Sunday, August 10, 2025
HomeফিচারSurya Sen | ইতিহাসে উপেক্ষিত বিপ্লবী 'মাস্টারদা' সূর্য সেন

Surya Sen | ইতিহাসে উপেক্ষিত বিপ্লবী ‘মাস্টারদা’ সূর্য সেন

Follow Us :

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে উপেক্ষিত বিপ্লবী ‘মাস্টারদা’ সূর্য সেন  ইংরেজ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সরকারের পোষা দেশীয় ‘টিকটিকি’দের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন মাস্টারদা। শুধু বেতনভুক নেটিভ কালাকুত্তাদেরই নয়, কালাপানির ওপারে শ্বেতাঙ্গ মালিকদেরও সুখশান্তি নষ্ট করে দিয়েছিলেন সূর্য সেন। কিন্তু, মহাত্মা ও কংগ্রেসের ছাতায় ঢাকা স্বাধীনতার ইতিহাসে মাত্র দু-একটি পাতায় সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছে তাঁর কীর্তি। লালকেল্লায় কিংবা আন্দামানে জাতীয় পতাকা ওড়ানোর বহু আগে কম সময়ের জন্য হলেও ব্রিটিশ সরকারের মুখে চুনকালি মাখিয়ে স্বাধীন চট্টগ্রাম ঘোষণা করেছিলেন খাদির খাকি ধুতি ও জামা গায়ে বেতের মতো চেহারার এই মানুষটি। বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের প্রচারে ক্যামেরাম্যান-সাংবাদিক নিয়ে ঘুরতেন না। কিন্তু, বেশ কয়েক বছর ধরেই ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের খবর ছিলেন তিনিই। স্বাধীনতার লড়াইয়ে শুধু পুরুষরাই লড়বে এমন ধারণাকে ভেঙে দিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবে মহিলাদের উজ্জীবিত করেছিলেন সূর্য সেন। তাঁর অনুগামী নারীশক্তি চুরি পরা হাতে বোমা-রিভলভার তুলে নিয়ে এদেশের মাটিতে বস্তাপচা ভারতীয় পুরুষতন্ত্রের ঘোমটা উপরে ফেলে দিয়েছিল। সব মিলিয়ে মাস্টারদা এদেশে ইংরেজ বিরোধী এমন এক লড়াই জাগিয়ে তুলেছিলেন, যা পরবর্তীতে দেশের যুবশক্তির মধ্যে সজীব প্রাণ সঞ্চার করেছিল। সেই সূর্য সেনের আজ জন্মদিন।

সিনেমার দৌলতে সূর্য সেনের সত্য-মিথ্যায় ভরা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার জয়ের কাহিনি অনেকেরই জানা। কিন্তু সেই জয়কে ব্রিটিশ সংবাদের ভাষ্যে ভারতীয় ঐতিহাসিকরাও ‘লুণ্ঠন’ শব্দে ব্যাখ্যা করেছিলেন, কাদের প্রভাবে? তাঁকে স্বদেশী ‘ডাকাত’ও বলা হয়েছে। কিন্তু, ইতিহাস জানে, মাস্টারদা তো কোনও ঘর-গৃহস্থালিতে ডাকাতি করেননি। যা করেছিলেন সবই ইংরেজদের সম্পত্তি। ভারতের মানুষের রক্ত চুষে যা দখল করে রেখেছিল গোরা বাহিনী। তিনি বলেছিলেন, ওদেরই অস্ত্র দিয়ে ওদেরই নিশানা বানাব। মাস্টারদা বলতেন, ইংরেজ অপ্রতিরোধ্য, অপরাজেয় এটা গোটা বিশ্ব জানে। কিন্তু আমরা প্রমাণ করে দেব, শক্তি আর সাহস থাকলে তাদেরও হারানো যায়। আর সেই কারণেই সূর্য সেনের ফাঁসির নামে যাঁদের চোখে জল আসে, কীভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল, তা জানলে ওই চোখে আগুন জ্বলে উঠবে।
ঐতিহাসিক বিপন চন্দ্র তাঁর ইন্ডিয়াজ স্ট্রাগল ফর ইন্ডিপেন্ডেন্স: ১৮৫৭-১৯৪৭ গ্রন্থে লিখেছেন, সূর্য সেন ছিলেন এক অসামান্য সংগঠক। গভীর মানবতা ও ব্যক্তি ক্যারিশ্মার দ্বারা তিনি সংগঠনের অন্য কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন সশস্ত্র সংগ্রামে। তিনি নিজেও বলতেন, বিপ্লবীর অন্যতম গুণই হচ্ছে মানবিকতা। বিপ্লবী সূর্য সেনের আসল নাম সূর্যকুমার সেন। ডাকনাম কালু। জন্ম ২২ মার্চ, ১৮৯৪। তদানীন্তন চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় বাস ছিল তাঁদের। মা শশীবালা সেন এবং বাবা রাজমণি সেন। দুই পুত্র ও চার কন্যা রেখে তাঁদের অকালপ্রয়াণের পর কাকা গৌরমণি সেনের কাছে বড় হন সূর্য সেন। পড়াশোনা দয়াময়ী উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়, নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়, নন্দনকাননের ন্যাশনাল হাইস্কুল হয়ে চট্টগ্রাম কলেজ। কিন্তু তৃতীয়বর্ষের কোনও এক সাময়িক পরীক্ষায় ভুলক্রমে টেবিলে পাঠ্যবই রাখার কারণে কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হলে পড়তে আসেন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে। সেখান থেকে বিএ পাশ করে চট্টগ্রামে ফিরে সেই ন্যাশনাল হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। অসহযোগ আন্দোলনের (১৯২০-২২) সময় স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেলে দেওয়ানবাজারে অধুনালুপ্ত উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে গণিত শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এ সময় থেকেই বিপ্লবীদলের সঙ্গে তাঁর সখ্য গভীরতর হয় এবং হয়ে ওঠেন বিপ্লবীদের ‘মাস্টারদা’।

আগুনঝরা ১৯৩০
মাস্টারদার হাতে গড়া ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি ১৮ এপ্রিল গোটা চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের অন্য অংশের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। রেল লাইন, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ সংযোগ কেটে দেওয়া হয়। স্বদেশীরা দখল করে পুলিশের অস্ত্রাগার। কিন্তু সেখানে অস্ত্রের খোঁজ না পেয়ে চলে যায় মাস্টারদার সেনাবাহিনী। যদিও যাওয়ার আগে তাঁরা সেখানে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে যান। বিপন চন্দ্র লিখেছেন, যাওয়ার আগে গান্ধী টুপি পরিহিত সূর্য সেন জাতীয় পতাকা তুলে স্লোগান দেন বন্দে মাতরম, ইনকিলাব জিন্দাবাদ। ঘোষণা করেন, প্রাদেশিক বিপ্লবী সরকারের।

আরও পড়ুন: Jayati Chakraborty | Song | Controversy | ‘জয়তীদি ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন…. কিন্তু’

মাস্টারদা জানতেন, এবার ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজবে। তাঁরা লুকিয়ে আশ্রয় নেন জালালাবাদ পাহাড়ে। ২২ এপ্রিল ইংরেজ সেনা তাঁদের পাকড়াও করার চেষ্টা করলেও পালিয়ে যেতে সক্ষম হন সূর্য সেন। ওই যুদ্ধে ৮০ জন ব্রিটিশ সেনা এবং ১২ জন বিপ্লবীর মৃত্যু হয়। তখন তাঁরা বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে শুরু করেন। বিপন চন্দ্র লিখেছেন, গ্রামের মানুষ যাঁদের অধিকাংশই মুসলিম, তাঁরা আশ্রয় দেন বিপ্লবীদের। এভাবে প্রায় ৩ বছর আত্মগোপন করে থাকেন সূর্য সেনরা।

এর মধ্যেই ১৯৩২ সালে ডিনামাইট দিয়ে চট্টগ্রাম জেল ভেঙে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন মাস্টারদা। একাজে দায়িত্ব দেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্তকে। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ওই বছরই পাহাড়তলি ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। যে ক্লাবের বাইরে লেখা থাকত, ‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ।’ প্রীতিলতার সেই চেষ্টা সফল হলেও তিনি মারাত্মক জখম হন। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগেই পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।

বিপ্লবী সূর্য সেনকে ধরিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব যার, তার নাম নেত্র সেন। সূর্য সেনকে তখন ধরার জন্য হন্যে ব্রিটিশবাহিনী। প্রথমে ৫০০০ টাকা এবং পরবর্তীতে ১০,০০০ টাকা ইনাম ঘোষণা করে তারা। কাগজে তা নিয়ে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়। সূর্য সেন গৈরলা গ্রামে ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে আত্মগোপন করে আছেন। সেদিন কয়েকজন বিপ্লবীর গোপন বৈঠক চলছে। বৈঠকে থাকা ব্রজেন সেনের ভাই নেত্র সেনের খবরের সূত্রে ব্রিটিশবাহিনী বাড়িটি ঘিরে ফেলে। অন্ধকারে রাতভর গুলিবিনিময়ের মধ্যে কয়েকজন বিপ্লবী গা-ঢাকা দিতে সমর্থ হলেও ধরা পড়েন সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেন। তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ সূর্য সেনের হাতে লেখা অর্ধসমাপ্ত আত্মজীবনীর খাতা উদ্ধার করে। সেই খাতার উপরে লেখা ছিল ‘বিজয়া’। বিচারকালে সেই বিজয়ায় লিখিত বক্তব্যই রাজদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের প্রমাণ হিসেবে আদালতে তুলে ধরে ব্রিটিশ শাসকরা।

ব্রিটিশ আদালতে ফাঁসির আদেশ হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু মাস্টারদার উপর ইংরেজদের এত রাগ ছিল যে, ফাঁসির আগে তাঁকে পিটিয়ে গুঁড়ো করে দেওয়া হয়েছিল। মাস্টারদার সহযোগী যোদ্ধা আনন্দপ্রসাদ গুপ্ত তাঁর গ্রন্থে (চট্টগ্রাম বিদ্রোহের নায়ক সূর্য সেন) বিবরণ দিয়েছেন, ফাঁসির আগে কারাগারের কয়েক জন ব্রিটিশ পুলিশ মাস্টারদার উপর প্রচণ্ড শারীরিক নির্যাতন শুরু করে। চিৎকার শুনে পাশের কুঠুরিতে সহযোদ্ধা ফাঁসির দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত তারকেশ্বর দস্তিদার প্রবল প্রতিবাদ করলে তাঁর উপরেও নেমে আসে নির্যাতনের কঠোর শাস্তি। মাস্টারদার প্রায় সমস্ত দাঁতই উপরে ফেলা হয়। শেষে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ফাঁসি দেওয়া হয় এই দুই বিপ্লবীকে। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সহ-অধ্যাপক হায়াত হুসেন মাস্টারদার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যক্তির কাছ থেকে কিছু সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন আটের দশকে, যা তিনি বাংলাদেশে সূর্য সেন শতবার্ষিকী উদ্‌যাপন কমিটি প্রকাশিত (১৯৯৩-৯৪) স্মারকগ্রন্থে উল্লেখ করেন। মৃত্যুর পর মাস্টারদার মৃতদেহের যে কী করুণ পরিণতি হয়, তার বর্ণনা পাওয়া যায় প্রত্যক্ষদর্শী ব্রজেন সেন ও মাস্টারদার গ্রামের অধিবাসী নুর আহমেদের সাক্ষাৎকারে। উভয়েই বলেছেন, মাস্টারদার মৃতদেহ বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নুর ১৯২৮ সালে কনস্টেবল পদে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন।
সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মাস্টারদার ফাঁসির দিন প্রায় ৫০ জন পুলিশ নিযুক্ত করা হয়েছিল কারাগারের ফটকের সামনে। ফাঁসির পরে একটি ট্রাকে করে সূর্য সেন ও তাঁর সহকর্মী তারকেশ্বর দস্তিদারের মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় চার নম্বর জেটির কাছে। সেখানে তখন একটি জলযান নিয়ে হাজির আরও কিছু সশস্ত্রবাহিনী ও অফিসারের দল। ব্রিটিশ ক্রুজার ‘দ্য রিনাউন’য়ে
তুলে দেহ দু’টি বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রা শুরু করলে কয়েকজন ব্রিটিশ মৃতদেহ দু’টিতে পদাঘাত করতে শুরু করে। এই অমানবিক দৃশ্যে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে ব্রিটিশরা নিবৃত্ত হয়। দেহ দু’টিকে পৃথকভাবে লোহার দড়ি দিয়ে বেঁধে ছুড়ে ফেলা হয় বঙ্গোপসাগরের অতলে।

RELATED ARTICLES

Most Popular

Video thumbnail
Good Morning Kolkata | সকালের গুরুত্বপূর্ণ খবর, দেখুন একনজরে সরাসরি
03:00:30
Video thumbnail
Nabanna Abhijan | নবান্ন অভিযানের মিছিল রুখতে তৈরি 'লৌহকপাট'
44:46
Video thumbnail
Modi-Putin | পুতিনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা মোদির, কী কী বিষয়ে কথা? দেখুন বড় আপডেট
03:25:40
Video thumbnail
Priyanka Gandhi | এই ভাষণে নির্মলাকে ধুয়ে দিলেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, না দেখলে মিস
03:17:30
Video thumbnail
Jaya Bachchan | Nirmala Sitharaman | বলুন আমি কত ট্যাক্স দেব? সংসদে নির্মলাকে ধুয়ে দিলেন জয়া বচ্চন
03:12:38
Video thumbnail
Politics | 'এ যুগের গান্ধী কে? নরেন্দ্র মোদি আবার কে!'
04:15
Video thumbnail
Politics | ইডির কর্মকর্তা কপিল রাজ রিলায়েন্সে নিলেন কেন কাজ?
03:18
Video thumbnail
Politics | বাদ পড়ছে অনুপ্রবেশকারী অমিত শাহের মন্তব্য জারি
03:32
Video thumbnail
Bangla Bolche | Ankan-Baiswanor | শুভেন্দুর কথায় বাগবিত/ণ্ডায় অঙ্কন-বৈশ্বানর
02:28
Video thumbnail
Bangla Bolche | Firdous Samim | ''ব্যর্থতার দায় নিতে হবে CBI-কেও''
01:57