এমনিতে সংসদে বহুদিন ধরেই বাংলা থেকে ভালো বক্তা ছিলেন না। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় স্পিকার হয়ে যাওয়ার পরে সিপিএম সাংসদদের মধ্যে এক আধবার বাসুদেব আচার্য আর সিপিআই সাংসদ গুরুদাস দাশগুপ্ত নজর কেড়েছিলেন। মহম্মদ সেলিমের কয়েকটা ভাষণ শোনার মতো ছিল। কিন্তু তারপর সংসদে বাংলার কেউ ভালো বলছেন, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, বাংলা থেকে নির্বাচিত সদস্যরা শাসকদলের নেতাদের বক্তৃতা মন দিয়ে শুনছেন সাংবাদিকেরা, রাজনীতি সচেতন মানুষজন, এমনটা খুব দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু হঠাৎই সেই অবস্থাটা এক্কেবারে বদলে গেল। ডেরেক ও’ব্রায়েন, সাকেত গোখলে, সাগরিকা ঘোষ, লোকসভাতে মহুয়া মৈত্র, সায়নী ঘোষ, ওদিকে কল্যাণ ব্যানার্জি, সৌগত রায় এবং অবশ্যই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মিলে একটা দুর্দান্ত টিম করে ফেলেছেন। বলতে উঠছেন বেশ পড়াশুনো করে, বলার স্টাইল, সব মিলিয়ে বাংলার নির্বাচিত সাংসদেরা কিন্তু দারুণ একটা টিম বানিয়ে ফেলেছেন। এতজন ভালো বক্তার টিম কিন্তু বামেদের ছিল না, ইন ফ্যাক্ট এই মুহূর্তে কংগ্রেসের বা অন্য কোনও বিরোধী দলেরও নেই। আজ তাই আমার কথা না বলে আমি বরং এই ক’দিন আগে তৃণমূলের দুই সাংসদ, মহুয়া মৈত্র আর সাকেত গোখলের দু’দিনের দুটো ভাষণের সারাংশটা শোনাই। ততটাই ইন্টারেস্ট নিয়ে শুনেছি যতটা ইন্টারেস্ট নিয়ে একসময়ে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় বা গুরুদাস দাশগুপ্তদের সংসদের ভাষণ শুনতাম। মহুয়া মৈত্র লোকসভায় ফিনান্স বিল ২৫-২৬-এর বিরুদ্ধে বলছিলেন, তথ্য আর যুক্তির অসামান্য ককটেল। সরকারের টাকা-পয়সার নীতি আর অর্থনীতির নানা দিক ছেঁড়াছিঁড়ি করে উলঙ্গ এই সরকারের ছবিটা তুলে ধরেছেন সব্বার সামনে।
মহুয়া মৈত্র শুরু করলেন সরকারের ট্যাক্স নীতির ফলে যে দুই ভারতের জন্ম হয়েছে সেই ভারতের দুই রকম ছবি দেখিয়ে— একটা ‘কুবেরদের ভারত’ বড়লোকদের জন্য, যেখানে তাদের জন্য ট্যাক্স ছাড়, লোন মাফ, বিভিন্ন স্কিম, আর একটা ‘বিশ্বকর্মাদের ভারত’– সাধারণ মানুষের জন্য, যারা সরকারের অর্থনীতির ভুলভাল সিদ্ধান্তের ভার বইছে। মহাকুম্ভের মতো বড় বড় তামাশার দর্শক হয়েই থেকে গেছেন, সেই আমজনতার ছবি। তিনি বললেন, সাংসদ থেকে মন্ত্রী চুপ করে শুনল, ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের এত বড় ক্ষমতা থাকলেও ১৪০ কোটি লোকের মধ্যে মাত্র ৫৬ লাখ মানুষ আসল ট্যাক্স দেয়। সেই লোকজনেরা যাঁরা ১২ লক্ষ টাকা রোজগার করেন, তাঁদের ট্যাক্স দিতে হবে না, সেটাকে এক বিরাট সাফল্য হিসেবে বলা হচ্ছে, ধনীদের জন্য নতুন ট্যাক্স ছাড় থাকলেও ‘বিশ্বকর্মাদের ভারত’-এর বেশিরভাগ মানুষের জন্য কোনও সুবিধেই নেই। জিএসটি-কে তিনি বললেন একটা উলট পুরাণ, যেখানে সমান-সমান নীতি, ধনী-গরিব সবাই একই ট্যাক্স দেয় জিনিসপত্রের উপর। ২০২৩ সালে জিএসটি থেকে ২০ লক্ষ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে, মানে জনপ্রতি প্রায় ১০০০ টাকা। সামাজিক খাতে টাকা কমানোর কথা উঠে এল তাঁর বক্তৃতায়, ইনকাম ট্যাক্সে ৪ শতাংশ হেলথ-এডুকেশন সেস থাকলেও শিক্ষায় জিডিপির মাত্র ৪.৫ শতাংশ বরাদ্দ, চিনের বরাদ্দ ৬.২ শতাংশ। আর স্বাস্থ্যে? ন্যাশনাল হেলথ পলিসি ২০১৭ বলেছে অন্তত ২.৫ শতাংশ হওয়া উচিত। হয়েছে জিডিপির ১.৯৪ শতাংশ। খাদ্য ভর্তুকি কমে গেছে, MNREGA-তে টাকা কম দেওয়া হচ্ছে। ২০১১-এর জনগণনার ভিত্তিতে খাদ্য সুরক্ষা চলছে, অথচ ই-শ্রম পোর্টাল বলছে আরও ৮ কোটি লোকের রেশন পাওয়া উচিত।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ট্রাম্প আর মোদি যেন এক মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ
এদিকে সরকার জনগণনা কবে হবে তাও বলছে না। সরকারের উন্নয়নের গল্প নিয়ে মহুয়া মৈত্র তুলে ধরলেন আসল হিসেবগুলো যেখানে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে জিডিপি বাড়ার হিসেব আপাতত কমে গেছে। বিদেশি টাকা কম আসছে, বেসরকারি বিনিয়োগ কম, ম্যানুফ্যাকচারিং ১৭ শতাংশে আটকে আছে, গ্রামে ৯ শতাংশ বেকার। ঘাটতি কমেছে জরুরি খরচ কেটে, আয় বাড়িয়ে নয়। ২০১৯-এ কর্পোরেট ট্যাক্স ৩০ শতাংশ থেকে ২২ শতাংশে নামলেও বিনিয়োগ বাড়েনি। ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় আদানির পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য খাতিরের ছাড় দেওয়া হচ্ছে। আগের থেকে অনেক বেশি সংখ্যায় ভারতীয় নাগরিক উন্নয়ন আর বিকাশের এই ফাঁকিবাজি বুঝতে পেরেই বিদেশি নাগরিকত্ব নিচ্ছে, কোটিপতিরা দেশ ছাড়ছে। তিনি তুলে ধরলেন বহু না জানা তথ্য, নতুন ইনকাম ট্যাক্স অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টে ইলেক্টোরাল বন্ডকে আবার আনার চেষ্টা হচ্ছে। যদিও সুপ্রিম কোর্ট এটাকে অসাংবিধানিক বলে তাদের রায় দিয়েছিল, তবুও আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। সব্বাই জানে ওই ইলেক্টোরাল বন্ডের টাকা এমনকী লোকসানে ভুগতে থাকা কোম্পানি আর তদন্তের আওতায় থাকা মালিকদের কাছ থেকে বিজেপির কাছে গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বসে শুনলেন, মহুয়া বললেন ED, CBI-কে ‘পেশাদার কালেকশন এজেন্ট’। বললেন, ইডির মামলায় সাজা কম, বিনা জামিনে জেলা খাটানোটাই আসল লক্ষ্য, বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে বেশি কেস দেওয়াটাই প্রধান কাজ। ফাটাফাটি এই বক্তৃতার শেষে মহুয়া মৈত্র বললেন, এই ফিনান্স বিল, এই সরকার আসলে ধনী-গরিব সবাইকে উপেক্ষা করে, সরকার আর তার এজেন্সির হাতে বেপরোয়া সীমাহীন ক্ষমতা তুলে দিয়েছে। শেষে ছিল জর্জ অরওয়েলের নাইনটিন এইট্টি ফোর থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে “প্রত্যেকটা রেকর্ড নষ্ট করা হয়েছে বা ভুয়ো করা হয়েছে, প্রত্যেকটা বই আবার লেখা হয়েছে, প্রত্যেকটা ছবি নতুন করে আঁকা হয়েছে, প্রত্যেকটা মূর্তি আর রাস্তার বিল্ডিং-এর নাম বদলানো হয়েছে, প্রত্যেকটা তারিখ পাল্টে দেওয়া হয়েছে। আর এই কাজটা দিনের পর দিন, মিনিটের পর মিনিট চলছে। ইতিহাস থেমে গেছে। কিচ্ছু নেই, শুধু একটা শেষ না-হওয়া এখন আছে, যেখানে পার্টি সবসময় ঠিক।” তিনি যখন শেষ করলেন তখন ট্রেজারি বেঞ্চে কারও গলায় কোনও কথা ছিল না, হ্যাঁ এইভাবেই বাংলার নির্বাচিত সাংসদেরা আবার সংসদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন।
সাকেত গোখলে রাজ্যসভায় তৃণমূলের সদস্য, অসাধারণ পড়াশুনো, অসাধারণ বলেন, এক নবীন সাংসদের বক্তৃতার মাঝে যখন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হয়, তখনই বোঝা যায় বুনো ওলের উপরে বাঘা তেঁতুল পড়েছে। সাকেত গোখলে শুরুই করলেন জনধন অ্যাকাউন্ট দিয়ে। জনধন অ্যাকাউন্ট, যেগুলো গরিবদের জন্য, তার বেশিরভাগটাই এখন ডরম্যান্ট, মানে নিস্ক্রিয়। সেই অ্যাকাউন্টগুলোর ১৪,০০০ কোটি টাকা পড়ে আছে, কেউ ছুঁতে পারছে না। মানে, লোকের নিজের টাকাও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। হিসেব তুলে ধরলেন ভারতীয়রা ১৮ শতাংশ বেশি ঋণ নিচ্ছে, কিন্তু ব্যাঙ্কে জমা বাড়ছে মাত্র ১১ শতাংশ। মনে হচ্ছে লোকে বেশি ধার করে চলছে। ক্রেডিট কার্ড আর পার্সোনাল লোনের মতো অসুরক্ষিত ঋণের পরিমাণ ৬২ লক্ষ কোটি টাকা, যেটা ভারতের জিডিপির ২৫ শতাংশ। এটা সাধারণ মানুষের উপর বড় ঋণের বোঝা। এই অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে সোনার লোন ৬৮ শতাংশ বেড়েছে। তার মানে হচ্ছে অর্থনীতির হাল বেহাল। তাই লোকে সোনা বাঁধা দিয়ে টাকা ধার করছে। শহরে চাকুরিজীবীদের মাইনের ৩৩ শতাংশ EMI-তে চলে যাচ্ছে। যাদের আয় ১ লাখ টাকার কাছাকাছি, তাদের ট্যাক্স-কাটা মাইনের ৪৬ শতাংশ পুরনো ঋণ শোধে যাচ্ছে। বাকি খরচের জন্য হাতে কিছুই থাকছে না। ওদিকে ভারতীয় ব্যাঙ্কে ১০ লাখ কোটি টাকার নন পারফর্মিং অ্যাসেট (NPA) আছে। সরকার এগুলো ‘রাইট অফ’ করতে বলছে, ব্যাঙ্কের হিসেবকে সুন্দর করে দেখানোর একটা চেষ্টা হচ্ছে কিন্তু ব্যাঙ্কের টাকা তো ফেরত আসছে না। বড় কোম্পানি কম ধার করছে আর টাকা জমিয়ে বসে আছে, তারা টাকা ইনভেস্ট করছে না, কিন্তু সাধারণ লোক, ছোট ব্যবসা আর কৃষকদের বেশি ধার করতে হচ্ছে। এতে জিডিপি কমছে। ব্যাঙ্কে জমার সুদ আর কত কমবে? কমেই যাচ্ছে। তাই ব্যাঙ্কে টাকা রাখলে লোকসান। লোকে ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ার মার্কেটে টাকা ঢালছে, সেখানেও হারাচ্ছে। মাস দেড়েক ধরে বাজারের পতন তাই বলছে। মজার কথা হল পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্ক কেবলমাত্র মিনিমাম ব্যালেন্স না রাখার জন্য ৮,৫০০ কোটি টাকা জরিমানা থেকে কামিয়েছে, সেগুলো কারা দিয়েছে? নিশ্চয়ই বড়লোকেরা নয়, দিয়েছে গরিব মানুষেরা, মধ্যবিত্ত মানুষজন যাঁদের নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে। বারবার, ছ’মাস অন্তর KYC করতে বলার একটাই উদ্দেশ্য, গরিব আর মধ্যবিত্তদের হয়রানি করা, আর কোনও কারণ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। কারণ সরকারের কাছে সব তথ্য আছে। সাকেত গোখলে তাঁর বক্তৃতা শেষ করছেন নতুন ব্যাঙ্ক আইনের বিভিন্ন তথ্য দিয়ে, যা সাফ বলে দেয় নতুন ব্যাঙ্ক আইন আসলে এই সমস্ত ঘাপলাগুলোকে চাপা দেওয়ার জন্যই আনা হচ্ছে।
আসলে বছর দুই হল সংসদে তৃণমূল প্রার্থীদের পারফরম্যান্স নিয়ে সত্যিই আলাদা করে বলা উচিত, আর সেটার সবচেয়ে বড় কারণ তিনটে, ১) দলনেত্রী প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে রাজ্যসভাতে এমন মানুষজনদের পাঠিয়েছেন যাঁরা ইংরিজি, হিন্দি ভাষায় সচ্ছন্দ, যাঁদের যথেষ্ট পড়াশুনো আছে, যাঁরা রাজনীতি থেকে অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ে ওয়াকিবহাল তাঁদের পাঠানো হচ্ছে রাজ্যসভায়। ২) কেবল বিরোধিতাই নয়, বাংলার স্বার্থকে মাথায় রেখেই সমস্ত বিরোধিতাকে সংহত করার নির্দেশ আছে, কাজেই সাংসদেরা কে কোন বিষয়ে বলবেন তা আগে থেকেই ঠিক করা হচ্ছে, বলা হচ্ছে, সেই অনুযায়ী তাঁরা তাঁদেরকে তৈরি করছেন। ৩) একটা পুরোদস্তুর অফিস এই বক্তাদের বিভিন্ন তথ্য জোগাচ্ছে, বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য হাজির করে সরকারের সামনে তাঁরা নজর কাড়ছেন, নজর কাড়ছেন সাংবাদিকদের, এখন দিল্লির সাংবাদিকেরা প্রায়শই ডেরেক ও’ব্রায়েনের কাছে বিভিন্ন তথ্যের জন্য ফোন করেন, যা প্রমাণ করে যে তাঁরা ক্রমশ নিজেদের গড়েপিটে নিচ্ছেন।