। ওই একই সালে দীনবন্ধু এন্ড্রুজকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলছেন— I love India but my India is an idea and not a geographical expression. Therefore, I am not a patriot. I shall ever seek my compatriots all over the world. কেবলমাত্র এই কথাগুলো বলার দায়ে আজকের ভারতবর্ষে যে কোনও মানুষকে পিটিয়ে মারা হতে পারে, জেলে পাঠানো হতেই পারে। তিনি বিশ্ব ভাতৃত্বের কথা বলছেন, patriotism সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য আরো পরিষ্কার করে পাই 1311 বঙ্গাব্দে বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত ‘দেশের কথা’ প্রবন্ধে–“প্যাট্রিয়াটিজমের প্রতিশব্দ দেশহিতৈষিতা নহে। জিনিসটা বিদেশী, নামটাও বিদেশী থাকিলে ক্ষতি নাই‌। যদি কোনো বাংলা শব্দ চালাইতেই হয় তবে স্বাদেশিকতা কথাটা ব্যবহার করা যাইতে পারে। স্বাদেশিকতার ভাবখানা এই যে, স্বদেশের ঊর্ধে আর কিছুকেই স্বীকার না করা।……যেখানে স্বদেশের স্বার্থ লইয়া কথা সেখানে সত্য, দয়া, মঙ্গল, সমস্ত নিচে তলাইয়া যায়। স্বদেশীয় স্বার্থপরতাকে ধর্মের স্থান দিলে যে ব্যাপারটা হয় তাহাই প্যাট্রিয়াটিজম শব্দের বাচ্য হইয়াছে।……ন্যাশনালত্বের সুবিধার খাতিরে মনুষ্যত্বকে পদে পদে বিকাইয়া দেওয়া, মিথ্যাকে আশ্রয় করা, ছলনাকে আশ্রয় করা, নির্দয়তাকে আশ্রয় করা প্রকৃতপক্ষে ঠকা।……মনুষ্যত্বের মঙ্গলকে যদি ন্যাশনালত্ব বিকাইয়া দেয়, তবে ন্যাশনালত্বের মঙ্গলকেও একদিন ব্যক্তিগত স্বার্থ বিকাইতে আরম্ভ করিবে’। আসলে সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র মানুষের মঙ্গলের জন্য, তাদের শ্রীবৃদ্ধির জন্য তৈরি করা হয়েছে, মানুষের সর্বাঙ্গীন বিকাশ তার লক্ষ্য, আর তা যদি না পাওয়া যায়, তাহলে এই দেশ, এই রাষ্ট্রের কোনও মূল্য নেই, এই সৎ উচ্চারণ তিনি করেছিলেন। আজ সারে জঁহা সে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হমারা বলতে বলতে মানুষ কে পিটিয়ে মারা হচ্ছে, দেশ, রাষ্ট্র তো পরের কথা যে কোনও সরকারবিরোধী কথাকেও দেশদ্রোহিতা বলে চালানোর চেষ্টা চলছে, সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা মানুষজনদের দেশ বিরোধী, রাষ্ট্র বিরোধী বলে জেলে পোরা হচ্ছে, এটা আর এস এস – বিজেপির রাষ্ট্রবাদ, যেখানে মানুষের মনুষ্যত্ব বলি দিয়ে রাষ্ট্র কে বাঁচিয়ে রাখার কথা হয়। ঠিক তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আমাদের ঠাকুর জাতীয়তা বাদ কে এক ভৌগলিক অপদেবতা বলেন, তিনি বলেন মানুষের মঙ্গলের উর্ধে দেশ নয়, রাষ্ট্র নয়। কাজেই আপনি যদি আর এস এস – বিজেপি কে সমর্থন করেন, তাহলে আপনি রবীন্দ্র দর্শনের বিরোধী, রবীন্দ্র চিন্তার বিরোধী। যে কোনও একটাকে বেছে নিন, হয় আর এস এস – বিজেপি, নাহলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আমাদের ঠাকুর।

RELATED ARTICLES

Most Popular

Video thumbnail
Mamata Banerjee LIVE | স্বাধীনতা দিবসে রেড রোডে মুখ্যমন্ত্রী, দেখুন সরাসরি
01:23:26
Video thumbnail
Narendra Modi LIVE | স্বাধীনতা দিবসে দেশবাসীকে বড় বার্তা প্রধানমন্ত্রীর
01:02:40
Video thumbnail
Abhishek Banerjee | ডায়মন্ড হারবার নিয়ে অনুরাগ ঠাকুরের অভিযোগের পাল্টা দিলেন অভিষেক
02:09:10
Video thumbnail
Trump-Russia | প্রস্তাব না মানলে ভ/য়ানক পরিণতি, রাশিয়াকে হু/ম/কি ট্রাম্পের, কী করবেন পুতিন?
01:52:00
Video thumbnail
Politics | জানতে ক্ষুদে পড়ুয়াদের হাল, মুখ্যমন্ত্রী গেলেন হাসপাতাল
05:06
Video thumbnail
Politics | নি/র্যা/তিতার মূর্তি নিয়ে এবার, গোলমালে জুনিয়র ডাক্তার
04:40
Video thumbnail
Politics | মোদি করে টলমল RSS মাপছে জল?
04:59
Video thumbnail
Politics | দেশবাসীকে উপহার এখন স্বাধীনতা দিবসে মোদির ভাষণ
04:34
Video thumbnail
Politics | বাঙালি ভোলে যদি? বাংলা নিয়ে প্রশংসায় মোদি
06:27
Video thumbnail
Stadium Bulletin | অবসর প্রসঙ্গে বি/স্ফোরক শেহবাগ! কীভাবে প্রস্তুত হচ্ছে দুই প্রধান?
21:51